শুক্রবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা
লুৎফর রহমান সরদার

অমর ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা

অমর ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা

মহান ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাসের অনেক কিছুই আজও অলিখিত। বিশেষত যাঁরা মফস্বলে অবস্থান করেছিলেন জীবনের বালুকাবেলায়- তাঁদের অবদানের কথা। তাঁদের কথা তুলে ধরা জাতীয় দায়িত্ব। তবে এ বিষয়ে ঊণœাষিকতার শেষ নেই। লুৎফর রহমান সরদার তাঁদের একজন-যিনি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।

লুৎফর রহমান সরদারের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৩ এপ্রিল, সাতক্ষীরায়। তাঁর ছাত্রজীবনের সূচনা কালীগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ম্যাট্রিক পাস করেন সাতক্ষীরার ঐতিহ্যবাহী পিএন স্কুল থেকে, ১৯৪৯ সালে। ওই সময় বামপন্থি ছাত্র রাজনীতি তাঁর মনে রেখাপাত করেছিল। গোপনে সম্পৃক্ত হন ওই দলের সঙ্গে। বিশেষ করে মানবেন্দ্রনাথ রায় বা এমএন রায় এবং রাদুকা প্রকাশনীর বিভিন্ন বই পড়ে জীবন বদলের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। এমএন রায় এমন এক কীর্তিমান বাঙালি যিনি ১৯২০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। অন্যদিকে কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শে উদ্বীপ্ত হয়ে লুৎফর রহমান সরদার ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। ওই সময় ঢাকার কমরেডদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিবিড় হয়।

হাইস্কুলে পড়ার সময় ছাত্রদের অতিরিক্ত ফি আদায় নিয়ে আন্দোলন করেন লুৎফর রহমান সরদার। মহান রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায় থেকে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। পুরান ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার পক্ষে প্রতিটি মিছিলে তিনি অংশ নেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় জগন্নাথ কলেজ থেকে যে ১৬ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয় লুৎফর তাঁদের অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একজন কর্মী এমনকি সর্বদলীয় রাষ্ট্র ভাষা বাংলা রক্ষা কমিটিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালে দৈনিক পত্রিকা ‘সংবাদ’-এর ব্যবস্থাপক মাহবুবুর রহমান খান এবং সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরীর সংস্পর্শে আসেন। ওই সময় সিপিপি নেতা কমরেড মনি সিং-এর দলে যোগ দেন। তখন ঢাকায় বামপন্থি আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন কমরেড মনি সিং, কমরেড নেপাল নাগ, অজয় রায়, বারীণ দত্ত প্রমুখ। তাঁদের আন্দোলন-সংগ্রামে ভীত হয়ে আইয়ুব খান সরকার এসব কমরেডদের জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। ওই নামের তালিকায় লুৎফর রহমান সরদারের নামও ছিল। কমরেড মনি সিং অভিবিক্ত বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় তাঁকে বিভিন্ন সময় আত্মগোপনে থাকতে হয়। তখন কমরেডদের অনেকে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। নটরডেম কলেজের শিক্ষক কমরেড নেপাল নাগ, নিবেদিকা নাগ, লুৎফর রহমান সরদার একই সঙ্গে ভারতে আত্মগোপনে ছিলেন। নেপাল নাগের নাম ছিল আব্দুর রহমান। লুৎফর রহমান সরদার পরিচিত ছিলেন অরুণ ছদ্মনামে। লুৎফর রহমান সরদারের সখ্যতা গড়ে ওঠে জ্যোতি বসু, মোজফফর আহমদ, ডা. সাইফ-উদ-দাহার প্রমুখের সঙ্গে।

জগন্নাথ কলেজে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে এক পর্যায়ে গ্রামে ফিরে যান লুৎফর রহমান সরদার। অতিরিক্ত রাজনৈতিক সম্পৃক্তার জন্য পরিবার থেকে ১৯৫৯ সালে করিমুন্নেছার সঙ্গে তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয়। তখনও বামপন্থি রাজনীতির নানা কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সালে ৩নং সখিপুর ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। ১৯৬৭ ডা. দাহার নেতৃত্বে কৃষক শ্রমিক সংগঠন গঠিত হলে তার নেতৃত্ব দেন। ওই সময় তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭০-এর নির্বাচনে তিনি দেবহাটা কালীগঞ্জ আসন থেকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। ১৯৭১-এ বাঙালি জাতির মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তখন লুৎফর রহমান সরদার ভারতের টাকিতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। টাকিতে তাঁর কমান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট মৃণাল কান্তি মুখার্জি। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। টাউনশ্রীপুর পাকিস্তানি রাজাকার প্রধান ইউনুসকে নিজ হাতে হত্যা করেন। বিখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা শাহাজাহান মাস্টার ছিলেন সহযোগী। টাউনশ্রীপুর, ভোমরা, ব্যাংদহ, কুলিয়া, বেলেডাঙ্গা, পুষ্পকাটির যুদ্ধের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন লুৎফর রহমান সরদার। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কারণ জাতির জনকের হত্যাকান্ড লুৎফর রহমান সরদারের জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। এক পর্যায়ে রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। তবে তাঁর সমাজসেবা বন্ধ হয়নি। নিজ এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। নৈতিকতা ও জনকল্যাণই ছিল লুৎফর রহমান সরদারের জীবনবোধ। ফলে নিজে সাধারণ জীবন-যাপনের মাধ্যমে জনমানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। ২০০৭ সালে ১৩ মার্চ তিনি মারা যান। এই মহান মানুষটিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। তাঁর অমর স্মৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।

                শেখ মিজানুর রহমান

সর্বশেষ খবর