শুক্রবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বাংলা একাডেমি এবং বরকতুল্লাহ

নীলুফার বেগম

বাংলা একাডেমি এবং বরকতুল্লাহ

লক্ষণীয় যে, এই তিনটি শব্দেরই আদ্যাক্ষর ‘ব’ দিয়ে। প্রকৃত পক্ষে তিনটি শব্দই একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোন শব্দই নিরেট শব্দ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশ, প্রতিষ্ঠান, মানুষ। প্রতিটি শব্দই বঙ্গময়।

বর্ধমান হাউস পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়াদী উদ্যান) বলেন, ‘Urdu, and Urdu shall be state Language of Pakistan’ এই বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করে ছাত্ররা চিৎকার করে ‘No, No. এটা ছিল ভবিষ্যতের এক অলঙ্গনীয় দিক-নির্দেশনা। বাংলা ভাষা এবং বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠার বীজ বপন হয় সেই সময়ই। এরপর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ এবং ভাষা এগিয়ে চলে অপ্রতিরোধ্য ভবিষ্যতের দিকে।

পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন দুই প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এবং নুরুল আমীন বর্ধমান হাউস সরকারি ভবনে বাস করতেন। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের সময় এই ভবন থেকেই সমস্ত দমন-পীড়নের নির্দেশ আসত। সেই কারণে মানুষের মনে এই ভবনটির ওপর এক বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়। ১৯৫২ সালের ২১-২২ ফেব্রুয়ারি যে বর্বর ধ্বংসলীলা চালানো হয়, সেই নির্দেশনাও আসে এই ভবন থেকেই। সালাম, বরকত, রফিক আরও কত জানা-অজানা তরুণের বুকের তাজা রক্তে সেদিন ঢাকার রাজপথ রক্তে ভিজে ওঠে। সে কারণেই এই বর্ধমান হাউসেই বাংলা ভাষার গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার জোর দাবি ওঠে।

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন সৈয়দ আজীজুল হক (নান্না মিয়া)। তিনি শিক্ষা বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি মোহাম্মদ বরকতুল্লাহকে বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করার নির্দেশ দেন। এর পূর্বে সরকারের সঙ্গে একাডেমি সংক্রান্ত সমস্ত চিঠিপত্র তিনিই চালাচালি করতেন। এই সময়ে তাঁর অবসর গ্রহণের সময়ও হয়ে এসেছিল। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহকেই বাংলা একাডেমি গঠনের গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি হন বাংলা একাডেমির প্রথম স্পেশাল অফিসার। বাংলা একাডেমি

বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠালগ্নে এটি ত্রিতল ভবন ছিল। খাজা নাজিমুদ্দিন এবং নরুল আমীন এই ভবন ছেড়ে যাওয়ার পর এটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ও ছাত্রাবাসে পরিণত হয়। পশ্চিম দিকের ৩টি কক্ষ নিয়ে বাংলা একাডেমির যাত্রা শুরু হয়। প্রথম একটি মাত্র কক্ষে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ তাঁর আরাদ্ধ কাজ শুরু করেন। সঙ্গে একজন মাত্র পিএস এবং একজন টাইপিস্ট ছিল। কক্ষে কোন আসবাবপত্র ছিল না। বরকতুল্লাহ ঘরের মেঝেতে পত্রিকা বিছিয়ে এক দুরূহ কাজের অভিযানে এগিয়ে যান। নতুন একটি প্রতিষ্ঠান শুরু করতে তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। যে কোনো কাজের ভিত্তি স্থাপন করাটাই সবচেয়ে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ। এরই উপর নির্ভর করে ধীরে ধীরে বহুতল ভবন নির্মিত হয়ে থাকে।

১৯৫৫ সালে ২ ডিসেম্বর নবগঠিত বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হলে এর গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয় মোহাম্মদ বরকতুল্লাহকে। এর পূর্বে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার অন্তর্ভুক্ত বাংলা ভাষার গবেষণাগার

পরিকল্পনার দায়িত্ব তাঁকেই দেওয়া হয়। তখন পর্যন্ত বাংলা একাডেমির গঠন প্রক্রিয়া কি ধরনের হবে সে সম্বন্ধে কোন পরিষ্কার ধারণা ছিলনা।

মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ দিল্লি সাহিত্য একাডেমির নিয়মাবলি সংগ্রহ করেন। সেই সঙ্গে বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ একাডেমির নিয়মাবলিও সংগ্রহ করেন। ফ্রেঞ্চ একাডেমির অনুসরণেই বাংলা একাডেমি গঠন করা হয়। এর আইন ও অন্যান্য নিয়মাবলি খসড়া তৈরি করা হয়। উক্ত খসড়া ১৯৫৭ সালে বরকতুল্লাহ চলে যাওয়ার পর পরিমার্জিত হয়ে আইন সভায় পাস হয়।

বাংলা একাডেমির কাজ পরিচালনা করার জন্য একটি আয়োজক কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটিতে ছিলেন, ড. কুদরত-ই খোদা, ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. শহীদুল্লাহ, ড. এনামুল হক, খান বাহাদুর আবদুর রহমান এবং শিক্ষা বিভাগের মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ। ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর হতে ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৫ মাস বাংলা একাডেমির প্রথম স্পেশাল অফিসার ছিলেন। এই ১৫ মাস তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্ব ও মমতার সঙ্গে পরিচালনা করেন। বাংলা একাডেমির ৩টি বিভাগ ছিল ১। অনুবাদ বিভাগ, ২। গবেষণা বিভাগ ৩ প্রকাশনা বিভাগ।

বরকতুল্লাহর কার্যকাল ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন বার বৃদ্ধি করা হয়। কঠোর পরিশ্রমে তাঁর শরীরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যে বাংলা একাডেমির স্পেশাল অফিসার রূপে একাডেমির নিয়মাবলি এবং গঠন প্রক্রিয়ার যে রূপ রেখা তৈরি করে দিয়ে যান, তারই পথ ধরে ধীরে ধীরে বাংলা একাডেমি বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ।

১৯১৮ র্খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর অন্তর্গত ঘোড়শাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তাঁর অসীম জ্ঞানপিপাসা এবং সাহিত্যে আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। বাল্যকাল থেকেই তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে একর পর এক স্কুলের গণ্ডি পার হতে থাকেন। আই এ পরীক্ষায়ও তিনি বৃত্তি লাভ করেন। এরপর তিনি উচ্চতর ডিগ্রির জন্য কলকাতায় পাড়ি জামান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি দর্শনশাস্ত্রে অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।

ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ার সময় থেকেই তিনি হাতে লিখে স্কুলে ম্যাগাজিন রচনা করেন। সেই হাতে লেখা রচনাবলিতে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য এবং সুললিত কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। কবিতা দিয়েই তাঁর সাহিত্য হাতে খড়ি হয়। বি,এ পড়ার সময় তাঁর সুবিখ্যাত রচনাবলি ‘পারস্য প্রতিভা ২য় খণ্ড’ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে সমস্ত সুধী মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর ছাত্রাবস্থায়ই প্রকাশিত হয় তাঁর গুরুগম্ভীর রচনা মানুষের ধর্ম। এটিও সুধী মহলে ব্যাপক সমাদৃত হয়।

এরপর দীর্ঘ সময় সরকারের উচ্চপদস্থ চাকুরিত থাকা অবস্থায় আর গ্রন্থ রচনায় সময় দিতে পারেন নাই। দীর্ঘ ৩০ বছর চাকরি শেষে তিনি পুনরায় লেখালেখির জগতে প্রবেশ করেন। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তাঁর মনমানসিকতার পরিবর্তন ঘটে। এই সময়ের লেখাগুলি মুসলিম ঐতিহাসিক মনীষীগণের জীবনভিত্তিক বীরত্বগাথা। ‘কারবালা ও ইমাম বংশের ইতিবৃত্ত’, ‘নবীগৃহ সংবাদ’, ‘নয়াজাতি শ্রষ্টা হজরত মুহাম্মদ (স)’, ‘হজরত ওসমান।

তিনি লিখেছেন অল্প। কিন্তু অল্প দু-একটি লেখাও একজন লেখককে স্মরণীয় রাখতে যথেষ্ট। তাঁর লেখা এবং তাঁর হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে।

সর্বশেষ খবর