শুক্রবার, ৫ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

খোকা ও তার ছাতার গল্প

ইমদাদুল হক মিলন

খোকা ও তার ছাতার গল্প

আজ স্কুল নেই। এজন্য খোকা একটু বেলা করে উঠেছে। শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রথমে খোকা আকাশের দিকে তাকায়। এটা তার অভ্যাস। সকালবেলার আকাশ আর রোদের আলো তার খুব ভালো লাগে। আজ রোদ ওঠেনি। আকাশ মেঘলা। মেঘলা আকাশও ভালো লাগে খোকার। মেঘের পর মেঘ ভেসে যায় এক আকাশ থেকে অন্য আকাশে। মেঘগুলোকে খোকার নৌকার মতো মনে হয়। যেন আকাশ আসলে বিশাল এক নদী। পদ্মা মেঘনা কিংবা যমুনার মতো। আর মেঘগুলো হচ্ছে ছোট বড় নৌকা। আকাশ নদীতে যেন ভেসে যাচ্ছে সেইসব নৌকা।

আজও আকাশের দিকে তাকিয়ে তাই মনে হলো খোকার।

উঠোনে দাঁড়িয়ে সে আকাশ দেখছে আর তাকে দেখছে তার প্রিয় কুকুরটি, ঘরের চালায় বসে থাকা বানরটি। শালিক আর ময়না পাখি রাতেরবেলা থাকে খাঁচায়। পাখি দুটো এতই পোষ মেনেছে, সন্ধ্যা হয়ে এলে আপনা আপনি গিয়ে খাঁচায় ঢুকে যায়। সকালবেলা খাঁচার মুখ খুলে খাবার দেওয়া হয়। খাঁচায় বসেই যে যার খাবার খেয়ে নেয়।

দুই পাখির দুই খাঁচা। খাঁচা দুটো ঝুলানো থাকে খোকা যে ঘরে ঘুমায় সেই ঘরের বারান্দায়। খাওয়া শেষ করে পাখি দুটো বেরোয়। উড়ে গিয়ে ঘরের চালায় বসে, বাড়ির সামনের বড় আমগাছটার ডালায় বসে। পাখিরা সাধারণত চঞ্চল স্বভাবের হয়। খোকার পাখি দুটোও চঞ্চল। সারা দিন নিজেদের মতো ওড়াউড়ি করে। দুটিতে ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। এক সঙ্গেই তাদের চলাফেরা, ওড়াউড়ি। তবে তারা খোকার এতই পোষা, খাঁচার বাইরে থেকেও বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায় না। সারা দিন মুক্ত থেকে মানুষের মতো সন্ধ্যাবেলায় যেন ঘরে ফেরে।

পাখি দুটোর এই অভ্যাস খোকাই করিয়েছে। এইটুকু বয়সেই খোকা জেনে গেছে পৃথিবীর কোনো প্রাণীকেই আটকে রাখতে হয় না। যে যার মতো স্বাধীনভাবে, মুক্তভাবে চলাফেরা করবে।

কুকুর আর বানরের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। সেই দুটিও পাখি দুটোর মতোই মুক্ত থাকে। বানর বসে থাকে খোকার ঘরের চালায়। কুকুরটা শুয়ে থাকে বারান্দায়। বানরটাও এসে কখনো কখনো কুকুরের পাশে শুয়ে থাকে। তবে পাখি দুটো আর কুকুর বানর খোকার যে কী ভক্ত, বলে শেষ করা যাবে না। সকালবেলা তারা খোকার জন্য অপেক্ষা করে। খোকা কখন উঠবে, কখন খোকার সঙ্গে তাদের দেখা হবে। আর দেখা হলে তাদের যে কী আনন্দ! ময়না পাখিটা আনন্দে তার মতো করে শিস দেবে, শালিক পাখিটাও তাই করবে। উড়ে এসে খোকার কাঁধে বসবে। ময়না পাখি এক কাঁধে, শালিক অন্য কাঁধে।

বানর একটু দুষ্টু স্বভাবের। মজাদার সব কান্ড করে। পাখি দুটোকে কখনো কখনো ভয় দেখিয়ে খোকার কাঁধ থেকে সরিয়ে দেয়। বানরের মতলবটা খোকা জানে। পাখি দুটোকে তাড়িয়ে সে নিজে উঠে বসবে খোকার কাঁধে। শিশু বানর। ছোট। তবে ভারি বুদ্ধিমান।

কুকুরটা আছে সারাক্ষণ খোকার পায়ে পায়ে। খোকা স্কুলে যাওয়ার সময় তার এই চার বন্ধুর একটু মন খারাপ হয়। আহা, বিকেলের আগে খোকার সঙ্গে তাদের আর দেখা হবে না। সারা দিন খোকার জন্য তারা অপেক্ষা করে। যেমন অপেক্ষা করেন খোকার মা। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় হলে মা গিয়ে বাড়ির সামনের আমগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে থাকেন। কুকুর আর বানরটাও ওদিকটাতেই ঘুরঘুর করে। পাখি দুটো বসে থাকে আমগাছের ডালে। দূরে খোকাকে দেখা গেলেই পাখি দুটো আনন্দের ডাক ডেকে ওঠে। কুকুর লেজ নাড়ে। বানর তিড়িং বিড়িং লাফায়। আর তাঁর খোকা বাড়ি ফিরছে এই আনন্দে মায়ের মুখে ফোটে স্নিগ্ধ হাসি।

আজ সকালে রান্নাঘর থেকে মা দেখতে পেলেন খোকা ঘুম থেকে উঠেছে। ওই তো আমতলায় দাঁড়িয়ে আছে। খোকার খাবার মা নিজহাতে তৈরি করেন। খোকা বড়ই রোগা। একদমই খেতে চায় না। মা সারাক্ষণ ছেলের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত। বাড়িতে তৈরি হচ্ছে ঘি ছানা মাখন। ছেলে ওসব মুখেই দিতে চায় না। তার প্রিয় খাবার হচ্ছে ভাত মাছ, ডাল আর সবজি। তবে সব শেষে দুধভাত থাকতেই হবে। গুড় বা কলা দিয়ে দুধভাত খাবে খোকা। মা সেভাবেই সব তৈরি করেন। বাড়ির পশ্চিম পাশে খাল। খালের তাজা মাছ ধরা হয় খোকার জন্য। এত কিছুর পরও খোকার স্বাস্থ্য ভালো হয় না।

মা ডাকলেন, ‘খোকা, খোকা। হাত মুখ ধুয়ে নাশতা করতে এসো।’

আমতলা থেকে সাড়া দিল খোকা। ‘আসছি মা’। তারপরও কিছুটা সময় সে তার প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করল। তারপর হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।

বিশাল বাড়ি খোকাদের। প্রায় দুশো বছরের পুরনো বাড়ি। বাবা-চাচাদের পরিবার মিলিয়ে অনেক লোকের বাস। খোকার বয়সী ছেলেমেয়েও অনেক। তারা ছয় ভাইবোন। প্রথমে দুইবোন, তারপর খোকা, তারপর একবোন একভাই আর সবার ছোট আরেক বোন। ছয় ভাইবোনের মধ্যে খোকাই মা-বাবার সবচেয়ে আদরের। বোনরা আর ছোটভাইটিও খুব ভালোবাসে তাকে। ভাইবোন আর বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েরাও খোকার বন্ধু। গ্রামেও তার বয়সী বন্ধু অনেক। স্কুলেও আছে একদল বন্ধু। কারণ খোকা যে খুব সহজে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে! সবাই যে খুব সহজেই তাকে ভালোবেসে ফেলে!

খোকাদের কাছারি ঘরটা বাড়ির পশ্চিম পাশে। খালের ধারে। সেই ঘরের পাশে আরেকটা ঘর। সেই ঘরে তিনজন শিক্ষক থাকেন। একজন বাড়ির ছেলেমেয়েদের ইংরেজি পড়ান। একজন পড়ান আরবি। আরেকজন আছেন অঙ্কের শিক্ষক। বাড়ির এই শিক্ষকদের কাছে খোকা পড়াশোনা করে।

বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে একটা প্রাইমারি স্কুল আছে। ‘গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুল’। খোকাকে সেই স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। সে ক্লাস থ্রিতে পড়ছে। বর্ষাকালে চারদিক থৈ থৈ করে পানিতে। স্কুলে যেতে হয় নৌকা করে। ছুটির পরে নৌকা করে খোকা একদিন বাড়ি ফিরছিল। খালে নৌকা ডুবে গেল। যে নৌকা বাইছিল সে ঠিক বুঝতে পারল না কেন নৌকা ডুবল। নৌকা ডোবার ফলে খোকা পানিতে পড়ে গেল। তবে তার কোনো অসুবিধা হলো না। কারণ খোকা ভালো সাঁতার জানে। সাঁতারটা সে আগেই শিখে ফেলেছে। কিন্তু নৌকাডুবে গেছে খালে আর তাঁর খোকা পানিতে পড়ে গেছে, মা খুবই ভয় পেয়ে গেলেন। খোকাকে কিছুতেই তিনি আর ওই স্কুলে পাঠালেন না। নৌকা যদি আবার ডুবে যায়! ছেলে যদি আবার পানিতে পড়ে যায়! না না, খোকাকে তিনি কিছুতেই আর ওই স্কুলে পাঠাবেন না।

দুই

আজ বিকেলে আব্বা বাড়ি এসেছেন। তিনি থাকেন শহরে। সেখানে চাকরি করেন। ছুটির আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় বাড়িতে আসেন। ছুটির দিনটা বাড়িতে কাটিয়ে আবার ফিরে যান শহরে। এবার সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে আরও তিন দিনের অতিরিক্ত ছুটি নিয়ে এসেছেন। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তিনটা দিন কাটাবেন। বিশেষ করে তাঁর অতি আদরের খোকার সঙ্গে।

আব্বা যখন এলেন খোকা তখন বাড়িতে নেই। পাড়ায় খোকার বয়সী বন্ধু অনেক। খেলাধুলা করতে খোকা পছন্দ করে। ফুটবল তার প্রিয় খেলা। আজ বিকেলেও বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে গেছে।

বাড়িতে ঢুকেই খোকাকে খুঁজতে লাগলেন আব্বা। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বললেন, ‘আমার খোকা কই? খোকা! বাবা খোকা, কোথায় তুমি?’

মা ছিলেন কাছাকাছি। হাসি মুখে বললেন, ‘নিশ্চয়ই বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে গেছে।’

‘ও হ্যাঁ, তাই তো! বিকেলবেলা তো সে খেলতে যাবেই!’

‘আপনার হাতে তিনটা নতুন ছাতা কেন?’

‘খোকার জন্য এনেছি।’

মা হাসলেন। ‘আগের বারও তো দুটো এনেছেন!’

এবার আব্বার মুখেও হাসি ফুটল। ‘তোমার ছেলের তো প্রতিমাসেই তিন চারটা করে ছাতা লাগে।’

‘তা আমি জানি।’ বলে ছাতা তিনটি হাতে নিলেন মা।

সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি ফিরল খোকা। ততক্ষণে বিকেলের নাশতা শেষ করে বারান্দার চেয়ারে বসেছেন আব্বা। হাতে চায়ের কাপ। চেয়ারের পাশে দাঁড় করে রাখা ছাতা তিনটি।

আব্বাকে দেখেই ছুটে এলো খোকা। আব্বা যেমন ভালোবাসেন খোকাকে, খোকাও তেমন ভালোবাসে আব্বাকে। বাড়ি এলে আব্বার গলা জড়িয়ে ঘুমায়। আজ আব্বাকে দেখে ভীষণ খুশি তো খোকা হলোই, ছাতাগুলো দেখেও খুব খুশি। চোখ মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে গেল। ‘এবার তিনটা ছাতা এনেছেন আব্বা?’

চায়ে চুমুক দিয়ে আব্বা হাসলেন। ‘আনবো না? আমার খোকা বলেছে আর আমি কি তা না এনে পারি?’

গভীর আনন্দে আব্বার গলা জড়িয়ে ধরল খোকা। একহাতে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বাবা।

খোকা এখন দূরের স্কুলে পড়ে। বর্ষাকাল। হঠাৎ হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়। আকাশ এই মেঘলা, এই আলোকিত।

সপ্তাহের শুরুর দিন নতুন একটা ছাতা নিয়ে স্কুলে রওনা দিল খোকা। বিকেলবেলা বাড়ি ফিরল ভিজে একেবারে চুপসে হয়ে।

আব্বা আর মা দুজনে বুঝলেন ঘটনা কী ঘটেছে! তাঁরা তো তাঁদের খোকাকে ভালো করেই চেনেন। আব্বার মুখে মিটিমিটি হাসি। সব বুঝেও মা খোকাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এভাবে ভিজেছো কেন, খোকা? তোমার ছাতা কোথায়?’

গামছায় মুখ মাথা মুছতে মুছতে খোকা হাসি মুখে বলল, ‘আমার একবন্ধুর ছাতা নেই মা। সকালবেলা ভিজতে ভিজতে স্কুলে এসেছে। ওর বইগুলোও ভিজে গেছে। ওরা খুব গরিব। আমার ছাতাটা ওকে দিয়ে দিয়েছি।’

খোকা তারপর আব্বার দিকে তাকাল। ‘আব্বা।’

‘বলো বাবা?’

‘আমার ওই বন্ধুকে একসেট বই কিনে দেবেন? ওর বইগুলো ভিজে একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। আমি বলেছি আব্বাকে বললে তিনি তোমার বইগুলো কিনে দেবেন।’

খোকার মাথায় হাত রেখে আব্বা বললেন, ‘এই নিয়ে তুমি ভেবো না বাবা। আমি অবশ্যই তোমার বন্ধুর বইগুলো কিনে দেবো। কাল স্কুলে গিয়ে বন্ধুকে বলো, নতুন একসেট বই কয়েক দিনের মধ্যেই সে পেয়ে যাবে।’

আব্বা বই কিনে দিয়েছেন। সেই বই বন্ধুকে পৌঁছেও দিয়েছে খোকা। এই হলো দিনকয়েক পরের ঘটনা। সেই দিনও বৃষ্টি ছিল। সেই দিনও ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিল খোকা। বাড়ি ফিরল ভিজতে ভিজতে। সঙ্গে ছাতা নেই।

কী কারণ?

আজও খোকা তার এক গরিব বন্ধুকে নিজের ছাতা দিয়ে দিয়েছে।

এইভাবে মাসখানেকের মধ্যে খোকার তিনটা ছাতাই শেষ। আব্বাকে সে চিঠি লিখল, ‘বাড়ি আসার সময় পাঁচটা ছাতা নিয়ে আসবেন আব্বা। একটা আমার জন্য আর চারটা আমার বন্ধুদের জন্য। ওদের একজনেরও ছাতা নেই। রোদ বৃষ্টিতে খুব কষ্ট পায়।’

পরের বার বাড়ি আসার সময় পাঁচটি ছাতাই নিয়ে এলেন আব্বা। এবার খোকার আসল নামটা বলি। তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলি। তিনি আমাদের জাতির পিতা। তাঁর আদর্শ আমাদের মাথার ওপর ছাতার মতো আছে। তাঁর দেখানো পথ ধরে আমরা চলি। তিনি চিরকাল আমাদের মাথার ওপর ছায়া দিয়ে যাবেন। বাংলাদেশের আকাশ যত বড়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছাতাটাও তত বড়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর