শুক্রবার, ২০ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

হ্যাংওভার

হুসেইন ফজলুল বারী

হ্যাংওভার

মাথার ভিতরটা কী থকথকে হয়ে গেছে। আমার সারা শরীর আর হাতপা যেন এখন শুকনো বালির স্তূপ। আমি কি অনুভূতিহীন জড় পদার্থ? চোখের পাতা এত ভারী হয়? কোনো ঘ্রাণও তো পাচ্ছি না। মাথার স্নায়ুজালিকা একদম ছিঁড়ে গেছে। আমি এখন কোথায়! শিরদাঁড়া বেয়ে ফিনফিন করে আবার রক্তের ধারা বইতে শুরু করেছে। মাথা শিরশির করছে। এখন কয়টা বাজে? এই তো, মনে পড়ছে, আমার তো এখুনি স্কুলে যাবার কথা-তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া ছেলেকে আনতে। বাসায় এসে ক্ষুধার্ত পুত্র মোবাইল দেখতে দেখতে টিফিন খাবে। আচ্ছা, আমার ছেলের নাম যেন কি? আমার কি আর কেউ আছে? স্ত্রী? মেয়ে? খুব যে শীত শীত লাগছে। স্নায়ুতন্ত্রে কে যেন হেঁচকা টান দেয়। সারা পৃথিবী দুলছে। এখন বুঝি ভূমিকম্প হচ্ছে? মনে পড়ছে, মেঘনা ট্রেনে চড়ে আমার লাকসাম যাবার কথা। বৃদ্ধ বাবা-মা’কে কতদিন দেখি না। হলদে রঙের এক জোড়া শোভন টিকিটও তো ছিল বুকপকেটে। আর কে যেন সঙ্গে যাবে? বড়পা! মা কী এখন হামানদিস্তা সামনে নিয়ে আমার প্রতীক্ষায়। আমার মাথায় কে বুঝি হাতুড়িপেটা করেছে। রক্ত কি জমাটও বেঁধে যাচ্ছে? অই যে সবুজ শাড়িপরা তরুণী মা গুনগুন করে পায়ের পাতায় আলতা আঁকছেন। হায়, আমি তো এখন দীঘির জলে তলিয়ে যাওয়া শিশু। এক ফোঁটা বাতাস কোথায় পাই? পাগলপারা হয়ে মা আমাকে পুকুর থেকে টেনে তুলছেন।

এই তো নানাবাড়ির পুকুরঘাট। এর লাগোয়া সুপারি গাছের সারি। এদের গায়ে দুষ্ট কাঁঠবিড়ালি দৌঁড়ে দৌঁড়ে বেড়ায়। বাতাসের ঝাপটায় সুপারির ডাল ভেঙে পড়ে। মেহেদিরঙা শশ্রুময় নানাভাই এখনও দৌহিত্রকে শাদা খোলে চড়িয়ে চলেছেন বাংলোঘরের কোনায়। নানীজান স্বামীপ্রবরের আদিখ্যতা দেখে হেসেই খুন। সেদিকে কিশোরী মেয়েরা হরতকির বিচি দিয়ে কি যেন খেলে আর খিলখিল হাসে। আমি আরেকটু বেড়ে উঠি। শিমুলতলায় গিয়ে ধুলোমাখা-ছেলেদের সাথে বউচি খেলি, ঝগড়া করি, আড়ি দেই। আবার মিতালি পেতে সবাই একসাথে আমভর্তা বানাই। আমে বেশ পোকা হয়েছে এ বছর। একটা ছেলে খুজলি চুলকিয়ে বলল, এই বোকা, আমের পোকা খাইলে সাঁতার শিখতে পারবি! এ কথা শুনেই আমার গা ঘিন ঘিন করে। তবু পোকা এড়িয়ে গোগ্রাসে শর্ষে-মাখা আম খেয়ে সেগুনের কচি পাতায় হাত রাঙাই। একটু পরে বাড়ি ফিরে দেখি, পাকশালে বসে কাকবন্ধ্যা আইবুড়ো ঝি ডালে ফোঁড়ন দেয়। মাছ ভাজে। ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দ হয়। উঠোনের কোণ ঘেঁষে একটা ধূসর বিড়াল লঘুপায়ে হাঁটে। পাশের ঘরে ঢেঁকিপাড়ের অবিরল শব্দ শুনি। ঢেঁকির লেজে দাঁড়িয়ে দীর্ঘাঙ্গী ঝি শরবতি বেগম ছন্দময় পাড় দেয়। তার কাঁচা হলুদ কপাল বেয়ে দরদরিয়ে ঘাম ঝরে। ঢেঁকি আনন্দে নেচে নেচে ওঠে মাথা কুটে। সুগন্ধি চালে হামলে হামলে শান্ত হয়। আবার কাঠের দৈত্যটি শীর্ষ উঁচু করে সোজা হয়ে ঢেউয়ের মতো নতজানু হয় চালের খুদে। এমনি করে চালের গুড়ি হয়। কেউ একজন চালনি দিয়ে গুড়ি চেলে মাটির গামলায় রাখে। এক ধূর্ত গোমস্তা হ্যাজাক লাইট জ্বালিয়ে ধান কাটা শ্রমিকদের কাজে লাগিয়ে দেয়। রাতের এক প্রহরেই এরা ভরপেট খেয়ে বাইরের ঘরে অঘোরে ঘুমায়। মায়ের কাছে কিসসা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি আমিও।

পরদিন ভোরে উঠে মায়ের সাথে বিশাল বাগানে ঘুরি। আমার নানাজানের গাছ-গাছালির শখ। মামাদের মাঝেও এই বৃক্ষপ্রেম সংক্রমিত হয়েছে। বাড়ির লাগোয়া কয়েক বিঘা উঁচু জমিতে এই বাগান। এখানে ফলদ, বনজ আর ঔষধি গাছের সমাহার। প্রথমেই একটা বকুল গাছ। তারপর কয়েকটা জামরুল আর গোলাপজামের ছিপছিপে গাছ। এর কান্ডে লালচে বড় পিঁপড়ে দলবেঁধে হাঁটে। কামরাঙা গাছে কি সুন্দর নরম-সবুজ রঙের থোকা থোকা ফল ধরে আছে। কয়েকটা টিয়ে পাখি লাল ঠোঁটে কামড়ে কামড়ে আরামসে শব্দ করে কামরাঙা খায়। কামরাঙা খেলে নাকি জ্বর হয়। তাই এত সুন্দর ফলটা আমার খাওয়া বারণ। পথের পাশে পড়ে আছে বেশ কয়েকটা আধ-খাওয়া লেপটে যাওয়া সোনারঙা নরম ফল। ঠিক যেন মানুষের পুরীষ! দেখেই গা গুলিয়ে উঠে। মা বলল, এগুলো ডেউয়া। গাঢ় খয়েরি রঙের বাদুরের মল গাছের পাতায় পাতায় আর মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। লিচু গাছের উঁচু ডালে বাদুর পা ঝুলিয়ে ঘুমায়।  সামনেই অতিপ্রজ কাঁঠাল গাছগুলিতে অজস্র ছোট ছোট মুচি জেগেছে।

গতরাতে প্রচুর ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। তাই বাগানময় বিক্ষিপ্ত পাতা, বিধ্বস্ত পাপড়ি, ভাঙা ডালের সমারোহ। অদূরেই একটা শালিক ছানা এক কাতে পড়ে আছে। মা হাহাকার নিয়ে কাদা-পাতা সরিয়ে একে ধরে বললেন, আহারে, মরে গেছে। বেদনাহত মায়ের শোক  আমার খুদে বুকও ছুঁয়ে যায়। আমি প্রশ্ন করি, মৃত ছানাটির মা কি কাঁদবে? মা সস্নেহে হেসে বলেন, কাঁদবে না? এতক্ষণে মা পাখি কেঁদে কেঁদে হয়রান হয়ে গেছে। এদিকটায় কাঁচাপাকা জামে মাটি সয়লাব। বাছাই করে কয়েকটা জাম হাতে নিই। হাতের তালুতে লালচে দাগ লাগে। পুকুর-লাগোয়া জাম গাছে রাশিরাশি কাঁচা-পাকা ফল। পাখিরা হুটোপুটি করে পাকা জাম খায়। পুচ করে বিষ্টা পুকুরের জলে পড়লে উপরে তাকিয়ে দেখি-এক পাল ছোঁচা পাখির ঝগড়া বেঁধেছে। মা বললেন, এরা রাম শালিক। খুব পেটুক। আমার খুদে মাথায় প্রশ্ন জাগে, আচ্ছা, এসব পাখিদের কি পেট খারাপ হয়? ওদের চিকিৎসকই বা কে? আমার প্রশ্নে মা হেসে কুটিকুটি হন।

