শুক্রবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ

এম আবদুল আলীম

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩) শেকড়-সন্ধানী গবেষক এবং ঐতিহ্য-অনুসন্ধিৎসু মনীষী। পুরনো পুথিসংগ্রহ, সম্পাদনা এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় ও তপস্যা করে তিনি বাংলা সাহিত্যের বহু অনালোকিত ও বিস্মৃত উপাদান জাতির সামনে হাজির করেছেন। তাঁর সংগৃহীত পুথির সংখ্যা যেমন বিপুল তেমনি সেগুলো বিষয়বৈভব এবং সাহিত্যগুণেও সমৃদ্ধ। তাঁর সংগৃহীত পুথির সূত্রে বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের ইতিহাসের বহু অজানা তথ্য সামনে এসেছে এবং তা পুনঃপাঠ এবং পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর রচনাপঞ্জি ও সংগৃহীত বিপুল পুথি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অমূল্য সম্পদ। পুথিসংগ্রহ এবং সেগুলোর বহুমাত্রিক মূল্যায়ন ছিল তাঁর নেশা; দারিদ্র্যের কশাঘাত এবং বৈষয়িক দৈন্য কোনো কিছুই তাঁকে দমাতে পারে নি। মধ্যযুগের নাথসাহিত্য, সুফিসাহিত্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, জঙ্গনামা বা যুদ্ধকাব্য, মুসলিম ধর্মসাহিত্য, সওয়াল সাহিত্য, মুসলিম কবিদের রচিত বৈষ্ণব পদাবলির ইতিহাস তাঁর সংগৃহীত পুথির আলোকেই লেখা হয়েছে। পনেরো শতকের কবি শাহ মুহম্মদ সগীর, জয়েনউদ্দীন; ষোল শতকের কবি দৌলত উজির বাহরাম খান, মুহম্মদ কবির, শেখ ফয়জুল্লাহ, সৈয়দ সুলতান, শা’বিরিদ খান, মুহম্মদ আকিল, হাজী মুহম্মদ নেওয়াজ, শেখ পরাণ; সতেরো শতকের কবি দৌলত কাজী, কোরেশী মাগন ঠাকুর, দোনাগাজী, আলাওল এবং আঠারো শতকের কবি মুহম্মদ ফসীহ, আলী রাজাসহ শতাধিক কবি ও তাঁদের কাব্যের সন্ধান তাঁর সংগৃহীত পুথির মাধ্যমেই পাওয়া গেছে। যেসব পন্ডিত মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাঁরা সবাই আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের ঋণ অকপটে স্বীকার করেছেন। কীভাবে তিনি এ কাজে আকৃষ্ট হলেন, সে-সম্পর্কে নিজেই বলেছেন : ‘অত্যল্প বয়সে (উনিশ-বিশ বৎসরের বেশী নয়) আমি মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগী হই। চ-ীদাসের পদাবলী পাঠ করিয়া-বিশেষত বাড়ীতে পূর্ব-পুরুষদের সঞ্চিত পুথি-পা-ুলিপির স্তূপ দেখিয়া সেই অনুরাগ বিশেষভাবে সমুত্থিত হইয়া উঠে। নিজ বাড়ীতে ও পাড়ার প্রতিবেশীর বাড়ীতে তখন হরহামেশাই পুথি পড়ার মজলিশ বসিত। কিছু না বুঝিলেও সেই মজলিশে গিয়া আলাওলের পুথি পড়া শুনিতাম। শুনিয়া শুনিয়া আমার ভাবপ্রবণ কিশোর হৃদয়ে যে আনন্দ জন্মিত তাহার স্মৃতি এখনও মুছিয়া যায় নাই। এইভাবে বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রতি আমার একটা অনুরাগ জন্মে। তাহাই ক্রমশ বাড়িতে বাড়িতে আমার মনকে সাহিত্যের বিশেষত-প্রাচীন সাহিত্যের রসাস্বাদনে একান্ত লোলুপ করিয়া তোলে।’

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের জন্ম ১৮৭১ সালের ১০ অক্টোবর; জন্মস্থান চট্টগ্রামের পটিয়া থানার সুচক্রদন্ডী গ্রাম। যে পরিবারে তাঁর জন্ম সেই পরিবারটির ধনের প্রাচুর্য না থাকলেও ছিল বিদ্যার গৌরব এবং বংশের আভিজাত্য। তাঁর পিতা মুন্শী নূরউদ্দীন, মাতা মিস্রীজান। মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় পিতৃহারা হন এবং মাতৃহারা হন সতোরো বছর বয়সে। পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে যাতে বঞ্চিত না হন সেজন্য পিতামহ তাঁকে মাত্র এগারো বছর বয়সে বিয়ে দেন চাচাতো বোন বদিউন্নিসার সঙ্গে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি পরিবারের সদস্যদের কাছেই, তারপর ভর্তি হন সুচক্রদন্ডী মধ্য বঙ্গ-বিদ্যালয়ে। পরে পটিয়া উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন এবং সেখান থেকে ১৮৯৩ সালের প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চট্টগ্রাম কলেজে এফ.এ. পড়ার জন্য ভর্তি হলেও শারীরিক অসুস্থতার কারণে পরীক্ষা দিতে পারেন নি। এর ফলে তাঁর শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে। তাঁর কর্মজীবন শুরু চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে। পরে শিক্ষকতা করেন সীতাকুন্ড মধ্য ইংরেজি স্কুলে। এখানে কিছুদিন শিক্ষকতার পর যোগ দেন চট্টগ্রামের সাব-জজ আদালতের শিক্ষানবিস হিসেবে। পরে চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসে কেরানি পদে চাকরি লাভ করেন। এই দায়িত্ব পালনকালে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পুথিসংগ্রহের চেষ্টার অভিযোগে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে চাকরিচ্যুত হন। পরে চট্টগ্রামের আনোয়ারা মধ্য ইংরেজি স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে নিযুক্ত হন। এখানে কিছুদিন চাকরি করার পর যোগ দেন চট্টগ্রাম বিভাগের ইন্সপেক্টর অব স্কুল অফিসের দ্বিতীয় কেরানির পদে। এখানে ২৮ বছর চাকরি করে ১৯১৮ সালে অবসরগ্রহণ করেন। বিভিন্ন সময় পেশা বদল করলেও পুথিসংগ্রহ ও সাহিত্য-সাধনা থেকে কখনও বিচ্যুত হন নি। 

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বহু পুরনো পুথিসংগ্রহ করে বাংলা সাহিত্যের বিস্মৃতপ্রায় কবিদের কবিত্ব ও কাব্যসম্ভার সামনে এনেছেন। এর ফলে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। জীবদ্দশায় বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ থেকে তাঁর নয়টি পুথি প্রকাশিত হয়; সেগুলো হলো-নরত্তম ঠাকুরের ‘রাধিকার মানভঙ্গ’ (১৩০৮), কবিবল্লভের ‘সত্যনারায়ণের পুথি’ (১৩২২), দ্বিজ রতিদেবের ‘মৃগলুব্ধ’ (১৩২২), রামরাজার ‘মৃগলব্ধ-সংবাদ’ (১৩২২), দ্বিজমাধবের ‘গঙ্গামঙ্গল’ (১৩২৩), আলী রাজার ‘জ্ঞানসাগর’ (১৩২৪), বাসুদেব ঘোষের ‘শ্রী গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস’ (১৩২৪), মুক্তারাম সেনের ‘সারদামঙ্গল’ (১৩২৪) এবং শেখ ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষ বিজয়’ (১৩২৪)। মুহম্মদ এনামুল হকের সঙ্গে তাঁর যৌথ নামে প্রকাশিত ‘আরাকান-রাজনভায় বাঙ্গালা সাহিত্য’ (১৯৩৫) গ্রন্থটির উপাদান-উপকরণ সবই তাঁর সংগৃহীত। ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সমিতি প্রকাশ করে তাঁর সম্পাদিত আলাওলের ‘পদ্মাবতী’র খন্ডিত অংশ। পুথি সংগ্রহের পাশাপাশি সম্পাদনায় যে দক্ষতা ও পান্ডিত্যের পরিচয় দিয়েছেন, তা বাংলার বিদ্বৎসমাজে প্রশংসিত হয়েছে। তাঁর সম্পাদিত প্রথম পুথি নরোত্তম ঠাকুরের ‘রাধিকার মানভঙ্গ’ সম্পর্কে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন : ‘তিনি (আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ) এই দুর্লভ গ্রন্থেও সম্পাদন-কার্য্যে যেরূপ পরিশ্রম, যেরূপ কৌশল, যেরূপ সহৃদয়তা ও যেরূপ সূক্ষ্মদর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা সমস্ত বাঙ্গালায় কেন, সমস্ত ভারতেও বোধ হয় সচরাচর মিলে না। এক একবার মনে হয় যে, যেন কোন জর্মান এডিটর এই গ্রন্থ সম্পাদনা করিয়াছেন।’ তিনি অনেক কবির পুথি সংগ্রহ করলেও বেশি অনুরাগী ছিলেন মহাকবি আলাওলের প্রতি। এই কবির রচিত ‘পদ্মাবতী’, ‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জামাল’, ‘সেকান্দারনামা’ এবং ‘সপ্তপয়করে’র মোট ৭৭ খানা পুথি সংগ্রহ করেন এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আলাওল সম্পর্কে লিখেছেন প্রায় পঞ্চাশটি প্রবন্ধ। পুথিসংগ্রহ তাঁর নেশা হলেও আগ্রহ ছিল সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে। পল্লি-বাংলার নির্মল প্রকৃতি ও লোকজীবনের নিরাভরণ রূপের মধ্যে কেটেছে তাঁর জীবন। ফলে লোকসাহিত্য তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে এবং সেগুলো তিনি সংগ্রহ করেন। লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর পঁচিশটির মতো প্রবন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে তাঁর প্রথম প্রবন্ধ ‘চট্টগ্রামের ছেলে-ভুলানো ছড়া’ প্রকাশিত হয় ‘সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা’য় (শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩০৯)। তিন লোকসংগীত, ছড়া, ধাঁধা, মেয়েলিগীত প্রভৃতি সংগ্রহ করেছেন। ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল।  তাঁর ৪৩১টি প্রবন্ধের মধ্যে ইতিহাস-ঐতিহ্য ও পুরাকীর্তি বিষয়ক প্রবন্ধ পাওয়া গেছে পঞ্চাশের অধিক। বাংলার ঐতিহ্যবাহী নগরী চট্টগ্রাম ছিল তাঁর অনুসন্ধানের কেন্দ্রবিন্দু। এ নগরীর ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি তাঁর অনুসন্ধিৎসায় নবমূল্যায়িত হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরীকে নিয়ে তিনি রচনা করেছেন ‘ইসলামাবাদ’ গ্রন্থ। অনেক গবেষক তাঁকে ‘বাঙালি মুসলমান সমাজে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চার পথিকৃৎ’ বলে অভিহিত করেছেন।

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ জীবনের সিংহভাগ সময় পুথিসংগ্রহ, সম্পাদনা এবং মূল্যায়নে নিয়োজিত ছিলেন। জাতির শেকড়ের সন্ধান এবং ঐতিহ্য-অন্বেষণকে তিনি জীবনের ব্রত করেছিলেন। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, বৃক্ষ যেমন শেকড়ের ওপর ভর করে বেঁচে থাকে, অট্টালিকা যেমন ভিত্তির ওপর টিকে থাকে, তেমনি একটি জাতির অস্তিত্ব টিকে থাকে তার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ভিত্তির ওপর, যদিও কালের যাত্রাপথে তাতে নানা পরিবর্তন, রূপান্তর এবং গ্রহণ-বর্জন সম্ভাবিত হয়। এমন উপলব্ধি থেকেই তিনি বলেছিলেন : ‘মাটি ভিত্তি করিয়া তাজমহল দাঁড়াইয়া আছে। সেই মাটির গুরুত্ব অনেকখানি। ইহা ছাড়া তাজমহল তৈরি সম্ভব ছিল না। তেমনি ঐতিহ্য-সম্পর্কবিহীন সংস্কৃতি-মাধ্যমও অসম্ভব। ঐতিহ্যে যাহা কিছু ভাল তাহার অনুসরণ এবং যাহা কিছু নিন্দনীয়, তাহার বর্জনেই নূতন জীবনাদর্শের সন্ধান মিলে। সংস্কৃতির রূপান্তরও এইভাবেই ঘটে, অগ্রগতিও আসে এই পথে।’ জীবদ্দশায় যেমন তেমনি মৃত্যুর পরেও স্বীয় কর্মের জন্য মূল্যায়িত হয়েছেন এবং সম্মান লাভ করেছেন। নদীয়া সাহিত্যসভা তাঁকে প্রদান করে ‘সাহিত্যসাগর’ উপাধি; চট্টল ধর্মমন্ডলী প্রদান করে ‘সাহিত্যবিশারদ’ খেতাব। বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বাংলা পুথির তালিকা (২ খন্ড)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার এবং বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সযতেœ সংরক্ষিত রয়েছে তাঁর সংগৃহীত পুথিসম্ভার। ১৯১৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আটটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য-সম্মেলনে তিনি সভাপতি এবং উদ্বোধক হিসেবে সম্মানিত হন। বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছে তাঁর রচনাবলি। এছাড়া বাংলা একাডেমি এবং এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্মারকগ্রন্থ’। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে প্রদান করেছে স্বাধীনতা পদক (১৯৯৫)। শেকড়-সন্ধানী ও ঐতিহ্য-অনুসন্ধিৎসু এই মনীষী বাঙালির হৃদয়-মনন থেকে কোনোদিন বিস্তৃত হবেন না। 

সর্বশেষ খবর