শুক্রবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

কেনিয়ার আল মাইউনগানি ও যুক্তরাষ্ট্রের হোমলেস মানুষ

মঈনুস সুলতান

কেনিয়ার আল মাইউনগানি ও যুক্তরাষ্ট্রের হোমলেস মানুষ

মি. নুর আল মাইউনগানি গাড়ি চালাতে চালাতে বারবার বাইফোকাল চশমা নাকের ডগায় নামিয়ে রোডম্যাপ দেখেন। রাত সাড়ে ৯টার মতো। আমরা ভার্জিনিয়ার ফলস চার্চ থেকে ওয়াশিংটন ডিসির সিটি সেন্টারে যাচ্ছি। কেনিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম মি. মাইউনগানি বেশ বছর কয়েক হলো যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। ইংরেজি বলেন তিনি চমৎকার, কোথাও কাজবাজ করে রুজি-রোজগারও করছেন বেশ ভালো। খুব ফিটফাট কোট-প্যান্ট-টাই পরে ভোরবেলা কফির থার্মাল মগ হাতে স্মার্টলি কাজে যান। উইকএন্ডে স্পোর্টস জ্যাকেটের পকেটে টাইয়ের রঙের সঙ্গে ম্যাচ করা রুমাল গুঁজে হাটবাজার করতে বেরোন।

একা থাকেন বলে মানুষটি বোধ করি একটু প্রতিবেশী রঞ্জক গোছের। কেনিয়ান কায়দায় পিনাট বাটারের ঘন কাথে বিস্তর রসুনের ফোড়ন দিয়ে চিকেন রান্না করলে আমাকে এক বাটি দিতে ভুলেন না। উইকএন্ডে আমি শপিংয়ের বিশেষ একটা সময় পাই না, হাটবাজারে মতি নেই বুঝতে পেরে মাঝেমাঝে অনুরোধে আমার জন্য জরুরি কিছু খাবারও তিনি গ্রোসারি শপ থেকে কিনে আনেন।

মি. মাইউনগানি মানুষটি ভালো হলেও যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিকতার হালহকিকত তেমন একটা বোঝেন বলে মনে হয় না। ঈদে-চান্দে তিনি মাথায় কারুকাজ করা তাজের সঙ্গে ‘বুবু’ বলে আজানুলম্বিত আলখাল্লা পরতে ভালোবাসেন। আমি ছাড়া আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের বাদবাকি সব প্রতিবেশীই পোলান্ড, রোমানিয়া কিংবা ইতালি থেকে আগত সব শ্বেতাঙ্গ ইমিগ্রেন্টস। অনেকেই ইংরেজি তেমন ভালো বলেন না। তো এক শবেবরাতের রাতে মি. মাইউনগানি কেনিয়ান কায়দায় হালুয়া-রুটি তৈরি করে তা প্রতিবেশীদের বিলানোর উদ্যোগ নেন।

তার পাশের অ্যাপার্টমেন্টে পোলিশ মহিলার লিভিংরুমের দুয়ার কী কারণে জানি খোলা ছিল। সন্ধেবেলা শ্বেতাঙ্গিনী নারী কাজ থেকে ফিরে সিল্কের রিল্যাক্স রৌব পরে কাউচে আধশোয়া হয়ে রেড-ওয়াইন পান করছেন। স্টিরিওতে বাজছে শোঁপার ক্লাসিক্যাল মিউজিক; আচমকা দুয়ারে- হালুয়ার বর্তনে মোমবাতি জ্বেলে দুধশাদা আলখেল্লা পরা মি. মাইউনগানি ছায়ামূর্তির মতো এসে দাঁড়ান। মহিলার হাত থেকে ঠন করে পড়ে যায় ওয়াইন গ্লাস। পোলিশ ভাষায় পরিত্রাহী চিৎকার করতে গিয়ে মহিলার তো নার্ভাস ব্রেক ডাউন হওয়ার উপক্রম! ভার্জিনিয়া থেকে ওয়াশিংটন ডিসিতে যাওয়া কঠিন না। রাত সাড়ে ৯টার দিকে এ দিকে ট্র্যফিকের জুট-ঝামেলাও কিছু থাকে না। মি. মাইউনগানি রোডম্যাপ দেখেও ড্রাইভ করতে করতে ভুল টার্ন নিলেন বলে আমি একটু বিরক্ত হই। তার গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে আটকানো জিপিএস, তা দিয়ে যে কোনো গন্তব্যে অত্যন্ত সহজে যাওয়া যায়। মি. মাইউনগানি বোধ করি জিপিএস ইউজ করতে জানেন না-তাই, থাকুমুকু করে ভুল শুধরে, সঠিক সড়কে উঠে আসার চেষ্টা করেন।

