শুক্রবার, ১৩ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

অলৌকিক ভ্রমণ

প্রশান্ত ভৌমিক

অলৌকিক ভ্রমণ

শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দিনের প্রথম ট্রেন যখন হাসনাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, তখনো চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দিনের আলো ফোটার তখনো অনেক দেরি। স্বাভাবিকভাবেই ট্রেনে খুব বেশি যাত্রী হবার কোনো সুযোগ নেই? গুটিকয়েক লোক ট্রেনে উঠেছিল। পুরো ফাঁকা ট্রেনে একেকটা সিট দখল করে শুয়ে পড়েছিল অনেকেই। ধীরে ধীরে একেকটি স্টেশন পার হচ্ছিল। কিছু লোক উঠছিল, কেউ নামছিল। দমদমের পরের স্টেশন দমদম ক্যান্টনমেন্ট। দমদম ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রথম দিকের লেডিস কামরায় উঠে পড়ল রাহুল। ওর এই এক স্বভাব, একাকী ট্রেনের কামরায় চড়া। দিনের বেলায় কলকাতার ভিড় ট্রেনে সেটা একেবারেই সম্ভব না বলে সে প্রায়দিনই ভোররাতের এই ট্রেনের লেডিস কামরা বেছে নেয়। এই ট্রেন যখন হাসনাবাদে পৌঁছে, তখনও সূর্যের আলো ফোটার সময় হয় না। বিশ মিনিট পর এই ট্রেন যখন আবার ডাউনে শিয়ালদহের দিকে এগোতে থাকে, তখন পেছন দিকের লেডিসের একমাত্র যাত্রী থাকে রাহুল।

দমদম ক্যান্টনমেন্ট পার হবার পরের স্টেশন দুর্গানগর। এই ট্রেন গ্যালোপিং বলে দুর্গানগরে দাঁড়ায় না। দাঁড়ালো বিরাটিতে। রাহুল এতটা পাত্তা দিল না। এই সময়ে আপ ট্রেনে কোনো যাত্রী হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। বিরাটি স্টেশনের ডিজিটাল ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে ৩টা ৪৫। এসব দেখতে দেখতে রাহুলের চোখটা জুড়ে এল। ট্রেন চলছে তীব্র গতিতে। যে স্টেশনে থামার থামছে। আর যেই স্টেশনে থামার নয় সেটা পেরিয়ে যাচ্ছে দুরন্ত গতিতে।

রাহুল ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন জেগে উঠল তখনো বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন। এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। রাহুল উঠে ট্রেনের গেটের কাছে গেল। বারাসাত স্টেশনে আছে ট্রেন, ডিজিটাল ঘড়িতে বাজে ৪টা ৭ মিনিট। কিছুক্ষণ স্টেশনের পরিবেশ দেখল রাহুল। সারাদিনের কর্মব্যস্ত এই স্টেশনটিকে এই ভোররাতে যেন চেনাই যাচ্ছে না। কী নিঝুম! এক অপার্থিব পরিবেশ। চার নাম্বার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ট্রেনের সামনেই দেখা যাচ্ছে চায়ের দোকানটি। এই দোকানে সবসময় ভিড় জমে থাকে। কী যেন জাদু আছে বয়স্ক লোকটির চায়ে। কিন্তু এই মুহূর্তে ছোট্ট দোকানের আশেপাশেও কেউ নেই। সাত-পাঁচ ভাবছে আর নীরবতা উপভোগ করছে রাহুল।

সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর পর এখন পর্যন্ত কোনো মানুষকে দেখেনি সে। হেঁটে এসেছে স্টেশন অব্দি। টিকিট কাটতে হয়নি। মান্থলি কেটে রেখেছিল। আসলে রাহুল ঘুরতে পছন্দ করে বলে ৫-৬ টা লাইনের মান্থলি টিকিট প্রতিমাসেই কেটে রাখে। এতে সুবিধা হলো অনেক কম খরচে ঘোরা যায়। আর পুরো ফাঁকা কামরায় এতটা পথ এসেছে। ফলে কোনো লোকের মুখোমুখি হতে হয়নি। রাহুল সবসময় মানুষের সান্নিধ্যে চাইতে একাকী থাকতেই পছন্দ করে। সবসময় যে পারে এমন নয়। তাও এদিক ওদিক একাকী ঘুরতে বেরোনো আর নিজের জগতে বই নিয়ে ডুবে থাকা, এই হলো রাহুল।

সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক হবার পরেও চেহারায় কেউ তাকে চেনে না। কোনো বইয়ের ফ্ল্যাপেও নিজের ছবি ছাপায় না। এর ফলে বইমেলায় নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারে। আজকালকার ক্রেতাদের সাথে কৃত্রিম হাসি মুখে ফুটিয়ে সেলফি তুলতে হয় না। রাহুল জানে ওকে চিনতে পারলে ওর ওপরেও হামলে পড়বে সেলফি শিকারিরা। এরা কেউ কোনোদিন কেনা বইটি বাড়ি নিয়ে উলটে দেখেছে বলেও ওর মনে হয় না। সেলফি তোলা আর অটোগ্রাফ নেয়ার মধ্যেই ওদের আগ্রহ শেষ। কিছু টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করা বইটির ছবি স্যোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করার পরেই আগ্রহ শেষ হয়ে যায় তাদের। যতদিন এই পোস্টের লাইক গোণে তারা, ততদিনে এই বইয়ের জায়গা হয়ে যায় পুরনো বইয়ের দোকানে। কিংবা অতি শোখিনদের বইয়ের তাকে। এই যখন অবস্থা, তখন রাহুলকে কেউ লেখক হিসেবে চেনেই না।

দুই.

হুইসল বাজিয়ে ট্রেন আবার চলতে আরম্ভ করতেই রাহুল সিটে গিয়ে বসল। বসে বাইরের দিকে তাকাতে গেল, দেখল দুই সিট আগে কেউ একজন বসে আছে। রাহুলের কেমন যেন লেগে উঠল। ভূত নাকি! কখন উঠল ট্রেনে? মহিলা কামরা যেহেতু, পুরুষ ওঠার সম্ভাবনা নেই। অত ভোরে মহিলা এল কোথা থেকে? একবার ভাবল গিয়ে জিজ্ঞেস করবে। পরক্ষণে সেই ভাবনা মাথা থেকে তাড়িয়ে দিল। এই ভোররাতে মহিলাটি যদি উলটো তাকে প্রশ্ন করে লেডিস ট্রেনে কোন মতলবে উঠেছে, জবাব দিতে পারবে না। এর চেয়ে এই ভালো চুপচাপ বসে থাকা। পরের স্টেশনে নেমে ফাঁকা দেখে কোনো কামরায় উঠে পড়লেই হবে।

পরের স্টেশন কাজীপাড়া আসতেই রাহুল উঠে পড়ল সিট থেকে। ট্রেন পুরোপুরি থামার অপেক্ষায় দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে এখনো অন্ধকার। স্টেশনের কয়েকটা আলো ছাড়া অন্য কোনো আলোর আভাস নেই। বরং চারপাশে ঝিঝি ডাকার একটা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। রাহুল ট্রেন থেকে মাত্র পা বাড়াবে এমন সময় পেছন থেকে মেয়ে কণ্ঠে ডাক শুনল-শুনছ।

রাহুল থমকে দাঁড়াল। কেন ডাকছে তাকে? পরিচিত কেউ কি? পরক্ষণেই ভাবল, আত্মীয়-স্বজনের বাইরে তেমন কোনো মেয়েকেই চেনে না সে। পড়েছে বয়েজ স্কুলে। কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে যেতে যেতে সে নিজের মধ্যেই গুটিয়ে গিয়েছিল। তাই কোনো মেয়ের সাথে সখ্যতা হয়নি।

এখন এই অপার্থিব একটা সময়ে মেয়েটির ডাক শুনে রাহুল ফিরে তাকাল। সপ্রশ্ন দৃষ্টি উপেক্ষা করে মেয়েটি ধীর পায়ে এসে দাঁড়াল ওর সামনে। স্বাভাবিক অথচ কিছুটা শ্লেষ মেশানো গলায় প্রশ্ন করল-আমাকে ফেলে কোথায় যাচ্ছেন?

রাহুল ভিতরে ভিতরে ভয় পেতে লাগল। এটা কোনো চাল নয়ত! হয়ত ছিনতাইকারীর দল এখনই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেবে। কিন্তু নেয়ার মত ওর কাছে কিছুই নেই। সামান্য কিছু টাকা আর ছোট একটা মোবাইল। এসব নিয়ে তো ওদের টিকিটের টাকাই উঠবে না। দ্রুত রাহুলের মাথার ভেতর এসব কথা খেলে যাচ্ছিল। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল-আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।

মেয়েটি খুব স্বাভাবিক গলায় বলল-আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? চুপচাপ এসে সিটে বসুন। কোনো ভয় নেই আপনার। এই কামরায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই।

রাহুলের ভয় এবার আরো বেড়ে গেল। ও যে ভয় পাচ্ছে সেটা বুঝল কি করে এই মেয়ে? কখনো জীবনে এই ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েনি রাহুল। আর যাচ্ছে অজপাড়াগাঁয়ের দিকে। সকাল সাড়ে চারটার সময় সেখানে সাহায্যের জন্য বললে কেউ এগিয়ে আসবে না। তাছাড়া ফোন করে সাহায্য চাইবার মত পরিচিত ওর তেমন কেউ নেই-ও। তাই চুপচাপ বসে মেয়েটির কথা শুনে থাকা ছাড়া আর ওর করার কিছু রইল না। এরপর পরিস্থিতি অনুযায়ী যা প্রয়োজন তা করা যাবে। মেয়েটি বলল-ভয় পাবার কি আছে আপনার। আমাকে একা রেখে বেশ তো ট্রেন থেকে নেমে যাচ্ছিলেন। তখন মনে ছিল না আমি একা ভয় পেতে পারি।

রাহুল এবার সাহস করে মুখ খুলল- আমি তো আপনাকে চিনি না। তাহলে আমি নেমে যাওয়ার কিংবা থাকার সাথে তোমার কি সম্পর্ক?

মেয়েটি কথার পিঠে কথা চালাল- আপনি কি আমাকে চিনতে পারছেন না? নাকি চিনেও না চেনার ভান করছেন?

রাহুল দ্বিধায় পড়ে গেল। লোকজনের বাড়ির ঠিকানা, নাম কিংবা ফোন নাম্বার ভুলে যাবার বদভ্যাস তার আছে। কিন্তু কারো চেহারা দেখার পর খুব সহজে তো তাকে ভোলে না সে। কিন্তু এই মেয়েটির কথা কিছুতেই সে মনে করতে পারছে না। বিশ-একুশ বছর বয়স, ফর্সাই বলা চলে। এরকম চেহারার কাউকে দেখলে তো মনে থাকাই স্বাভাবিক। রাহুল তাও মনে করতে পারছে না। মেয়েটি এবার আস্তে আস্তে বলল-আমি অনামী।

তিন.

রাহুল তাও মনে করতে পারছে না। অনামী কি মেয়েটির নাম? নাকি কোনো নাম নেই বলে অনামী। রাহুলের মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে লাগল। জিজ্ঞেস করল- আপনি আমার কাছে কি চান?

অনামী এবার হেসে দিল। বলল-আপনার পকেটে পঞ্চাশ টাকার বেশি কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে না। আপনার কাছে কি চাইতে পারি, বলেন?

রাহুল মনে মনে ভাবতে লাগল, এই মেয়েটা কি অন্তর্যামী নাকি? নেহাত ভূত বিশ্বাস করে না, নইলে এই অসময়ে একা একটা মেয়েকে এখানে দেখে ভড়কে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু মেয়েটার ভিতর কোনো একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার রয়েছে, যেটা কোনোভাবেই রাহুল বুঝে উঠতে পারছে না। ট্রেন এগোচ্ছে স্বাভাবিক গতিতে। কয়েকটা স্টেশন পার হলো। রাহুল কিছু বলছে না। মেয়েটা মাঝে মাঝে কিছু বলছে, রাহুল পাত্তা দিচ্ছে না। একসময় মেয়েটা রাহুলকে টেনে নিয়ে সিটে বসাল। বসিরহাট স্টেশনে ঢুকে ট্রেনটা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। রাহুলের কিছুটা অস্বস্তি লাগছিল। মেয়েটা কে, কেন তাকে এভাবে ডাকল কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। ৪-৫ মিনিট পর দুজন পুলিশ উঠে এল কামরায়। রাহুলের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল- আপনি লেডিস কামরায় কেন? টিকিট দেখান।

রাহুল টিকিট বের করে দেখাল। এই কামরায় ওঠার ব্যাপারে কোনো কৈফিয়ত দেয়ার আগেই মেয়েটি বলে উঠল- আসলে আমি একা ভয় পাচ্ছিলাম লেডিসে উঠতে। তাই ভাবলাম ও আসুক আমার সাথে। কেউ তো নেই আর।

পুলিশ দুজনের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল-আপনারা কি হাজব্যান্ড-ওয়াইফ?

রাহুল কিছু একটা বলবে ভেবেই মেয়েটি ওর হাত চেপে ধরল পুলিশের অলক্ষে। তারপর নিজেই বলল- হ্যাঁ, দাদা।

অন্য পুলিশ এবার জানালেন, ওদের কাছে খবর আছে এই ট্রেনে করে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য বাংলাদেশে পাচার হবে টাকি দিয়ে। তাই তারা প্রত্যেক কামরা সার্চ করছেন। সাবধানে থাকতে বলে তারা নেমে গেলেন।

রাহুল এবার সরাসরি মেয়েটিকে প্রশ্ন করল- আপনার উদ্দেশ্য টা কি বলুন তো? কথা নেই বার্তা নেই আপনি বলে দিলেন আমরা হাজব্যান্ড-ওয়াইফ। ফাজলামো পেয়েছেন নাকি।

হাসি দিয়ে বলল- আচ্ছা আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? শোনেন নি পুলিশরা কি বলে গেল? সাবধানে থাকতে। সেটাই থাকুন না। এত অস্থির হচ্ছেন কেন?

রাহুল এবার একটু জোরের সঙ্গেই বলল- আমার তো মনে হয় আপনি নিজেই ওই মাদক পাচারকারী দলের সদস্য। না হলে হঠাৎ এই ট্রেনে এলেন কোথা থেকে, আর আমার সাথে এমন আচরণই বা করছেন কেন?

মেয়েটি খুব স্বাভাবিকভাবে বলল- আপনি শুধু শুধু টেনশন করছেন। আমার কাছে কিছু নেই। আর পুলিশের কাছে ঠিকঠাক কোনো খবর নেই। মাদক পাচার তো টাকি দিয়ে হয় না। টাকি দিয়ে গরু পাচার হয়। মাদক তো পাচার হয় বশিরহাট দিয়ে। আমরাই পুলিশের কাছে টাকির নাম পাঠিয়েছিলাম। এতক্ষণে নিশ্চয়ই বর্ডারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ওরা।

রাহুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল-কারা?

মেয়েটি বলল-কেন? ট্রেন স্টেশনে থামার সাথে সাথেই দেখেননি ভেন্ডার থেকে দুজন লাফিয়ে লাইনে নেমে উল্টোদিকে চলে গেল? ওহ! আপনি দেখবেন কিভাবে? আপনি তো এদিক ফিরে বসেছেন। আমি দেখেছি পুরোটাই। ওরা আমার লোক। আর আমি এখানে আপনাকে ধরে রেখেছি পুলিশের সন্দেহ থেকে বাঁচার জন্য। আপনার ভয় নেই। হাসনাবাদ নেমেই আপনি আপনার মত, আমি আমার মত।

রাহুল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মেয়েটির দিকে। ওর মাথায় যেন আর কোনো কিছুই কাজ করছিল না। ট্রেন ততক্ষণে টাকি রোড স্টেশনে এসে ঢুকল। পুলিশ গিজগিজ করছে চারদিকে। একজন পুলিশ উঠে এলেন কামরায়। রাহুলকে জিজ্ঞেস করলেন-কী মশাই, কোথায় যাওয়া হচ্ছে?

রাহুল শান্ত স্বরে বলল- জানি না। এই অলৌকিক ভ্রমণ কোথায় শেষ হবে!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর