শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

রোকেয়া ঠেলেছেন অন্ধকার এনেছেন আলো

তুহিন ওয়াদুদ

রোকেয়া ঠেলেছেন অন্ধকার এনেছেন আলো

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আমাদের আলোকবর্তিকা। ঘন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে জ¦ালিয়েছেন আলোর মশাল। সেই আলোয় পথ চলছে বিশ্ব নারীসমাজ। প্রতিকূল সমাজের অসীম সাহসের অনন্য দৃষ্টান্ত তিনি। আজন্ম তার সেই সাহস, বেঁচে ছিল আমৃত্যু। কল্পনাকেও হার মানায় রোকেয়ার সাহসিকতা। মুসলিম সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে ১৮৮০ সালে তার জন্ম। পরিবারে ছিল কঠোর বিধিনিষেধ। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন। বাইরের মানুষের সঙ্গেও যোগাযোগের কোনো পথ খোলা ছিল না। নারী-পুরুষ নির্বিশেষ যে কারও সামনেই যাওয়া ছিল নিষেধ। বাইরের কোনো নারী এলেও সামনে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা। শিক্ষার্জনের ওপরও ছিল একই নির্দেশনা। বড় ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের আর বড় বোন করিমুন্নেসা ছিলেন এই ক্ষেত্রে সহায়। রাতে মোমবাতি জ¦ালানোর পর এমনভাবে চারদিক ঢেকে দেওয়া হতো যাতে ঘরের বাইরে থেকে কেউ বুঝতে না পারে আলো জ¦ালানো আছে। এভাবেই তিনি পড়ালেখা করেছেন। রোকেয়ার মনন গঠন তার বাবা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের ছিলেন শিক্ষিত জমিদার। ককেটি ভাষায় তার দখল ছিল। কিন্তু পরিবারে নারী শিক্ষার প্রতি ছিল চরম রক্ষণশীল, প্রচলিত সমাজের অনুসারী। মূলত রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বড় ভাই এবং বোনের অবদান বেশি। তার বিয়ে হয়েছিল ভাগলপুরের ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। তিনিও রোকেয়ার মননসৃষ্টিতে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন তার দুটি বই দুই ভাই বোনকে উৎসর্গ করেছেন। পদ্মরাগ উপন্যাসের উৎসর্গ পত্রে ইব্রাহীম সাবের সম্পর্কে লিখেছেন- ‘আমি আশৈশব তোমার স্নেহ-সাগরে ডুবিয়া আছি। আমাকে তুমিই হাতে গড়িয়া তুলিয়াছ। আমি জানি না,- পিতা-মাতা, গুরু শিক্ষক কেমন হয়- আমি কেবল তোমাকেই জানি।’ মতিচূর দ্বিতীয় খন্ড তিনি বড় বোন করিমুন্নেসাকে উৎসর্গ করেছেন। লেখক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন দেখেছেন সমাজ পরিবর্তন শুধু মুখের কথায় হবে না। সমাজকে জাগিয়ে তুলতে হলে তাদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। ফলে তিনি লেখনী হাতে নিয়েছেন। তার সব গ্রন্থের মূলে প্রধানত নারীদের জাগিয়ে তোলার অভিপ্রায়। তার লেখা গ্রন্থসমুহ মতিচূর (দুইখন্ড) অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ, SultanaÕs Dream (সুলতানার স্বপ্ন)। ‘মতিচূর’-এর প্রবন্ধগুলো নারী মুক্তির পথ-নির্দেশের বাণীবিন্যাস। তিনি ব্যাপকভাবে দেখাতে চেয়েছেন নারীদের কেন অবরুদ্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। কেবল পুরুষরা সমাজকে এগিয়ে নিতে পারবে না। তিনি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে আমাদের পশ্চাৎপদ অবস্থাও তুলে ধরেছেন। নারী-পুরুষকে তিনি দুটি চাকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। দুটি চাকা সমান না হলে গতিশীল হওয়ার উপায় নেই। বৈশি^ক প্রেক্ষাপটেও তিনি বাঙালি মুসলমি নারীদের অবস্থান নির্দেশ করেছেন। ‘অবরোধবাসিনী’র প্রতিটি রচনাই নারীদের মুক্তির লক্ষ্যে। অবরোধবাসিনীর ছোট ছোট রচনাগুলো তাঁর নিজস্ব আঙ্গিকে লেখা। অবরোধপ্রথার স্বরূপ তিনি সেখানে তুলে ধরেছেন। ‘পদ্মরাগ’ নামে যে উপন্যাস তিনি লিখেছেন সেখানেও মূলত তিনি নারীর সমুন্নত অবস্থায় পৌঁছে দেওয়ারই চিত্র অঙ্কন করেছেন। ‘সুলতানার স্বপ্ন’ রচনায় তিনি দারুণভাবে দেখিয়েছেন চরম সংকটেও নারীরা হাল ধরতে জানে। স্বপ্নলোকের ঘটনার বিন্যাস হলেও নারীদের ওপর আস্থা রাখা ও নারীদের আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে গড়ে তোলার আকাক্সক্ষাই তার সুলতানার স্বপ্নের মূল লক্ষ্য। স্কুল ও সংগঠন প্রতিষ্ঠাতা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বিভিন্নভাবে নারীদের এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। নারীদের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য লিখেছেন, স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন আবার সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। স্বামীর নামে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। নিজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করেছেন। আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম নামে একটি সংগঠন তিনি ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অভিন্ন লক্ষ্য নিয়েই তিনি এ সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রোকেয়ার জন্মভিটা ১৮৮০ সালে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে জন্মগ্রহণ করেন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সেই জন্মভিটা যতেœর অভাবে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। ছোট ছোট সামান্য দেয়াল ছাড়া আর কিছুই নেই। পুরনো একটি ছবিতে কিছুটা অবয়ব পাওয়া যায়। সরকারিভাবে ওই আদলে একটি স্থাপনা করা প্রয়োজন। যাতে বসতভিটার স্বরূপ নতুন প্রজন্ম দেখতে পায়। এ প্রসঙ্গে রোকেয়ার উত্তরসূরি রোকেয়া পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা রফিকুল ইসলাম বলেন- প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের অধীনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাড়িটি পুনর্নির্মাণ ও সংরক্ষণ জরুরি।’

বাংলাদেশে রোকেয়া চর্চা খুবই সীমিত। রোকেয়ার জন্মভিটায় ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রদধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র স্থাপন করেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে স্মৃতিকেন্দ্র নারী ও শিশু মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়ার কারণে এর বিরুদ্ধে আইনগত অবস্থান গ্রহণ করে স্থানীয়রা। সেই জটিলতা দূর হয়েছে। এখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলা একাডেমি এর তত্ত্বাবধান করছে। রোকেয়ার নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে রোকেয়া চর্চা আরও বৃদ্ধি করার প্রয়োজন আছে। রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ন্যস্ত হলে বিশ্বমানের একটি গবেষণা ও অনুশীলন কেন্দ্র সেখানে গড়ে উঠতে পারে। ভুল নামে রোকেয়া চর্চা(!) রোকেয়া সাখাওয়াত জীবদ্দশায় কখনোই নামের সামনে বেগম লেখেননি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার নামের সামনে বেগম যুক্ত করা হয়েছে। যা তার দর্শন-সংগ্রাম বিরুদ্ধ। দেশের প্রায় যত প্রথিতযশা লেখক রোকেয়ার নামে গবেষণা করেছেন তারা সবাই বেগম রোকেয়া লিখেছেন। বাংলা একাডেমিও এক সময়ে ‘বেগম’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। বর্তমানে বাংলা একাডেমি এই নাম সংশোধন করে মন্ত্রণালয় থেকে শুদ্ধ নামে রোকেয়া চর্চার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে। তার নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব প্রতিষ্ঠান এমনকি পদকও ভুল নামে প্রবর্তন করা হয়েছে। এগুলোরও সংশোধন প্রয়োজন। তিনি কখনো রোকেয়া, কখনো রুকু, কখনো আরএস হোসেন, কখনো রোকেয়া খাতুন লিখেছেন। ইংরেজিতেও ভুল বানান লেখা হচ্ছে। মূলত ইংরেজিতে লিখতেন Roquiah khatun। আমরাও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন লিখছি, তাও কতটা যৌক্তিক ভাবার প্রয়োজন। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আজ বিশ্বের সম্পদ। তাঁর প্রদর্শিত পথেই রয়েছে নারীমুক্তির পরম রূপরেখা। ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কেবল ৯ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম-মৃত্যু দিবসে তাকে স্মরণ না করে নিত্যদিনই তিনি হয়ে উঠুন স্মরণীয়।

সর্বশেষ খবর