রাতের সিটিস্কেপে ক্যাপিটল হিলের আলোকিত ডোম ও আব্রাহাম লিংকন ম্যামোরিয়ালের আউটলাইন ভেসে উঠলে বুঝতে পারি, বার দুই তিনি ভুল টার্ন নিলেও অবশেষে মি. মাইউনগানি ইউনিওন স্টেশনে এসে পৌঁছবেন। পাশের সিটে বসে আমি কেনিয়ার সাম্প্রতিক খ্রিস্টান-মুসলিম রায়টের খবর খুঁটিয়ে পড়ি। নাইরোবির এই পুরনো পত্রিকা মি. মাইউনগানি আমাকে পড়তে দিয়েছেন। রায়টের সূত্রপাত হয় জ্যামাইকা থেকে আগত এক মোল্লা জামে মসজিদে জ্বালাময়ী খুতবা দিলে। মুসলমান তরুণরা খেপে গিয়ে পুড়িয়ে দেয় গোটা দুই গির্জা। প্রতিক্রিয়ায় খ্রিস্টানরা পাঙ্গা-শাবল ও ভোজালি দিয়ে হত্যা করে বেশ কিছু মুসলিমকে।

মি. মাইউনগানির পরিবার বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে গিয়ে দেখেন, সড়কে তাদের গোত্রের বেশ কিছু চেনাজানা মুসলমানের লাশ পড়ে আছে। এ অবস্থায় খোলামেলা রাজপথে পায়ে হেঁটে পালিয়ে যাওয়া নিরাপদ নয়। তাঁর আত্মীয়স্বজন নিকটবর্তী একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ঘণ্টা খানেক পর বুঝতে পারেন, তারা ভুলে এসে উঠেছেন এক খ্রিস্টান ধর্মযাজকের বাড়িতে। ধর্মযাজক বাইবেল স্টাডি করার ছোট্ট কামরায় তাদের লুকিয়ে রাখেন পুরো চার দিন চার রাত। বর্তমানে পরিস্থিতি নর্মাল। এ কাহিনি নাইরোবির ইংরেজি পত্রিকার সংবাদ হয়েছে। আত্মীয়স্বজনরা ডাকে পত্রিকার কাটিং মি. মাইউনগানিকে পাঠালে তাঁর কাছে সমস্ত ঘটনাকে অলৌকিক মনে হয়। তিনি শুকরিয়া আদায়ের জন্য কিছু কেনিয়ান খাবার তৈরি করেছেন। ভার্জিনিয়াতে আমরা যে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকি, এখানে খাবার বিতরণের জন্য কাঙ্গাল বা মিশকিন পাওয়া মুশকিল। ওয়াশিংটন ডিসিতে বিস্তর হোমলেস বা গৃহহীন মানুষের বসবাস। এদের অনেকে নিত্য উপাস-কাপাস করেন। আমি মি. মাইউনগানিকে পরামর্শ দেই- হোমলেসদের মাঝে খাবার বিলিয়ে দিতে।

ইউনিয়ন ইস্টিশনের সামনে আমরা গাড়ি পার্ক করি। এখানে ল্যাম্পপোস্টগুলোর বাতি কী কারণে জানি নিভিয়ে রাখা হয়েছে, তাই শ্বেতপাথরের বিপুল অট্টালিকাকে ভুতুড়ে দেখায়। হোমলেসদের তালাশে কেনিয়ান খাবারের প্যাকেট নিয়ে আমরা ইস্টিশনের ভিতরে ঢুকি। রাতের মতো বোধকরি ট্রেন চলাচল শেষ। বিশাল পরিসরের স্পেসে কোনো প্যাসেঞ্জার নেই। মি. মাইউনগানি অবাক হয়ে অর্ধবৃত্তাকার ছাদ ও বেলকনি দেখেন। বেলকনিতে এক সারি লাইফ সাইজের স্ট্যাচু। মনে হয়, আমরা যেন দাঁড়িয়ে আছি এক প্রাসাদের দরবার হলে, আর আমাদের দুদিকে কোন জাদুবলে প্রস্তুরীভূত হয়ে আছে দুই সারি রাজপ্রহরী।

অবশেষে আমরা বিশাল দালানটির বাইরে এসে ঘাসের গোলাকার চত্বরে যেখানে ক্রিস্টফার কলম্বাসের মূর্তি- তার নিচে একজন জ্যালজ্যেলে চেহারার হোমলেস মানুষের তালাশ পাই। তিনি মূর্তির বাঁধানো বেদিতে হেলান দিয়ে ঝিমাচ্ছেন। মি. মাইউনগানি তাকে এক প্যাকেট খাবার দিলে তিনি ফোঁকলা দাঁতে হেসে বলেন, ‘আই অ্যাম নট রিয়েলি অ্যা হোমলেস। ম্যান, কাম টু মাই প্লেস ওয়ান ডে, আমি তোমাদের তাজা ট্রাউট মাছ রান্না করে খাইয়ে দেব।’ আমি জানতে চাই, ‘হোয়ার ইজ ইওর হোম?’ তিনি খাবারে আঙ্গুল ঢুকিয়ে মাংসের হাড় স্পর্শ করে বলেন, ‘ইউ গাইজ শুড গিভ মি সাম ফিস। দাঁত নেই তো, মাংস খাওয়া বড় ঝামেলা যে।’

এই মানুষটি তেমন বয়স্ক না, তার সবগুলো দাঁত কেন পড়ে গেছে ঠিক বুঝতে পারি না। তিনি খানিকটা মাস-পটোটো মুখে পুরে, শার্টে আঙ্গুল মুছে ছেঁড়া ঝ্যারঝ্যারে ব্যাগ থেকে বের করেন একটি হাউসবোটের ছবি, এবং তা দেখিয়ে বলেন, ‘দিস ইজ মাই হোম। আই অ্যাম আ ফিসারম্যান। আই ডোন্ট লাইক লিভিং ইন আ হাউস। নৌকাতে বসবাস করতেই আমি অভ্যস্ত।’ হাউসবোটের ছবি হাতে খাবারের দিকে তাকিয়ে তিনি আবার ঝিমাতে শুরু করেন।

ঝুপসি অন্ধকারে বেঞ্চে বসে আছেন আরেকজন হোমলেস মানুষ। তার পাশে রাখা রেস্কিনে বাঁধাই ভারি বাইবেল; তার ওপর জ্বলছে দুটি মোমবাতি। মৃদু আলোয় তিনি স্ক্রুডাইভার দিয়ে গিটারের তার ফার কিছু ঠিকঠাক করছেন। মাঝেমাঝে তা থেকে ঠুংটাং শব্দ ছড়াচ্ছে। বাইবেলটিতে মোমবাতির পাশে জড়ো করে রাখা আধপোড়া সব সিগারেট। মি. মাইউনগানি তাকে এক প্যাকেট খাবার দিলে তিনি খাবার শুঁকে বলেন, ‘লিসেন গাইজ, আই ডোন্ট রিয়েলি লাইক অল দিস স্পাইসি ফুড? না, মসলাদার খাবার আমার একেবারেই পছন্দ না। তো তোমাদের কাছে একটা সিগ্রেট হবে না?’

আমরা কেউই স্মোক করি না। তো অপারগতা প্রকাশ করি। কাঁধ অবধি দীর্ঘ লালচে চুলের এ হোমলেস মানুষটি মোমবাতির শিখায় সিগ্রেটের আধপোড়া শেষাংশটি ধরান। তিনি ধোঁয়া ছেড়ে, বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন সামনের ইউনিয়ন ইস্টিশনের শ্বেতকায় বিরাট অট্টালিকাটির দিকে। জাদুবলে কোথাকার কোন গোপন প্রজেক্টার থেকে তাতে ফুটে ওঠে স্ট্যাচু অব লিবার্টির ছায়া। দেখতে দেখতে ইস্টিশনের দেয়ালজুড়ে ভেসে যেতে থাকে, ফ্লোরিডার সমুদ্রসৈকত আর গ্র্যান্ড কেনিয়ানের ছায়ারূপ। গাড়ি হাঁকিয়ে ফেরার পথে সিগন্যালের লালবাতিতে গাড়ি স্লো করতেই দেখি, পাশের গলিতে একটি বাড়ির সিঁড়িতে বসে আরেক হোমলেস মানুষ। তার মলিন ব্যাগের পাশে কার্ডবোর্ডে মার্কার দিয়ে লেখা-‘হ্যাংগ্রি, সিক অ্যান্ড টায়ার্ড।’ ততক্ষণে বাতির লালরং বদলে সবুজ হয়েছে, তাই গাড়ি দাঁড় করানো যায় না। ট্রাফিক ম্যানেজ করে মি. মাইউনগানি টার্ন নিয়ে একটু সামনে গিয়ে এক সুযোগে গাড়ি সাইড করে বলেন, ‘এক প্যাকেট খাবার কাউকে দিতে পারিনি। এখানে পার্ক করা যাবে না। তুমি কি কাইন্ডিলি এই প্যাকেট হোমলেস মানুষটাকে পৌঁছে দেবে? আমি গাড়ি নিয়ে রাউন্ড দিতে থাকব, খাবার দেওয়া হয়ে গেলে তোমাকে পিক করতে কোনো অসুবিধা হবে না।’ আমি প্যাকেট হাতে খাট করে ফুটপাথে লাফিয়ে নামি। তারপর হাঁটতে শুরু করি, ক্ষুধার্ত গৃহহীন মানুষটির নিশানায়।

সর্বশেষ খবর