একটু এগোলে সফেদা গাছটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। একটা মাকালের লতা বৃক্ষটিকে গভীর আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে চলে গেছে আমের বনে। বিলেতি গাব গাছ পেরিয়ে সারবন্দি আম গাছ। আম গাছের ডালে একটা কালো ফিঙে পাখি। মা একটা গাছের দিকে ইঙ্গিত করে  বললেন-দেখ, কি সুন্দর গাছ, কিন্তু শুধু এই গাছের আম পাকলে টক আর অন্য সব গাছের ফল মিষ্টি। আমি বললাম, কেন? তিনি ঊর্ধ্বাকাশে ইঙ্গিত করে হাসেন, বৃক্ষ তোমার নাম কি, ফলে পরিচয়।  কাঁচা-পাকা পাতার রাশ পুরো বাগানজুড়ে। দুয়েকটা শুকনো পাতা হাওয়ায় নাচে। দখিনপাড়ে পেলব ঢেঁকিশাকের পাতা দোলে। নিজ হাতে রোপিত নিঃসঙ্গ অর্জুন বৃক্ষের গায়ে আঙুল ছুঁয়ে মন খারাপ করে মা বললেন, ঔষধি গাছ বলে সবাই গাছটাকে ক্ষতবিক্ষত করে ছালবাকল নিয়ে যায়। আমি প্রশ্ন করি, গাছের ব্যথা লাগে না। গাছের কি মা আছে। আমিও মায়ের কোলে চড়ে আহত গাছটিকে স্পর্শ করি। একটা ছাল-উঠা কুকুর এসে আমাদের সামনে ঘুরঘুর করে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। তেঁতুলতলা পেরিয়ে সামনে কয়েকটা সুপারি গাছের সারি। এরপর এক জোড়া তাল গাছ। এদের মাথা বুঝি আকাশ ছোঁবে!  

আচমকা জলজ আঁশটে গন্ধ এসে নাকে লাগে। সামনেই বিশাল ছাতার মতো বটগাছটা পগারের দিকে অবনত হয়ে আছে। এখন জল নিস্তরঙ্গ, তবে এখন জল কালচে রুপালি। কুয়োর মাছেরা চুপটি করে ঘুমোয়। পুকুরের পাড়ের বনকলমির প্লাবন শেষে বেশ প্রাণময় সবুজ লতাপাতা-গুল্ম ছাপিয়ে স্বর্ণলতার জ্বলজ্বল বিস্তার। মা স্বর্ণলতা ছিড়ে আমার হাতে কাঁকন পরিয়ে দেন। আমি কি যেন বলতে যাচ্ছিলাম, মা মুখে তর্জনী এঁটে নীরবতার ইঙ্গিত করেন। অবাক হয়ে দেখি, এক গুল্মের পাতার ঘরে এক টুনটুনি দম্পতি একদম চুপচাপ বসে আছে। সম্ভবত ডিমে তা দিচ্ছে। ঝুপ করে একটা কদমফুল ঝরে পড়ল সেঁতসেঁতে কালো মাটিতে। এদিকের শীতল ভূমিতে আধ-পচা কদমফুল, ফুলের রোয়ার বিস্তৃত ফরাস। মাঝে মঝে পাকা বটের প্রচ্ছদ। এতো অপূর্ব বর্ণাঢ্য মখমল ভূমিপৃষ্ঠে কে বোনে? কেমন যেন মিষ্টি-বুনো সুবাস বাগানের এ দিকটায়। পথের উপর শুয়ে থাকা শিমুল ফুল আমার পায়ের নিচে থেঁতলে গেল। কেমন যেন লাগে, তবু আনন্দে কেঁপে কেঁপে উঠি। কড়ই ফুলের শীর্ণ পাপড়ি উড়ে উড়ে আমার ন্যাড়া মাথা ছুঁয়ে যায়, ঘাড়ে লাগে। শিরদাঁড়ায় শিহরণ খেলে আমার গায়ের রোম কাঁটা দেয়। ছায়াঘন স্নিগ্ধতায় মা আমার ডান হাতের তর্জনী ধরে সামনে এগোন। এদিকে শীতল মাটির কোলজুড়ে বাসি পল্লবের অপরিমিত সমারোহ। আর মাঝে মাঝে ম্রিয়মান ফুলের পাপড়ির আলপনা। এই মায়াপুরির স্তব্দ মগ্নতায় বিভোর হয়ে এঁকেবেঁকে পা ফেলে আমরা মা-পুত্র একসাথে হাঁটি।

বর্ষীয়ান সারমেয়টি হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে দিগন্ত কাঁপিয়ে ঘেউ ঘেউ আওয়াজ তুলে সামনে এগোল। বটের ডালে ঝুলে থাকা ময়নার পাল পাখোয়াজের উঁচু ুলয়ের সুর তুলে কৌণিক-উড়াল দিলো। সমস্ত বাগানজুড়ে শংকামুখর পাখিদের কাকলির উচ্চ রব উঠল। জাম গাছ লাগোয়া বাঁশবন থেকে শাদা শাদা বকপাখি বিসদৃশভাবে ডেকে উঠল। দূর থেকে আরেকটা কুকুর প্রতিস্বর তুলল, ঘেউ, ঘেউ, ঘেউ। এক জোড়া ত্রস্ত ছুঁচো কোথাও যেন পালিয়ে লুকাল। এক জোড়া দিব্যান্ধ চামচিকে উড়ে গিয়ে গাছের ডালে বাড়ি খেয়ে আবার উড়ে গেল ভাঙা পাঁচিলের দিকে। পাঁচিলের গায়ে কয়েকটা জীবন্ত শামুক। মা আঙুল দিয়ে ইঙ্গিত করে বললেন, অই, দেখ, দেখ, কুকুর দেখে বেজি চোরের মত পালাচ্ছে-এ দিকটায়। সম্ভবত সাপে-নেউলে যুদ্ধ বেঁধেছিল আশেপাশে কোথাও। কিন্তু আমি কিচ্ছু দেখতে পাই না। কয়েকটা আতংকিত দাঁড়কাক উড়ে উড়ে অবিরাম কাঁদছে-কা, কা। একটা মোটা গুইসাপ ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে আনারস বাগান পার হয়ে ঝুপ করে নালায় পড়ল। ঘোলা পানি ছিটকে পড়ল কচু গাছের গায়ে।

কিন্তু আমার মা কই? কাকগুলিই বা কই? বাগানের সবুজ গাছ? উপরে তাকিয়ে দেখি, বুড়ো আমগাছের চাদোয়া আলো-আঁধারির হেঁয়ালি আঁকছে। আমার মাথার স্নায়ু কি জাগতে শুরু করেছে? জমাট বাঁধা রক্তনালী আবার ক্ষীণতোয়া হয়ে বইছে! কই, আমার গায়ে যে শাদা কাফন। আমি শুয়ে আছি শীতল ভূমিশয্যায়। মাটির ঘ্রাণ তো একদম চেনা। বাড়িতে কখন এলাম? ট্রেন বোধ হয় লেট করেছিল। আমার মুখও তো খোলা। একরাশ ঝিরঝিরে নীল আলোর রেখা এসে আমার মুখ ছুঁয়ে যায়। চোখে চুলকানির মতো লাগে। মাথা একদম ঝিম হয়ে আছে। কিছু মানুষের মৃদু শোরগোল শুনে দেখি, উপরে শাদা শাদা টুপির মেলা বসেছে। বাবা কোথায়? দুপদাপ শব্দও যে হচ্ছে। কয়েক জন মিলে কবরের উপরে শেষ বাঁশের ছাওনি টেনে দিয়েছে। না, না, আমার যে এক্ষুণি উঠতে হবে। আমার ছেলে কি খাজা আজমেরি স্কুল থেকে ফিরেছে? ছোট মেয়েটা কি নাশতা করেছে? কি যেন তার নাম? ফাতেমা? ফাতেমা তো আমার মায়েরও নাম। আমি আসলে কোথায় যাচ্ছি? এটা মনে হয় কোনো অফিসিয়াল ট্যুর। টিএ/ডিএ হতে কিছু কি বাঁচবে। বড় মেয়েটার জন্য একটা নোটপ্যাড কিনতে হবে। ল্যাপটপের নীল ব্যাগটা কই। মানিব্যাগ। এই মাটির ঘরে কোত্থেকে যে বেলিফুলের সৌরভও ভেসে আসে। চেনা কারো সুবাসিত চুলের ঘ্রাণ। না, আমার গায়ে যে আতরের বিষাদমাখা গন্ধ। আমি কোনো দূর ভ্রমণে যাচ্ছি। বড় মেয়েটা কি আজ আয়াতুল কুরসি পড়ে ‘শুভযাত্রা’ বলে আমার কপালে আলতো চুমু দিয়েছিল। কারা যেন হুড়মুড় করে কবরের পিঠে আরও মাটি ঢেলে দিচ্ছে। মায়ার পৃথিবীতে এ যে আমার শেষ হ্যাংওভার-ঝুলনমায়া। কোত্থেকে যে এক ছন্দময় অনুনাদ ভেসে ভেসে আসে ডাকাতিয়ার ঢেউয়ের মত মাটি হতেই তোমার জন্ম, মাটিতেই তোমার বিনাশ আর মাটি হতেই তোমাকে উঠানো হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর