ষাটোর্ধ বয়সের মতিন দেওয়ান লোক ভালো, কিন্তু একটু খিটখিটে। দুপুর বেলা তিনি খেতে বসেছেন। বাইরে বৃষ্টি এবং ঘন ঘন বজ্রপাতের শব্দ হচ্ছে। এমন সময় কে একজন ঘরের দরোজা খুলে ভেতরে ঢুকল। মতিন দেওয়ানের ধারণা ছিল দরোজায় লক দেওয়া। তারপরও ঘর খুলে ভেতরে ঢোকায় তার হঠাৎ প্রাইভেসি নষ্ট হয়েছে বলে মনে হলো। খাবার টেবিল থেকে উচ্চস্বরে বললেন, না বইলা ঘরে ঢুকলো কোন শালার পুত রে!
প্রবেশকারী খাবার ঘরের দরোজার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার মুখে হাসি। বছর ২৫ বয়সের যুবক। সুঠাম, নিখুঁত দেহ। কোমরে একটি পিস্তল হলস্টার।
মতিন দেওয়ান স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ও হালার পুত, তুমি!হালার পুত শব্দটি যে একটি গালি যুবক বোঝে না। তার কাছে হালার পুত শব্দের অর্থ শ্যালকের ছেলে। যুবক বলল, আপনাকে এমপি মহোদয় যেতে বলেছেন।
তিনি ফোন করলেই তো পারতেন?
জানি না কেন, তিনি বলেছেন আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে।
আমি না গেলে কি তুমি গুলি করবা নি?
তা জানি না, এমপি সাহেব যেমন সিগন্যাল দেবেন।
মতিন রসের সঙ্গে বললেন, তারমানে হইল, তুমি বর্তমান যুগের লাঠিয়াল। রোবট লাঠিয়াল।
রোবট কোনো কথা বলল না।
মতিন দেওয়ান এক টুকরো মাছ পাতে তুলে নিতে নিতে বললেন, তোমারে ভাত খাইতে কমু কি, তোমরা তো কিছু খাওনা। শুধু ইলেকট্রিক চার্জ খাও। প্লাগ দিয়া চার্জ দিলেই তারপর ‘যেমনি নাচাও তেমনি নাচি পুতুলের কি দোষ!’
জি না স্যার। আপনার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আমরা কোনো ইলেকট্রিক চার্জ খাই না। তাইলে চলো ক্যামনে?
যখন শরীরটা দুর্বল বোধ করি তখন গায়ে রোদ লাগালেই সব ঠিক হয়ে যায়।
মতিন মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, তাইলে তোমরা রোইদের থিকা চার্জ খাও? সোলার এনার্জি আর কি!
জি। জগতের সবকিছুই সোলার এনার্জির উপর নির্ভরশীল স্যার। আপনারাও।
মতিন বললেন, আমাগো তো আর রোদে দাঁড়াইয়া চার্জ খাওয়া লাগে না।
লাগে স্যার, আপনারা বোঝেন না। প্রাণী হিসাবে মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং সবচেয়ে অসচেতন।
মতিন দেওয়ান প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বললেন, আচ্ছা, তোমার দেশের বাড়ি কোথায়, মানে তুমি কোন দেশে তৈরি?
রোটারড্যাম, নেদারল্যান্ডস।
ভালো ভালো। আগে আসতা জলদস্যু হইয়া, এখন আসতেছ রোবট সাইজা। খুব ভালো।
মতিন দেওয়ান ঘর থেকে বের হলেন। পেছনে রোবট ছেলেটা হাঁটছে। গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত গিয়ে মতিন বললেন, তোমার নাম কী?
ইএম- ৪২টি। এমপি সাহেব নাম রেখেছেন র্যামবো।
মতিন দেওয়ান সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান। তিনি মনে মনে ভাবলেন, এইবার চেয়ারম্যান হইতে পারলে তিনিও একটা রোবট কিনবেন। একটু মোটা সোটা দেখে কিনবেন। নাম রাখবেন আজিজ পালোয়ান। এক সময় তাদের অঞ্চলে একজন পালোয়ানের নাম ছিল আজিজ।
হঠাৎ রোবট ছেলেটি বলে উঠল, কিনলে নেদারল্যান্ডস থেকে কিনবেন! আমেরিকারটা কিনবেন না!
মতিন দেওয়ান ভয় পেয়ে গেলেন! লজ্জাও পেলেন। এ শালা দেখি মনের কথা সব পড়তে পারে! কী মুশকিল! একটু আগে লিফট দিয়ে নামার সময় তিনি দোতালার একটি মেয়ে দেখেছেন। মেয়েটাকে দেখা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি মনে মনে চুমা দিছেন, জড়ায় ধরছেন, আরো নানা কিছু করেছেন। অথচ পোলার বয়সী একটা রোবট পাশে থেকে সব বুঝল!
বাবাজি, তুমি কি মানুষের মনের কথা সব বুঝতে পার?
না, কিছু কিছু বুঝি।
বাবাজি, তুমি তোমার গাড়িতে যাও, আমি আমারটায় যাই, ঠিকাছে?
ঠিকাছে।
এমপি সাহেবের বাসায় গিয়ে মতিন ভেতরের রুমে বসলেন। এমপি সাহেবের কাছে দাবি জানালেন, তিনি রোবোটের সামনে কোনো কথা বলবেন না। এমপি মহোদয় রোবটকে বের হয়ে যেতে বললেন। এমপি নির্বাচনের নোমিনেশন পেতে ১০ কোটি টাকা দাবি করলেন। মতিন বললেন, এত টাকা আমি চোখেও দেখি নাই। শেষ পর্যন্ত মুলামুলি করে ৬ কোটি নির্ধারণ হলো। মতিন দেওয়ান দরোজা খুলে বের হয়ে দেখলেন রোবট ছেলেটি দরোজার পাশে দাঁড়ানো। এমপি সাহেব রোবোটকে নির্দেশ দিলেন মতিন সাহেবকে সম্মানের সঙ্গে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে।
মতিন হাঁটতে হাঁটতে বললেন, বাবাজি, এমপি সাহেব লোক কেমন? ছেলেটাকে একটু যাচাই করার চেষ্টা।
অসাধারণ। তার মধ্যে লোভ কেমন?
লোভ নাই। মেয়েলি ব্যাপারে চরিত্র কেমন?
একদম পবিত্র।
মতিন সাহেবের মনটা দমে গেল। মনে মনে বললেন, শালা রোবট তুমি বাল জানো! ভেবেই একটু বিব্রত হলেন। ছেলটা কি মনের কথা পড়ে ফেলল? তিনি হেসে গাড়িতে উঠলেন।
রোবট তাকে বিদায় দেওয়ার শেষ মুহূর্তে গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ফেলল। বলল, আমার কাছে যত প্রশ্নের উত্তর শুনলেন, সবই এদেশে প্রোগ্রাম করা। কিন্তু আমাকে তৈরি করা কোম্পানি এত বেশি ইন্টেলিজেন্স আমার মধ্যে দিয়েছে যে নিজের কিছু বুদ্ধি তৈরি হয়েছে। আপনারা যাকে ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলেন, তেমনি।
তোমার সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় কী বলে, বাবা?
আপনারা জাতি হিসাবে নিম্নমানের। যে যত উঁচুতে, সে তত ডার্টি।
মতিন দেওয়ান অবাক তাকিয়ে থাকলেন। বললেন, বাবাজি, একটা কথা। আমেরিকার রোবট কিনতে নিষেধ করলা কেন?
ওদের ভেতরে এমন চিপস বসিয়ে দেওয়া আছে যে অটোমেটিক সব তথ্য আমেকিরায় চলে যাবে। আপনি পয়সা দিয়ে রোবট কিনবেন, তারে দিয়ে ফুটফরমায়েশ করিয়ে তৃপ্তি নেবেন। আর আমেরিকার পাবে আসল সেবা। ওটাই চিরকালীন আমেরিকা।