শুক্রবার, ১৬ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

ফিরে আসার নামই জীবন

শাহনাজ মুন্নী

ফিরে আসার নামই জীবন

শ্‌শ্‌শ্‌শ্‌শ্‌- ঠোঁটের ওপর তর্জনী রেখে আমাকে থামায় সেজান। ওকে কেমন যেন অন্যরকম দেখায়, বিহ্বল চঞ্চল চোখের মণি দুটো নিয়ন্ত্রণহীন এদিক ওদিক ঘোরে, ডান থেকে বাঁয়ে, উপরে থেকে নিচে। আমি সবে সারা দিনের হোম অফিস শেষ করে, দীর্ঘ ক্লান্তিকর মিটিং সিটিং সেরে দুহাতে দুই মগভর্তি ধূমায়িত কফি বানিয়ে, সন্ধ্যাটা দুজনে গল্প করে কাটাব ভেবে বেশ রোমান্টিক মুডে গলা উঁচিয়ে শুধু ওকে একবার ডাক দিয়েছি,

‘সেজান, কোথায় তুমি? বারান্দায় আসো..’

‘শ্‌শ্‌শ্‌শ্‌শ্‌  এত জোরে কথা বলো না তো!’ বেডরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে চাপাগলায় ফিসফিস করে ও।  

‘কেন? কি হয়েছে, বলো তো?’ একটু অবাক হই আমি। এই বাসায় তো কোনো মুমূর্ষু রোগী নেই, আমার কথার শব্দে যার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। কোনো শিশুও নেই, আমার কথায় যার নিরবচ্ছিন্ন ঘুম ভেঙে যেতে পারে। তাহলে? এসব বলছে কেন সেজান? কি হয়েছে ওর? কোনো সমস্যা? বিধিনিষেধের কয়েকদিন আগে, মনে আছে, যখন অফিস থেকে ফোন করলাম, তখনো কেমন অস্থির ভয় ধরানো গলায় সেজান বলল, ‘আহ মেহের, তোমাকে কতবার বলেছি, এভাবে যখন-তখন ফোন কর না ...’

‘কেন গো? মিউজিক করছিলে? ডিস্টার্ব হলো?’

‘না, তা না। আমার মনে হচ্ছিল, আগেও বলেছি তোমাকে, কেউ আমাদের কথা শুনছে।’

আমি হেসে গড়িয়ে পড়ি, ‘দুর কে শুনবে? মানুষের কি খেয়েদেয়ে কাজ নেই, নাকি? আর শুনলেই বা কি, ওরা আমাদের গভীর প্রেমালাপ শুনবে। আমি চিৎকার করে বলব সেজান তোমাকে ভালোবাসি, ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি।’

সেজান তক্ষুনি ফট করে ফোনটা কেটে দিল। প্রথমে ভেবেছিলাম রাগ করব ওর ওপর। বাড়ি ফিরে অন্তত দুই ঘণ্টা কথা বলব না। অভিমান করে থাকব। পরে মন পাল্টালাম। ক্রিয়েটিভ মানুষ, একটু পাগলা পাগলা হয়। সত্যি বলতে ওর পাগলামিটাই তো টেনেছিল আমাকে। নইলে সেজানের সঙ্গে আমার বয়সের ফারাক বিস্তর, ওর এখন সাতাশ চলছে, আমার আটত্রিশ। তো আমাদের সম্পর্ক নিয়ে লোকে আড়ালে আবডালে নানা কথা বলাবলি করে, কুৎসিত নোংরা মন্তব্যও করে জানি কিন্তু আমি সেসব কথায় কখনো কান দিই না। বয়সের ফ্রেম দিয়ে যে সম্পর্কের সুতা বাঁধা যায় না, সেটা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে? সম্পর্কের বাঁধা-ধরা নিয়মও মানি না আমি, কার প্রেমে পড়ব, কোন বয়সে প্রেমে পড়ব সেসব অন্য লোকে ঠিক করে দেবে নাকি আমায়? 

‘সব কিছু ঠিক হলে, চলো পাহাড় বা সমুদ্র কোথাও একটু ঘুরে আসি। তোমার একটু চেঞ্জ দরকার।’

সেজানের হাতে কফির মগটা ধরিয়ে দিয়ে বলি আমি। আমাদের ছোট্ট বারান্দায় দখিনা বাতাস এসে ঝোলানো অর্কিডগুলোকে আলতো করে ছুঁয়ে কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। বেশ লাগে আমার। অনেকক্ষণ নীরবতাই রাজত্ব করে, আমরা কেউই কথা বলি না। নিঃশব্দে কফিতে চুমুক দিতে দিতে সন্ধ্যার আবছা আলোয় আমি সেজানকে দেখি, ওর অবিন্যস্ত চুল লম্বা হয়ে ঘাড় ছাড়িয়েছে, মুখে আগোছালো দাড়ি গোঁফের জঙ্গল, চেহারায় একটা চাপা অস্বস্তি। দেড় বছর ধরে কনসার্ট করতে পারছে না ওর গানের দল, এই শহরে এখন খোলা প্রান্তরে সমাবেশ নিষিদ্ধ, প্রকাশ্যে গান বাজনার অনুমতি নেই মেয়রের, অথচ সেজানদের গানের দলটা আকাশ বাতাস ফাটিয়ে মুক্ত কণ্ঠে গান করে অভ্যস্ত, চার দেয়ালের মধ্যে ওদের গলায় নাকি সুর বাজে না। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ির ছাদে বা গ্যারেজের স্বল্প পরিসরে অনুশীলন করে ওরা। এখন তো সঙ্গ নিরোধের কড়াকড়িতে সেটাও বন্ধ। গিটারিস্ট সুমন, ড্রাম বাদক সানি, হারমোনিকা বাজায় রুবেল, একেকজন উজ্জ্বল উচ্ছল তরুণ ওরা, সবাই সেজানের বন্ধু। সেই কলেজ জীবন থেকে একসঙ্গে জোট বেঁধে নিজেদের গানের দলটা ধরে রেখেছে ওরা। সেজান মেইন ভোকাল, গান লেখা থেকে সুর করা সব তাতেই ওর হাত।

‘আমি আসলে মিউজিকেই থাকি, মিউজিক খাই, মিউজিক পড়ি, মিউজিকে উড়ি, ভাসি, ঘুমাই, স্বপ্ন দেখি ...’ আমাদের পরিচয়ের শুরুতে সেজান বলেছিল। আমার তখন সবে আজমের সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে। বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে মুক্তির আনন্দে আর জীবনের প্রথম ভালোবাসা নষ্ট হয়ে যাওয়ার দুঃখে আমি ভাসমান ভবঘুরে। সেজানের একটা গান তখন আমাকে খুব আপ্লুত করে রেখেছিল।

‘কোনো কোনো ঝড় প্রেম বোঝে না, ভেঙে দেয় ঘর

কোনো কোনো নদী ঠিকানা হারায় ভুলে যায় প্রেমের প্রহর

কেন বাঁধো ঘর, কেন বাঁধো ঘর, ঘর যদি হয়ে যায় পর...’

ওদের প্রতিটা কনসার্টে যেতাম আমি। বসতাম সামনের সারিতে। ওদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে চিৎকার করে গান গাইতে ভালো লাগত। আমার তখন বয়কাট চুল, জিনসের ওপর টি-শার্ট চাপিয়ে নিজের একটা লাল স্কুটি চালিয়ে শহরময় চক্কর দিয়ে বেড়াই। একদিন রাতে, স্কুটি চালাচ্ছি, আমার পেছনে কাঁধ আঁকড়ে ধরে বসে আছে সেজান। আমাদের দুজনের মধ্যে তখনো গায়ক ও তার একনিষ্ঠ ভক্তের সম্পর্ক। মগবাজারে একটা গানের রেকর্ডিং শেষে সেদিন ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছিলাম আমি। মিন্টো রোডে এসে হঠাৎ কানের কাছে মুখ নিয়ে সেজান ফিসফিস করে বলল, ‘একটু থামবে মেহের, প্লিজ!’

ঘ্যাচ করে রাস্তার সাইডে স্কুটিটা দাঁড় করালাম আমি। ‘কি হয়েছে? কোনো সমস্যা।’

সেজান চোখ বন্ধ করে নাক টেনে বুকের মধ্যে অনেকখানি বাতাস নিয়ে বলল, ‘গন্ধ পাচ্ছ? ছাতিম ফুলের গন্ধ! এখানে কোথাও ছাতিম ফুটেছে।’

বাতাসের ঝাপটায় আমার নাকেও তখন ধাক্কা দিল একটা মৃদু অদেখা অচেনা সুবাস। আমরা দীর্ঘসময় দুজন মানুষ নীরবে অন্ধকার ফুটপাথে পাশাপাশি বসে সেই মিহি তীব্র সুগন্ধ আকণ্ঠ গিললাম। মাখলাম সারা গায়ে আর মনে। এভাবে সেজানই আমাকে শেখাল কিভাবে আমের মুকুলের গন্ধে বিভোর হতে হয়, কিভাবে ঘাসের মধ্যে ফুটে থাকা ফিকে হলুদ রঙের প্রিমরোজের ওপর সোনালি ডানার প্রজাপতি দেখে মুগ্ধ হতে হয়। আজমের তৈরি করা রক্তাক্ত ক্ষতগুলোর ওপর মমতার প্রলেপ দিয়ে সেজান আমাকে জীবনে ফিরিয়ে আনল। মাঝপথে ছেড়ে দেওয়া এমবিএটা শেষ করলাম। ভালো মাল্টি ন্যাশনালে চাকরি হলো। তিন বছর হলো আমরা বিয়ে করেছি। আমাকে থিতু হতে দেখে আমার বাবা মা খুশি মনে কানাডায় বড় ভাইয়ার কাছে চলে গেছে।

বিয়ের আগে রংপুরে সেজানের মায়ের সঙ্গেও দেখা করেছিলাম আমি। হাসতে হাসতেই বলেছি, ‘আমি কিন্তু বয়সে আপনার ছেলের চাইতে এগারো বছরের বড়। এই বিয়েতে আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?’

উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দৃঢ় ভঙ্গিতে বলেছিলেন, ‘সেজানের আপত্তি না থাকলে আমার কেন থাকবে? ও খুশি থাকলেই আমি খুশি।’

সেজানের বড় ভাইবোন, ভাবি দুলাভাইরা প্রথম প্রথম একটু আধটু নাক সিটকে ছিল। ছেলেটার জীবনটা শেষ হয়ে গেল- টাইপের হা-হুতাশও করেছিল শুনেছি। কিন্তু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আমরা দিব্যি আছি। সুখেই আছি। তিন বছরে দুটো অ্যালবাম বেরিয়েছে সেজানের। সুখ্যাতিও হয়েছে। কিন্তু মাস কয়েক ধরে টের পাচ্ছি কেমন একটা অদ্ভুত বিষণœতায় ভুগছে সেজান। বিশেষ করে যখন থেকে ওপেন এয়ারে আর আউটডোরে গান গাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো, আমরা আটকে গেলাম চার দেয়ালের ভেতর। তখন থেকেই দেখছি কেমন যেন চুপসে গেছে ও। নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছে নীরবতার একটা শক্ত খোলসের ভেতর। যেন অজানা ভয়ে ভীত, জড়োসড়ো। ফোন বাজলেও চমকে উঠে। রান্নাঘরে বাসন কোসনের শব্দেও দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে। সংবাদপত্র তো পড়েই না, ইদানীং টেলিভিশনও দেখে না। আগে খুব গান শুনত, এখন তাতেও যেন আগ্রহ নেই। সারাক্ষণ কেমন গম্ভীর হয়ে মন খারাপ করে শুয়ে বসে থাকে। যেন নিজের ভেতর নিজেই ডুবে আছে। ওকে উজ্জীবিত করতে, ওর হতাশা কাটাতে নানা ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি আমি।

‘হেই সেজান, তুমি নিজেই তো বলতে ভালো থাকা, আনন্দে থাকা একটা অভ্যাস। ভুলে গেছ সেসব? চলো তো গান শুনি, মুভি দেখি!’

‘কতদিন হয়ে গেল আমার ভেতর গান আসছে না, মেহের, সুর আসছে না, নিজেকে এত শূন্য মনে হয়, এত ফাঁপা আর ফাঁকা লাগে, কি বলব, কোনো কিছুতে মনযোগ দিতে পারি না, কোথাও যেন একটা সুতা ছিঁড়ে গেছে, সেটা আর জোড়া লাগবে না ... মনটা বোধ হয় মরে গেছে...’ 

সেজানের কণ্ঠে কেমন অস্বাভাবিক এক বিষাদ ও বিপন্নতা খেলা করে।

‘ঠিক হয়ে যাবে।’ সান্ত্বনা দিতে শুকনো গলায় বলি আমি।

উত্তর না দিয়ে সাদা চোখে নির্বাক তাকিয়ে থাকে ‘ও’। মাঝে মাঝে গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি সেজান আমার পাশে কাঠের পুতুলের মতো শক্ত হয়ে বসে আছে।       

‘জান, ঘুমের ভেতর আধো অন্ধকারে কেমন যেন তলিয়ে যাওয়ার অনুভূতি হয় আমার, মনে হয় যেন ঘোলা পানিতে কেউ ঠেসে ধরে আছে! হাঁসফাঁস করছি কিন্তু উঠতে পারছি না। প্রচ- সাফোকেশন হচ্ছে...’

সেজান নিচু স্বরে বিড়বিড় করে বলে।

‘ওহ! দুঃস্বপ্ন দেখেছ তাহলে!’

‘নাহ! শুধু ঘুমে না, জেগে থাকলেও এরকম মনে হয় ... মনে হয় কেউ তার অজস্র চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখছে, কি করছি না করছি, কি ভাবছি না ভাবছি, সারক্ষণ যেন তার নজরদারির মধ্যে বন্দী হয়ে আছি। কোথাও পালাবার জায়গা নেই। কোথাও লুকানোর সুযোগ নেই। কেউ যেন ওতপেতে বসে আছে, আমাকে ধরার জন্য।’

সেজানের থেমে থেমে বলা এসব কথাবার্তা কেমন যেন গোলমেলে শোনায় আমার কাছে। হতে পারে বদলে যাওয়া পরিস্থিতিটা মেনে নিতে পারছে না ও। আমি দুহাতে শক্ত করে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘ওহ সোনা, কেউ তাকিয়ে নেই। দেখো সব ঠিক আছে। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘নাহ ঠিক নেই। ঠিক হবে না। এই অন্ধকার কখনোই যাবে না। চারদিকে মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছ না তুমি?’

জেদী বালকের মতো বলে সেজান। আমার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে অস্থির ভঙ্গিতে সারা রাত ঘরজুড়ে পাঁয়চারি করে ও। আমি এই সেজানকে চিনতে পারি না। কেমন একটা অদ্ভুত শঙ্কায় দুলে ওঠে মন। রাতের পর রাত এরকম হতে থাকলে আমার বন্ধু ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তাসলিমার সঙ্গে একদিন বিষয়টা নিয়ে আলাপ করি।

‘হুম! মনে হচ্ছে ডিপ্রেশন বা এংজাইটি ডিজঅর্ডার। ওর কথাগুলো শোনো আর ওকে কষ্ট দিয়ে কোনো কথা বলো না।’ তাসলিমা বলে। ‘এই সময় ওর ঘুমটা খুব জরুরি। আমি ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি। চিন্তা কর না।’

তাসলিমার দেওয়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে সেজান লম্বা সময় ধরে, শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকে। আমি ওর শিয়রে বসে অপেক্ষা করি একটা সুন্দর উজ্জ্বল দিনের জন্য। যখন বাতাস থেকে মৃত্যু গন্ধ মুছে যাবে, ছাতিমের মিহি তীব্র সুগন্ধে বাতাস আবার আকুল হবে। আকাশে ভাসবে সেজানের কণ্ঠের উদাত্ত গান-

‘শোনো মনের কথা, যে কথা ঘুমিয়ে আছে মনে

শূন্য পাখি শূন্য বন, ফিরে আসার নামই জীবন

কতটা হেঁটেছিলে, কতটা ভেসেছিলে,

ভুলে গিয়েছিলে পথ, অন্ধকারে দেখো নাই গলি

তবু বুকের ভেতর ছিল ফিরে আসার পণ

শোনো মনের কথা, ফিরে আসার নামই জীবন।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর