শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বইঠা কবর

হুসেইন ফজলুল বারী

বইঠা কবর

যোগী বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে বলা পড়ে এলো। এত পথ হাঁটতে আমার শিশু পা একদম ধরে আসে। হয়রান হয়ে একটু বসবার ফুরসত খুঁজি। আজ এখানে কৃষ্ণগীতের আসর বসবে। পাশেই কয়েকজন ধুতিপরা লোক হ্যাজাকে বাতাস ভরছে। একটু দূরে ডালিম গাছে কী সুন্দর ফুল ফুটে আছে। বিকেলের আবির এসে চারপাশে সোনারঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। এক প্রৌঢ়া নারী লম্বা ঘোমটা টেনে শাখা-শোভিত হাতে বাগানে পানি ছিটিয়ে গেল। কয়েকটা ফুটফুটে কিশোরী এসে তুলসীর ঝাড়ের পাশে গুচ্ছ গুচ্ছ ধূপকাঠি জ্বেলে দিয়েছে। কেমন যেন মিষ্টি মিষ্টি সুবাস। অগ্রজ লুলু বলল, এটা চন্দনের গন্ধ। আমি বিভোর হয়ে আবার সেই সৌরভ নাক দিয়ে টানি। শাদা থান-পরা এক বুড়ি অবনত হয়ে এক যুবক পুরোহিতকে প্রণাম করে গামছা আর চকচকে কয়েকটা নোট ধরিয়ে দিয়েছে। আমার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে লুলু বলল-ছেলেটার বয়স কম হলেও ব্রাহ্মণ তো। এসব জাতপাতের ধারাপাত আমার মাথায় ঢোকে না। বেশ উঁচুলয়ে সম্মিলিত উলুধ্বনি শুনে চাতালের দিকে এগোই। কলাগাছের গেট পেরিয়ে ঝালরসমেত রঙিন শামিয়ানার মঞ্চ। মাত্রই সন্ধ্যাপুজোর আরতি বেজে উঠেছে। ইতিমধ্যে দুইজন ঢাকী এসে মাদল বাজাতে শুরু করল। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে লাল ফতুয়া পরা এক সুঠাম যুবক অপূর্ব দক্ষতায় মুরালি বাঁশিতে মিহি সুর তুলল। মানুষটাকে চিনলাম। গঞ্জের এককোণে উবু হয়ে বসে তাকে অগ্নিগর্ভ হাঁপর টেনে হাতুড়ি দিয়ে আগুনে পোড়া দা-কাস্তে-কোদাল পিটিয়ে ঠিক করতে আমি নিজ চোখে দেখেছি।

সাঁঝ বুঝি হয়েই এলো। এ মায়াপুরি ছেড়ে আসতে মন চায় না। তবু মন খারাপ করেই গান শুরু না হতেই বাড়ি ফিরে যেতে হবে। নইলে আগামীকাল মেলায় যাওয়ার অনুমতি হবে না। পরদিন কেমতলি মেলায় যাব-এ উত্তেজনায় রাতে ভালো করে আমার ঘুমও হয় না। লুলু এখন ক্লান্ত হয়ে আমার পাশে অঘোরে ঘুমায়।

পরদিন সকাল সকাল খেয়ে সেজেগুজে ছায়ামাখা হালট ধরে মেলার দিকে হাঁটি। আমাদের পথপ্রদর্শক ওপাড়ার একদল শিশু-কিশোর। লুলুর পকেটে মায়ের দেওয়া বেশ কয়েকটা নোট। একটু হাঁটতেই ডাকাতিয়া গাঙের ক্ষীণতোয়া শাখা। এর উপর বাঁশের সাঁকো। লুলু তার দলবলসহ প্রায় দৌড়ে সাঁকো পেরিয়ে মাটির রাস্তায় উঠে। আমি সন্তর্পণে জীর্ণ সেতুর বংশদন্ডে পা রাখি, কিন্তু ভয় পাই, যদি পা ফসকে নিচে পড়ে যাই। লুলু ওপার থেকে দক্ষ কোচের মতো নির্দেশনা দেয়। আতঙ্কিত আমি একসময় ধীরলয়ে এই পুলসেরাত পার হয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচি। পথে দেবীপুরের যোগীদের আস্তানা। এতটা পথ হাঁটতে আমার তেষ্টা পায়। পাঠশালার পাশে একটা টিউবওয়েল দেখে লুলু চারদিকে তাকিয়ে কলের মুখে হাত-মুখ লাগিয়ে পানি খায়। আমিও তাকে অনুসরণ করি। পানি যত না মুখে যায়, আমার মুখ বেয়ে সারা শরীর ভিজে একাকার। তুলসীর ছায়ায় ছোট ছোট কাঁচাপাকা সিঁড়ির আসন দেখে জিরোবার ইচ্ছে হয়। দুয়েকটা বেদিতে জ্বলন্ত আগরবাতি। লুলু বলল, এগুলো বৈঠকি কবর। আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, বুঝেছি ছোট বাচ্চাদের কবর। লুলু ভেংচি কেটে বলল, যাহ, বেকুব। মোটেই না, যোগী মরলে বসিয়ে কবর দেয়। আমি মসজিদের পাশের গোরস্তানে লম্বা লম্বা কবর দেখেছি। কিন্তু যোগীদের কেন এত ছোট সমাধি আমি তা ভেবে কূল পাই না। কিন্তু লুলুর ভ্রƒকুটির ভয়ে আর প্রশ্ন না করে হাঁটতে থাকি। সিঁদুরপরা বউ-ঝিরা গোবর দিয়ে লেপে মুছে উঠান সাজায়। কী সুন্দর অবতল রেখার আলপনা হয়ে যায় শাঁখা খচিত হাতের ছোঁয়ায়। তাদের সীমন্তে লাল সিঁদুর। একটা টিনের খোলে কালো তিল রোদে পোড়ে। এক যুবতী মুরগির এক ঝাঁক ছানা নিয়ে গ্রীবা বাঁকিয়ে তরতর করে হাঁটে। একপাশের বাঁশের মাচায় হাতেবোনা দীর্ঘ কাপড়।

পথের পাশে ভাঁটফুলের ঝাড়। বিরলপত্র জাম্বুরা গাছ এখন ধূলিধূসরিত। মেঠো পথের একপাশে আনারস বন। কিন্তু এখন কোনো ফল নেই। দুয়েকটা কলি এসেছে মাত্র। একটা বনবিড়াল দেখে গুঁইসাপ দ্রুতগতিতে পালিয়ে গিয়ে পানাপুকুরে নামল। কয়েকটা ভোমরা মনের হরষে নারকেলবনে উড়ে। বাড়ি লাগোয়া জামগাছের ছায়ায় ধূসর কুকুর কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমায়। আমাদের পদশব্দে সারমেয়টি আলস্যভরা চোখ মেলে তাকিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। ভাঙা হাতলের একটা কাঠের চেয়ারে বসে নিকেলের গোল চশমাপরা পন্ডিতজির মুখে বলিরেখার বিস্তার। তার হাতে একটা লাল বই। লুলু আদাব দিলে তিনি দাঁতহীন মুখে হেসে প্রতি সম্ভাষণ জানালেন। একটু এগিয়ে বাঁশবনের পাশ দিয়ে যেতে যেতে পুষ্পিত রাধালতার ঝাড়। আমাদের পায়ের নিচে বাঁশের খোল মচমচ করে বেজে উঠে। এই বাঁশবন পেরিয়ে পাকা পুল। এদিকে কাদামাখা মালকোঁচা মেরে দুজন শ্রমিক সেঁউতি দিয়ে পানি সেঁচে। ঘোলা জল নালা হয়ে দ্রুত সামনে এগোয়। পুলের পর বড়ুয়াপাড়া। বড়দিঘির ঢিবির পাশে কপিখেত। সেদিকে দ্রুতলয়ে কী শাদা ছাগলছানা দৌড়ে গেল? ভাই লুলু বলল, না না, এটা খরগোশ। আমার কান ধরে সে মজা করে এভাবে, দেখিসনি, এর দুটো কান তোর কানের মতো খুব খাড়া। একটা তেতলা বাড়ি হতে ভেসে আসা খরতালের বেসুরো আওয়াজ শুনে লুলু বলল, এটা শ্যামবাবুর দালান।

আরেকটু এগোতেই জবাগাছের ঘন ঝাড়। এদিকে প্রাণময় গাছপালার সমারোহ। অদূরেই গাছের মাথা ছাপিয়ে কিয়াংয়ের সুচালু মস্তক। অনেকটা জাহাজের মাস্তুলের মতো দেখায়। কিয়াংয়ের পাথুরে দহলিজে বসে গেরুয়া চাদরপরা মাথামুন্ডিত মানুষজন হাতজোড় করে বসে আছে। তাদের সামনে ইয়া কানওয়ালা বিশাল সোনালি মূর্তি। লুলু বলল, এরা বড়ুয়া ভান্তে আর ওইটা ওদের প্যাগোডা। এই খটমটে নাম আমার মুখে আসে না। তবে বুঝলাম, এটা পূজাঘর। আমি হা হয়ে প্রায় নিমীলিত চোখের বিরল মানুষজন দেখি। শক্ত সামর্থ্য ফরসা মানুষগুলোর ছোট ছোট চোখ যেন জ্বলজ্বলে মার্বেল। সবুজ প্রান্তরজুড়ে ফুলের কেয়ারি দেখে প্রশ্ন করলাম, আমাদের মসজিদ প্রাঙ্গণে ফুলের বাগান নেই কেন? প্রত্যুৎপন্নমতি লুলু দ্বিধায় পড়লেও সঙ্গে সঙ্গেই একটা জবাব দিয়ে দেয়, ওরা তো ফুল দিয়ে পূজা করে, তা-ই। দহলিজে স্বাস্থ্যবতী পূজারি মহিলাদের দেখে আরও অবাক হই। আমাদের মসজিদের ত্রিসীমানায় কখনো ফুলগাছ বা মহিলা দেখিনি কোনো দিন। অনাথাশ্রমের চাতাল হয়ে সামনে এগোই। ওদিকে একটা খোলা-পায়খানা ঘর। পাশেই গাঢ় সবুজ কচুবন। কয়েকটা কালোমতো মোটা প্রাণী কচুবন ঘেঁষে ময়লা ভাগাড়ে মৃদুস্বরে ঘে্যাঁৎ ঘে্যাঁৎ করে। লুলু জানাল, বিসদৃশ এই প্রাণীগুলিই শুয়োর, হারাম প্রাণী! ইতিপূর্বে ছোট নানাভাই রেগে এক গোমস্তাকে শুয়োরের বাচ্চা গালি দিয়েছেন। আজ সেই প্রাণীকে নিজ চোখে দেখলাম। ময়লাখেকো জীবন্ত এই জন্তুগুলোর ময়লাবাজি, অজানা আতঙ্ক কিংবা ঘৃণার মতো কিছু একটা এসে আমার শিশুমনকে আচ্ছন্ন করে। মানুষের হল্লা শুনি। আড়ং মনে হয় খুব কাছেই। লুলু বলল, জোরে পা বাড়া।

অকুস্থলে পৌঁছে দেখি, ঈশান কোণে একটা জীর্ণ মন্দির। মন্দিরের গাজুড়ে বিচিত্র কারুকাজ। মাঝে মাঝে প্রায় নগ্নমূর্তি। উঠান লাগোয়া একটা কালচে তালগাছ। একটা বিস্তৃত বটগাছ আর পাকুড় গাছ মন্দিরকে পেছন দিক থেকে গভীর মায়ায় জড়িয়ে ধরেছে। একপাশে ফুলের বাগান। পিছনে সবুজ কলাবন। সেদিকে বুড়ো অশ্বত্থ গাছের ডালে একঝাঁক তেল চিটচিটে বাঁদুড় নিশ্চুপ ঝিমায়। মন্দিরের ভাঙা পাঁচিলের ওপর ঘন শ্যাওলার সবুজ মখমল। দুই দিন আগে ভারী বৃষ্টি হয়েছে বলে চাতালের ওদিকটা এখনো পিচ্ছিল। আমি পা পিছলে পড়তে গিয়েও বেঁচে যাই। দক্ষিণে উঁচু ঢিবির আকন্দবনের ধার ঘেঁষে ইঁদুর আর সাপখোপের গর্ত। ওপাশের ফণীমনসার আড়ালে একটা গিরগিটি চোখ বড় করে চেয়ে আছে। আমার গা ছমছম করে শুনে লুলু দূর বোকা বলে সেদিকে ইটের টুকরা ছোড়ে। একটুর জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে এরা পালিয়ে ঝোপে লুকায়।

মেলাস্থলে ফুটি-তরমুজের পাহাড় পাশ কাটিয়ে মিষ্টির রাজ্যে এসে আমরা মিহিদানা খাই। আহ, কী সোয়াদ। দক্ষিণপাশের জীর্ণ মন্দিরের পাশে এক জোড়া পাঁঠা আনমনে কাঁঠাল পাতা চিবোয়। টিকিওয়ালা বৃদ্ধ পুরোহিত পাটভাঙা ধুতি পরে ধ্যানমগ্ন। দুয়েকজন এসে প্রণাম করে কলা, আতপচাল, তরমুজ পর্যন্ত রেখে গেছে। পিতলের রেকাবিতে বেশ কয়েকটা ঝকঝকে নোট। কালো মতন একজন সবল পুরুষ বিশাল দা নিয়ে পুরোহিতের কাছে এসে নত হয়ে ভক্তি জানায়। আগত লোকটির বিশাল চোখ দুটি এমন রক্তিম যে মনে হয় চোখওঠা রোগ হয়েছে। আমি ভয় পেয়ে লুলুর হাত ধরি। সে নির্লিপ্তস্বরে বলল, এটা রামদা, এখন পাঁঠা বলি হবে। আমাদের নদীর পাড়ে এর আগে কুস্তির মতো বলি খেলা দেখেছি, তাই আমি হাসিমুখে বলি, ও বুঝেছি, দুই পাঁঠার লড়াই হবে। লুলু বলল, কচুর লড়াই হবে। এক কোপে এদের মাথা কেটে ধড় থেকে আলাদা করা হবে। তারপর পূজারিরা পাঁঠার মাংসের প্রসাদ পাবে। কিন্তু এই ছাগলের মাংস মুসলমানদের জন্য হারাম। কেন হারাম তা জিজ্ঞেস করার আগেই মানুষের হল্লা, ঢোলের বাদ্য, ছাগলের ভয়ার্ত চিৎকার আর উলুধ্বনির বন্যা দশ দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। আমরাও পিছিয়ে পড়ে বাঁশির দোকানে হাজির হই। নানান কিসিমের বাঁশি দেখে আমি তাজ্জব বনে যাই। বিচিত্র পোশাকপরা দোকানি বাঁশের বাঁশিতে কী সুন্দর তোলে! আমি প্লাস্টিকের হলুদ বাঁশিতে ফু দিয়ে চেখে দেখি। লুলু লম্বা বাঁশির ছিদ্রে আঙুল দিয়ে ফু দেয়; কিন্তু কেমন যেন ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ বেসুরো শব্দ হয়। ঝাঁকড়া চুলের বাঁশিওয়ালা পরামর্শ দেয়, নিয়মিত বাজাতে বাজত সুর এসে যাবে। লুলু মুরালি বাঁশি কিনে কিশোর কৃষ্ণের মতো হাঁটে।

লুলুর দেখাদেখি এই প্রথম নাগরদোলায় চড়ি। তন্ময় হয়ে বানরখেলা দেখি। পরে সাপের খেলা দেখতে যুগপৎ আনন্দ আর ভয় এসে মনে ভর করে। এই আড়ং ফেলে আমার বাড়িতে আসতে একদম ইচ্ছে হয় না। একটা শক্ত আইসক্রিম মুখে পুরে দেখি, জুয়াঘরের ওদিকটায় দুজন তাগড়া ছেলের মারামারি বেধেছে। কে যেন মাইকে ঘোষণা দিলো, প্রিয় ভাইয়েরা, মেলার পবিত্রতা বজায় রাখুন। শান্তি শৃঙ্খলা মেনে চলুন। হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই। আমরা সবাই বাঙালি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কেমন যেন হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। মিষ্টির দোকানি সাধুনাথ বিষাদমাখা কণ্ঠে বলল, শালার কপাল! বেচাকেনা সাঙ্গ করে অনেকে শামিয়ানা খুলতে শুরু করেছে। অদূরেই দুইটা ছাগল কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বিচিত্রস্বর তুলে সঙ্গম শুরু করে দিয়েছে। এই তামাশা দেখতে দেখতে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, মেলার কী হলো। লুলু পর্যন্ত দ্বিধায় পড়ে। তবে বিষয়টা যে একদম স্বাভাবিক নয় অনুধাবন করি যখন পিতলের বাঁশি বাজিয়ে হরি চৌকিদার বলল, এই তোরা কী করস, যা, তাড়াতাড়ি বাড়িত যা।

অগত্যা মেলাপর্ব সাঙ্গ করে মন খারাপ করে আমরা বাড়ির দিকে পা বাড়াই। দীর্ঘ পথ। লুলু ভারি তরমুজ নিয়ে আগে আগে হাঁটে। পেটুক আমি তরমুজের কর্তিত একটা ফালি খাবার বায়না করে লুলুর ধমক খাই। কাঁচা আম খাওয়ার জন্য খুদে একটা শানদার ছুরি কেনার খুব শখ ছিল। অবেলায় মেলা ভঙ্গ হওয়ায় আমি হতাশ হলে লুলু বলল, তোকে ঝিনুক ঘষে আম খাওয়ার কসরত শেখাব। ওই তো নদীর সাঁকো দেখা যায়। এবার আমি আগেভাগ্যে নির্বিঘ্নেই ডিঙি নৌকায় গাঙ পার হয়ে ওপারে থাকা লুলুর দিকে চেয়ে আনন্দে বাঁশি বাজাই- পো, পো। সম্ভবত এই প্রথম অগ্রজকে হারিয়ে দিলাম। লুলু দুহাতে তরমুজ ধরে বেশ কৌশল করে এঁকে বেঁকে সাঁকোর গায়ে আস্তে আস্তে পা ফেলে। মন্থর লুলুকে দেখে আমার মায়া হয় আবার ভাবি, লুলু পড়ে গেলে সে হাঁসের মতো ঠিকই সাঁতরে কিনারায় আসবে; কিন্তু তখন কি তার হাতে তরমুজ থাকবে? তরমুজের লোভে তৃষ্ণার্ত আমি আলগোছে একটা ঢোক পর্যন্ত গিলে ফেলি।

যোগীপাড়া পার হয়ে গ্রামের পথে আসতেই এক বিড়িখেকো লোক বলল, ভারতে বাবরি মসজিদে হামলা হইছে। বেশ উৎসুক কয়েকজন জওয়ান ছেলে দোকানিকে বলল, চাচা, রেডিও ঠিক করেন, সন্ধ্যায় বিবিসি শুনতে হইব। চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে আরেকজন বলল, ঢাকার রাজনীতির গরম খবরটাও দরকার। শুনছি, ঢাকায় গন্ডগোল হইছে। এরশাদ ক্ষমতা সহজে ছাড়ব না। ছোট ভাইটা কেন যে এহনও বিশ্ববিদ্যালয়ে বইসা রইছে?

সন্ধ্যায় মায়ের কাছে মেলার বর্ণনা দেওয়ার সময় হইচই শুনে এগিয়ে দেখি, রাস্তায় মশাল জ্বালিয়ে কিছু লোক মিছিল শুরু করছে। মিশিলের ভাষা বেশ উগ্র। রীতিমতো খিস্তি-খেউর। ষন্ডা টাইপের কয়েকটা লোক আবার লাঠি-বল্লম নিয়ে মিছিলের আগে আগে ঘোরে। এর আগে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মিছিল দেখেছি। এই রকম হিংস্র মিছিল দেখে ভয় পেয়ে বাড়ির দিকে পালাই। রাতে খাবার সময় বুঝদার লুলু কাঁদো কাঁদো হয়ে মাকে বলল, ওই ব্যাটারা কি যোগীপাড়ায় গিয়ে সব কিছু ভাইঙ্গা ফেলব? আমি সম্পূরক প্রশ্ন করি, সুন্দর বইঠা কবরও? কেনরে লুলু? মা আমাদের পাতে দুধ-কলা মেশাতে মেশাতে বলে, কিছু বদমাশ সুযোগ পাইলেই গন্ডগোল লাগায়। বাবারা দুধভাত খা।

দাদাজান মাত্র এশার নামাজের সালাম ফিরিয়েছেন এমন সময় বিড়াল পায়ে নিঃশব্দে এসে এক ছায়ামূর্তি দাদাকে প্রণাম করলে দাদা বললেন, কে, কে। ধুতিপরা যোগী সরদার অমূল্য দেবনাথ ফিসফিস করে বললেন, মিয়াসাব, ভারতে চইলা যামু। আগরতলায় সব ঠিক ঠাক। আমাগো মেলার মাঠটা আপনে কিন্যা নেন। নগদ দাম যাই দেন, আপনার বিবেচনা। দাদা বলেন, তুমি সব যোগীদের নেতা। তোমার মতন মানুষ চোরের মতন চইল্যা গেলে অন্য গরিব হিন্দুরা কী করব। অমূল্য সরদার নতমুখে প্রশ্ন ছোড়েন, কী বলেন, মিয়াসাব? আমার বাড়িতে তো বাঁধাছাঁদা শেষ। দাদাজান বলেন, কত শত বছর ধইরা আমরা একলগে আছি। তোমার বাপের বইঠা কবরটাও কী আগরতলায় নিয়া যাইতে পারবা? সে ছিল আমার দোস্ত। শেষে দাদাজান হাঁক দেন, এই তোরা কই, সরদাররে মিষ্টি দে। সরদার হেসে বলেন, কড়া হাকিমপুরী জর্দার এক খিলি পানও লাগব, মিয়াসাব। দই-মিষ্টি খেয়ে পানে চুন মাখতে মাখতে দাদাজান বললেন, সরদার, চলো, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ সবাই মিলে আগামীকাল বিকালে মেলার মাঠে একটা শান্তি-সভা ডাক দেই। ঠিক অই সময়েই আমাদের গোরস্তানের ওদিক থেকে অচেনা ফুলের সৌরভ এসে আমাদের দহলিজে আছড়ে পড়ল।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর