শুক্রবার, ১ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ছায়ার রাজ্যে

হুসেইন ফজলুল বারী

ছায়ার রাজ্যে

মেঘলা আকাশের নিচে এ যেন এক ছায়ার রাজ্য। উত্তর বিলেতের এই ছোট্ট শহর শেফিল্ডে পিএইচ.ডি করতে এসেছি। এয়ারফোর্টে রিসিভ করতে আসা এক রসিক বন্ধু হেসে বলল, শেফিল্ডে মানুষের চেয়ে বৃক্ষ বেশি, কুলবধূর চেয়ে অভিসারিকা বেশি! বন্ধুর পথ পেরিয়ে শহরে ঢোকার পথে উৎসুক আমি বাইরে বার বার তাকাই। কিন্তু রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা বলে অভিসারিকা দূরে থাক, সাধারণ পথিকের চলাফেরাও নগণ্য। অইতো, দেয়ালের ওপাশের লেন ধরে ঊরু কাঁপিয়ে বাইক চালায় ঝাঁকড়মাকড় চুলের এক ছিপছিপে তরুণী। চারদিকে ছায়াতরুর সারি। অজানা বৃক্ষরাজির মাঝে শুধু মেপল, ওক, বার্স আর পপলার গাছগুলো আমার চেনা। কেমন যেন তৃণময় ঘ্রাণ চারধারে। ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় নীলাভ পাহাড়ের ঢেউ। ছায়াঘন সানুদেশে চরে বেড়ায় অলস গড্ডালিকার পাল। গোমড়ামুখী আকাশের বিষণœতা কেটে গিয়ে এখন আবার রোদ হাসছে  সন্তর্পণে- গাছের আড়ালে  কিংবা দালানের ফাঁক গলে। দীর্ঘ ল্যাম্পপোস্টগুলো হ্যাংলার মতো দাঁড়িয়ে আছে সটান হয়ে। জীর্ণ বাড়ির কার্নিশে বসে আছে পৃথুল পাখি-শাদাকালো ম্যাগপাই। একটা নির্মাণাধীন ভবনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একদল বিষণœ শ্রমিক। তাদের ভারী জামাকাপড়ে ময়লা-রঙের ছিটে। উল্টোদিকে চোখে পড়ল প্রাগৈতিহাসিক এক ক্যাথিড্রাল। মেটে-রঙের এ গির্জার বুঝি বয়সের গাছপাথর নেই। পরে জেনেছি, মূল চার্চের গোড়াপত্তন করা হয় হাজার বছর আগে। গির্জাপ্রাঙ্গণে অমসৃণ ঘাসের বিস্তার। কিছু বিক্ষিপ্ত পাতা চারদিকে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে। হলদেটে-লালচে-সবুজাভ পাতা নিয়ে কয়েকটা মেপল গাছ দাঁড়িয়ে আছে গরিবি-হালতে। কাঠের বেঞ্চিতে বুড়ো-বুড়ি দম্পতি হাত ধরাধরি করে বসে আছে। বুড়ির মুখের বলিরেখা অনেকটাই ঢেকে গেছে চোখে-আঁটা কালো চশমার আড়ালে। বামপাশে ঠেস দেওয়া একটা শাদা-ছড়ি দেখে অন্ধ বৃদ্ধার জন্য মায়া হলো খুব। টুংটাং শব্দে সচকিত হয়ে দেখি-আজাদাহ সাপের মতন ট্রামও চলছে এঁকেবেঁকে-সমান্তরাল লাইন ধরে। আরেকটু এগোতেই প্রাণময় লতাগুল্মের সমারোহ। এটি ইউরোপের সবচেয়ে সবুজ নগর।

অবশ্য শাদা ইস্পাতের জন্যও শহরটি বিখ্যাত ছিল এক সময়। এখানকার কাঁটাচামচ আর ছুরি ছিল জগদ্বিখ্যাত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আঁচ এখানে ভালোমতো লেগেছিল। যুদ্ধের ক্ষত না শুকাতে শুকাতে আবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলো। শেফিল্ডে গোপনে সমরাস্ত্র বানানো শুরু হলে হিটলার বাহিনী টের পেয়ে মুহুর্মুহু বোমা মারতে শুরু করে। ইস্পাতের শহরটি তখন রাতারাতি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বলে রাখি, ইংল্যান্ডের শিল্প-বিপ্লবে এই এলাকার শ্রমজীবী মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। এখনো কিছু মৃতপ্রায় কারখানা থেকে ঠক ঠক শব্দ হয়। বিসদৃশ ধোঁয়াও ওড়ে দালানের বহির্মুখী পাইপজুড়ে। তবে ইউরোপের নতুন রাজনৈতিক বলয় আর প্রযুক্তির ভিন্নতর উৎকর্ষের প্রভাবে গত কয়েক দশকে সাবেক জৌলুসময় কারখানাগুলো প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। তবে কেলাম আইল্যান্ড এলাকায় এখনো বিশাল বিশাল স্থাপনা, ক্রুসিবল, ইস্পাতের গোল্লা চোখে পড়ে।

সেই সুবর্ণ সময়ে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা কাজের অবসরে ফুটবল খেলত। মিল মালিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় ছাপমারা জার্সি-বুট পরে তারা জানবাজি করে লড়ত। এভাবেই অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্ন দল  মিলে প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট শুরু হয় এদিকে। আজকের জমজমাট ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের আঁতুড়ঘর কিন্তু সাবেক শিল্পশহর শেফিল্ড। শেফিল্ড ইউনাইটেডই আধুনিক বিশ্বের প্রথম পেশাদার ফুটবল টিম। ইদানীং লিগ টেবিলের তলানিতে থাকা দলটি খাবি খেয়ে খেয়ে রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী দলটির হোম-ম্যাচের দিন এখনো রীতিমতো সাড়া পড়ে যায়। শহরতলির চাষভুসো পর্যন্ত লাল-শাদা জার্সি পরে প্ল্যাকার্ড নিয়ে খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে হাজির হয়। অবশ্য বিলেতের চাষারা বেশ ধনবান। এরা ট্রাক্টরে আদিগন্ত জমি চাষ করে। তাদের শত-সহস্র ভেড়া  সবুজ উপত্যকায় হেঁটে বেড়ায়। চাষাদের কেউ কেউ আবার ব্যক্তিগত উড়োজাহাজেরও মালিক। তাদের আস্তাবলে খেলা উপলক্ষে প্রিয় দলটির পতাকা উড়ে। সেই উচ্ছ্বাস শহরেও সংক্রামিত হয়। খেলার দিন হকারের মাধুর্যময় হল্লায় শহরটি মুখরিত হয়ে ওঠে। ব্রামাল লেনের অস্থায়ী দোকানি ক্ষিপ্র হাতে সসেজ আর রুটি ভেজে ক্রেতার হাতে গুঁজে দেয়। পোড়াতেলের গন্ধে চারদিক আমোদিত হয়ে ওঠে। হাজার হাজার দর্শকের পদচারণায় পুরো নগর ব্যস্ত হয়ে ওঠে। অনেকের হাতে থাকে বিয়ারের ক্যান আর মাথায় প্রিয় দলের স্কার্ফ। ফুটবল উন্মাদনাটা বেশ জোরালো হলেও ‘ব্লেডস’ নামে পরিচিত শেফিল্ড ইউনাইটেড প্রায় দিনই শুধু গোল খায় আর হারে। দর্শকরা মন খারাপ করে মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়ে। কেউ কেউ বিশ্রী খিস্তি-খেউর করতে করতে পাবে যায়। খেলার দিনের এই মুখরতাটুকু বাদ দিলে শেফিল্ড মূলত এক নিস্তরঙ্গ জনপদই।

এক দশক আগে ছিলাম কসমোপলিটন সিটি লন্ডনে। বলতে গেলে লন্ডনের তুলনায় শেফিল্ড ছিমছাম-শান্ত শহর-অনেকটা মফস্বলের মতো। মনে পড়ে, ব্যস্ত রাজধানী-শহরের মানুষজন হন্তদন্ত হয়ে একদম নিশ্চুপ হয়ে পথ চলত। এখনো লন্ডনবাসীরা কাজে-অকাজে রীতিমতো ছোটে বা দৌড়ায়। দূরযাত্রায় তাদের মূল বাহন ছিল পাতালরেল। এখনো ভূগর্ভস্থ আধুনিক ট্রেন চলে হুসহাস। শ্বেতাঙ্গ রেলযাত্রীদের অনেকের হাতে বই। তরুণীরা ট্রেনের ভিড়েও নিবিষ্টমনে আরশিতে তাকিয়ে সাজগোজ করত। পাতালরেলে প্রায়শই মুগ্ধ প্রেমিকপ্রবরকে প্রেয়সীর আধখোলা-ঠোঁটে টুক করে চুমু খেতে পর্যন্ত দেখেছি। ইঁদুরদৌড়ে অভ্যস্ত লন্ডনবাসীরা কেউ কারও দিকে ফিরেও চাইত না। তাদের আচরণটা ছিল খানিকটা রুক্ষ। বিখ্যাত টেমস নদীতে বয়ে চলত নানান কিসিমের কলের নৌকা। আবার মুহুর্মুহু লালবাস চলতে দেখেছি রাজপথ কাঁপিয়ে- একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে। পথেঘাটে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যাও দেখেছি  অজস্র। আমি বেকুবের মতো দোতলা বাসের সামনে বসে ফুটপাত ধরে ছুটে চলা মানুষজন দেখতাম। বর্ণিল লন্ডনের পরতে পরতে ইতিহাস-ঐতিহ্যের হিরে-জহরত তো ছড়িয়ে ছিটিয়েই রয়েছে। তাই বাস থেকে নেমে ধাবমান লন্ডনবাসীদের ভিড়ে মন্থর পায়ে হেঁটে হেঁটে আমি বিলেতি সৌরভ খুঁজতাম। এমনি করে লন্ডনের প্রাণময় গণউদ্যান, সমৃদ্ধ জাদুঘর বা পুরনো গ্যালারি দেখে দেখে হয়রান হতাম।

কিন্তু মফস্বলের মানুষ বলেই হয়তো শেফিল্ডবাসীরা ছোটে না; বরং এখনো হাঁটে। এখানে সাদা-নীলচে বাসও আসে কিছুটা ধীরলয়ে। অলস যাত্রীরা গল্প-গুজবে মশগুল হয়ে অবলীলায় যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করে। দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া অপেক্ষারত মানুষদের মাঝে খুব তাড়াহুড়া বা বিরক্তিও দেখিনি। ন্যাড়া মাথার মোটাসোটা বাসচালক রয়ে সয়ে টিকিট দিলে যাত্রীরা ‘চিয়ার্স’ সম্ভাষণ করে। বাসের যাত্রীরা মূলত শ্বেতাঙ্গ মানুষ। এদের মাঝে বৈচিত্র্য বলতে দুয়েকটা পোষা কুকুর আর কিছু অভিবাসী। আর রাজধানী লন্ডনে কত জাত-বেজাতের মানুষজনের আনাগোনা দেখেছিলাম। এর তুলনায় শেফিল্ডে ছাত্রদের বৈচিত্র্য বাদ দিলে শুধু গোরা মানুষের ছড়াছড়ি। সারা শহরজুড়ে ছোট ছোট লালচে, মেটে আর ধূসর ভবন। জানালার কাঠামো শাদা বা মেরুন। শীতে তুষারপাত হয় বলে আবাসিক ঘরের ছাদগুলো দোচালা। মাঝে মাঝে চোখ ধাঁধানো বিভিন্ন চেইনশপের বর্ণিল উপস্থিতিও লক্ষণীয়। বেশ কিছু রুপালি অট্টালিকা আছেও সিটি সেন্টারজুড়ে। তবে সবচেয়ে উঁচু ভবনটি হলো শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির আর্টস টাওয়ার। ১৯৭০ সালে এই রানী এলিজাবেথের মায়ের উদ্বোধনকরা আকাশচুম্ব^ী দালানটি ইংল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ভবন। আর এই ভবনের ট্রেডমার্ক বিশেষ ধরনের উন্মুক্ত লিফট। নির্ভীক শিক্ষার্থীরা লিফটে চড়ে এই দালানের মাথায় উঠে পাখির-চোখে শেফিল্ড দেখে। খোলামেলা এই ‘পেটারনসটার লিফটে’ উঠতে এক ভয়ার্ত সহপাঠিনী কপট ব্রিড়ায় হাহাকার করে উঠে-এত উঁচু? আমি  হেঁয়ালি করে বলি, চল, দুজনে মিলে আকাশ ছুঁই! মুগ্ধ তরুণী কপট ঘুষি পাকিয়ে বলে, নওটি। হাসি আর খুনসুটি ছাপিয়ে পরবর্তী অনলাইন-সেমিনারের গুগল-ক্যালেন্ডার বেজে ওঠে। জিভ কেটে তটস্থ হয়ে আমি হোস্টেলের দিকে পা বাড়াই।

বলে রাখি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব হোস্টেল ছাড়াও বেসরকারি ছাত্রাবাস বা মেসবাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সারা শহরজুড়ে। এখনো বেশ কিছু বাড়িতে ‘টু লেট’ লেখা সাইনবোর্ড ঝোলে। ব্রিটিশ আমলে এক কাঠবাঙাল বিলেতে এসে নাকি অবাক হয়ে বলেছেন, সব বাড়ির মালিক তো দেখি ‘টু লেট’ সাহেব! একটা পুরনো বাড়ির ঝুল-বারান্দায় কয়েকটা অচেনা পাখি নিশ্চুপ ঝিমায়। বাড়িটির পেছন দিকে সরু-পাইপ দিয়ে ধোঁয়া উড়ে। কুঞ্জুস ছাত্রদের কেউ একজন সেখানে চিলেকোঠা বা ভূগর্ভস্থ কুঠুরি খুঁজতে গিয়ে বৃদ্ধা মালকিনের একপাল বিড়াল দেখে পালিয়ে বেড়ায়। যা হোক, শিক্ষাবর্ষের শুরুতেই বিভিন্ন জায়গায় সব শিক্ষার্থীর আবাসের বন্দোবস্ত হয়ে যায়। লন্ডনের তুলনায় এখানকার বাড়িভাড়া জলের দর। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় শহরের অলিগলি মুখরিত হয়ে ওঠে। আলোর পথের যাত্রীদের কাঁধে ল্যাপটপ আর হাতে কফিমগ। মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিড়াল পায়ে নিঃশব্দে হেঁটে লাইব্রেরিতে হাজির হয়। বাঙালি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা হাতেগোনা। এখানেও দলাদলির রেশ! তবে প্রায়-নির্মীলিত চোখের হলদে রঙের ফুটফুটে চাইনিজরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। ডায়মন্ড লাইব্রেরির পাশ দিয়ে দলবেঁধে হেঁটে হেঁটে তারা ইচিংবিচিং স্বরে কথা কয়। কিছুদিন আগে এক চায়নিজ শিক্ষার্থীকে পেছন থেকে কেউ একজন হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে বেশ শোরগোল পড়ে যায়। ম্যানচেস্টার থেকে স্বয়ং চিনের কনসাল জেনারেল এসে আমাদের ভাইস চ্যান্সেলরকে ভদ্র ভাষায় শাসিয়ে গেলেন, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির আটাশ শতাংশ টিউশন ফি চায়নিজরা পরিশোধ করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আনুষ্ঠানিক দুঃখ প্রকাশ করার আগ পর্যন্ত চাইনিজরা আরেকটা মহাযুদ্ধের জোশ দেখায়। তখন আমি স্বয়ং চায়নিজ ছাত্র পরিষদের সভাপতির হাতে ‘আর্ট অব ওয়ার’ বইটা দেখেছি! অবশ্য কয়েক দিনের মধ্যেই ত্বরিতকর্মা পুলিশ এক মাদকসেবী মেয়েকে শনাক্ত করে আদালতে সোপর্দ করে। তবে এরূপ বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা বাদ দিলে শেফিল্ড কিন্তু বেশ নিরাপদ-প্রাণময় জনপদ।

শিক্ষাবর্ষের শুরুটা কেটে যায় চোখের পলকে। দিন বেশ ছোট হয়ে এসেছে এই গোলার্ধে। গাছের শীর্ণছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। ছায়া-সুনিবিড় নগরে ছন্নছাড়া অন্ধকার ঘনিয়ে আসে বেশ আগেভাগেই। ঠান্ডা হাওয়া এসে দীঘল গাছে বাড়ি খায়-বুকে লাগে। আধ-মাতাল এক দীর্ঘ পুরুষ পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ঘোলা চোখে তাকায়। তার মুখে আগুনবিহীন সিগারেট আর গায়ে যেন চামসে গন্ধ-কয়দিন গোসল করে নাই কে জানে। এই শিতল জনপদের বাসিন্দাদের স্নানে ও জলশৌচে বেশ অনীহা। পশ্চিমের কোথাও জলশৌচের বদনা তো দূরের কথা টয়লেটে পানির বন্দোবস্তও নাই। কী খবিশি কারবার, টিস্যু পেপারই ভরসা! জাপানে আর তুরস্কে দেখেছি স্বয়ংক্রিয় জলশৌচের চমৎকার ব্যবস্থা। কল্পনা করা যায়, রানী প্রথম এলিজাবেথ নাকি জীবনে কখনো পরিপূর্ণ অবগাহন করেননি! অপরূপ সুন্দরী এই নারী শুধু মাসে একবার গায়ে পানি ছিটাতেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, খেয়ালি এই নারী প্রায়ই প্রেমে পড়তেন, যেন শঙ্খচূড় সাপের মতো ঘন ঘন খোলস পাল্টানোর ব্যাপার। তার রাজনীতি বা প্রেমের চাল ছিল একদম অননুমেয়। একবার অবিশ্বস্ত প্রেমিক ওয়াল্টার র‌্যালেকে দিলেন সম্ভবত মানব-ইতিহাসের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী শাস্তি। নতুন প্রেমিক তেইশ বছর বয়সী এলেক্সের সঙ্গে রানীর অভিসারের সময় সাবেক প্রেমিক র‌্যালে দরজার বাইরে প্রহরীর দায়িত্ব পালন করবেন! অবশ্য রানী আবার কী এক ছুতোয় প্রেমিক এলেক্সকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে বসলেন। ভূতপূর্ব প্রেমিক র‌্যালে আবার ঠাঁই পেলেন পঞ্চাশ বছর বয়সী এলিজাবেথের বুকে।

যা হোক, এসব ভাবতে ভাবতে অসমতল পথ বেয়ে হলে ফিরি জবুথবু গির্জার পাশ দিয়ে। অভ্যাসমতো গা ধুয়ে হালকা খেয়ে হিটার অন করে নিরাপদ শয্যায় গা এলিয়ে দিই। তখন চোখে ভর করে কুম্ভকর্ণের ঘুম। নির্জন-নিমগ্নতায় দীঘল রাত পার হয়ে যায় নিমিষে। ভোরের দিকে কাচের জানালা দিয়ে দেখি, বরফ-শীতল বাতাস এড়িয়ে আজানুলম্বি^ত কোটপরা শ্রমজীবী মানুষজন দস্তানা হাতে হন্তদন্ত হয়ে যাত্রীছাউনিতে ছুটছে। এই সময়ে বাতাসের ঝাপটায় পাতাপ্রপাতও হয়। টুপ টুপ শিশির পড়ে। প্রথম আলো ফুটবার আগেই বাস-ট্রাম চলতে শুরু ধীরলয়ে। সন্ধ্যা রাতেই ঘুমিয়ে পড়ে বলে বিলেতি মানুষজন আর্লি রাইজার। বাঙালিদের মতন মাঝরাতে পেটপুরে খাবার-খাওয়া আর টকশো দেখা তাদের শাস্ত্র-নিষিদ্ধ। সুঠাম অনেকেই ভোরে উঠে ব্যায়াম করে। কেউবা তাজা পাউরুটি, মাখন, দুধ, ফলমূল কিনে এনে প্রাতঃরাশ সারে। এরপর আয়েশ করে সুরভিত-কফি খেয়ে পরিপাটি পোশাক করে যে যার কাজে চলে যায়। আস্তে আস্তে কর্মমুখর মানুষজনের আনাগোনায় আশপাশ জমজমাট হয়ে ওঠে। ছায়াঢাকা আকাশও মাঝে মাঝে আলোর ছোঁয়ায় পাটভাঙা শাড়ির মতো ঝলমল করে ওঠে। আবার আকাশ গুমরে কাঁদে অভিমানী কিশোরীর মতো। কফিশপ থেকে কেমন পোড়া-পোড়া সৌরভ ভেসে আসে। বিলাসী তরুণ-তরুণীর দল রোদে ভিজে হেসে গড়াগড়ি খায়। অনেকে হাজির হয় বিখ্যাত সব ফ্যাশন হাউসে। কেউ উইন্ডো-শপিং করে খ্যান্ত হয়। স্টাইলিশ কেউবা মুফতে পেয়ে গ্রীবায়-কবজিতে সুরভি মাখে। খুশবু ছড়িয়ে পড়ে চারধারে। পরিপাটি কর্মচারীরা হেসে সবাইকে সম্ভাষণ জানায়। এতটুকু বিরক্তি নেই। 

এই জনপদে সযতেœ রক্ষিত অজস্র পার্ক। শেফিল্ডের মোট আয়তনের ষাট শতাংশ সবুজ। গাছের আগায় আগায় নানান কিসিমের পাখির ঝাঁক। বৃক্ষের গোড়ায় কালচে শিকড়। আশপাশে শুকনো পাতা। ছোট্ট জলাশয়ে হাঁস চরে নিশ্চুপ। একটু বেলা হলে অনিন্দ্যসুন্দর পিচ গার্ডেন পেরিয়ে বেরিয়ে আসে বুড়ো-বুড়ির দল। এ সময় মনে হয় এই শহর বুঝি বুড়ো মানুষের আখড়া। তারা মিঠে রোদ গায়ে মেখে বিশাল বিশাল সারমেয় নিয়ে হাঁটে। তাদের গন্তব্য বিভিন্ন পার্ক। অনেকের মাথায় বাহারি হ্যাট আর রোদচশমা। চোখাচোখির হলেই এরা হেসে সম্ভাষণ জানায়, হ্যালো, মাই লভ। লন্ডনে কোনো আগুন্তুককে এভাবে সম্ভাষণ জানাবার চল খুব একটা দেখিনি। নিরিবিলি হাঁটার পথে অনভ্যস্ত আমি চমকে ওঠে অপ্রস্তুত হেসে ‘হাই’ বলে থামি। একটা লোমশ কুকুর কাছে ঘনিয়ে এলে আমি আতঙ্কগ্রস্ত হই। বৃদ্ধ এগিয়ে এসে হেসে বলেন, ইউ ওকে, মাই লভ? বিপন্ন আমাকে দেখে তিনি মায়াবীস্বরে বলেন, কুকুরের চোখে চোখ রেখে পিটপিট করলে এরা ফ্রেন্ডলি হয়ে যায়। আমি ঢোঁক গিলে মনে মনে বলি, কত অজানারে! সম্ভবত শেফিল্ডে এই আমার প্রথম সবক। বলে রাখি, ইয়র্কশায়ার-উচ্চারণে এরা ‘লাভ’কে ‘লভ’, ‘বাস’কে ‘বুস’ বলে, তেমনি ‘অয়েলকম’। শুরুতে কানে বেসুরো ঠেকত। তবে ধীরে ধীরে এদের দ্রুতলয়ের বাতচিতই শ্রুতিমধুর লাগে। আঁকাবাঁকা পথে আনমনা হয়ে আবার হাঁটি। নীল অবগুণ্ঠনে-ঢাকা লাইব্রেরি যেন নববধূর ব্রীড়া নিয়ে আমারই প্রতীক্ষায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর