শুক্রবার, ৮ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

রাষ্ট্রভাষার লড়াইয়ে কামরুদ্দীন আহমদ

এম আবদুল আলীম

রাষ্ট্রভাষার লড়াইয়ে কামরুদ্দীন আহমদ

রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে কামরুদ্দীন আহমদের ভূমিকা অতি উজ্জ্বল। একজন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ হিসেবে একেবারে শুরু থেকেই তিনি ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁর জন্ম ১৯১২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, জন্মস্থান মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার ষোলঘর গ্রামে। তিনি ১৯২৯ সালে বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৩১ সালে খুলনা বি এম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে ১৯৩৪ সালে বি এ (অনার্স), ১৯৩৫ সালে এম এ এবং ১৯৪৪ সালে আইনশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। কামরুদ্দীন আহমদ ছাত্রজীবনেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৪৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর ১৫০, মোগলটুলী মুসলিম লীগের অফিস ও ওয়ার্কাস ক্যাম্প উদ্বোধনের পর এর পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। ১৯৪৫ সালে আরমানিটোলা হাইস্কুলের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তী কালে রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, লেখালেখি এবং সামাজিক কাজকর্মে জীবন অতিবাহিত করেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তান আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান পর মুসলিম লীগ সরকারের দমন-পীড়ন ও শোষণ-বঞ্চনার রাজনীতি দেখে মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন গণ-আজাদী লীগ গঠিত হলে তিনি তাঁর আহ্বায়ক মনোনীত হন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে প্রথম বিবৃতি এ সংগঠনের পক্ষ থেকেই দেওয়া হয়।

কামরুদ্দীন আহমদ ভাষা-আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনেই তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। উভয় পর্বেই তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে ভাষা-আন্দোলনে অসামান্য অবদান রাখেন। ভাষা-আন্দোলনের কর্মীদের সংগঠিত করা, সভা-সমাবেশে অংশগ্রহণসহ নানা দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দেশভাগের অব্যবহিত পর থেকেই সুকৌশলে বাংলা ভাষাকে দাফতরিক কাজ-কর্ম থেকে বাদ দিতে থাকে। এর প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গের বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রসমাজ সোচ্চার হয়। তাঁদের এ আন্দোলনকে সংগঠিত রূপদানে যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ।

১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ‘তমদ্দুন মজলিস’ রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে যে স্বাক্ষর অভিযান শুরু করে কামরুদ্দীন আহমদ তা সমর্থন করেন। ১৯৪৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে তিনি তার সদস্য মনোনীত হন। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেলে এর প্রতিবাদে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে। ভাষা-আন্দোলন পরিচালনার জন্য ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে কামরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে আয়োজিত সভায় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ পুনর্গঠন করা হয়। তিনি এই পুনর্গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের যে আট দফা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, সেই চুক্তি স্বাক্ষরের সভায় উপস্থিত ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মতিন চৌধুরী প্রমুখ।

ভাষা-আন্দোলনের কর্মসূচি সফল করতে তিনি বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এরই অংশ হিসেবে ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ দুপুরের দিকে ট্রেনযোগে সিরাজগঞ্জে পৌঁছেন এবং সেখানকার ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ভাষা-আন্দোলন বেগবানে সবাইকে আহ্বান জানান। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ যে ছাত্র প্রতিনিধি দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, তাতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। ১৯৫০ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রের মূলনীতিতে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা হলে তার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গে নিন্দার ঝড় ওঠে। এর বিরুদ্ধে অন্দোলন করার জন্য ‘ডেমোক্রেসি ফেডারেশন সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। কামরুদ্দীন আহমদ উক্ত কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পল্টন ময়দানের জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ছাত্রসমাজ বিক্ষোভ মিছিল বের করে এবং সভা-সমাবেশে অগ্নিঝরা ভাষায় প্রতিবাদ করে। শুরু হয় ধারাবাহিক আন্দোলন। এই আন্দোলন পরিচালনার জন্য ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। কামরুদ্দীন আহমদ ওই সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলেন। ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে তা পরিপ্রেক্ষিতে নবাবপুর রোডের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ কার্যালয়ে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে যে বৈঠক হয় তাতে তিনি উপস্থিত ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারির পর সরকারের জুলুম-নির্যাতনের গড়ে ওঠা গণবিক্ষোভ সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য কামরুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে ব্যক্তি স্বাধীনতা কমিটি গঠন করা হয়। সিভিল লিবার্টি কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে তিনি পূর্ববঙ্গে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টাকারীদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এ প্রসঙ্গে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় বলা হয় : “সিভিল লিবার্টি কমিটির আহ্বায়ক কমরুদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে জানাইয়াছেন যে, সিভিল লিবার্টি কমিটি জানিতে পারিয়াছেন, বিগত কয়েকদিনের অমানুষিক হত্যাকান্ডের জন্য যাহারা দায়ী, তাহারা নিজেদের গা বাঁচাইবার জন্য চর ও অনুচরদিগকে দিয়া বাঙ্গালী ও অবাঙ্গালীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পাইয়াছে। ... এই কমিটি সকল নাগরিককে সাবধান করিয়া দিতেছে, যেন তাঁহারা স্বার্থান্বেষী বিভেদ সৃষ্টিকারীদের মিথ্যা প্ররোচনায় পতিত না হন।” ভাষা-আন্দোলনের তুঙ্গ মুহূর্তে অধিকাংশ নেতা গ্রেফতার হওয়ার পরেও কামরুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে মাঠে ছিলেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাষা-আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল নীতি-নির্ধারকের। ভাষা-আন্দোলনের পর তিনি রাজনীতিতে আরও সক্রিয় হন। ১৯৫৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং ১৯৫৫ সালের দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে জাতিসংঘে যান পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে। কামরুদ্দীন আহমদ ১৯৫৭ সালে রাজনীতি ছেড়ে কূটনীতিক পেশায় নিযুক্ত হন। ১৯৫৭-৫৮ সালে কলকাতায় পাকিস্তানি ডেপুটি হাইকমিশনার এবং ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত বার্মায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে যুক্ত হন আইন পেশার সঙ্গে। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁকে গ্রেফতার করে এবং ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ মুক্তি দেয়। তিনি ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কামরুদ্দীন আহমদ একজন রাজনীতি-বিশ্লেষক ও সমাজ-মনস্ক লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ১৯৬০-এর দশকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়, তার একজন তাত্ত্বিক হিসেবেও তিনি চিহ্নিত হয়ে আছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো হলো : পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি (১৯৭৬), বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ (দ্বিতীয় খন্ড), স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও অতঃপর (১৯৮২), বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী, A Social History of Bengal, A Socio-political History of Bengal & the Birth of Bangladesh. ১৯৮২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। ভাষা-আন্দোলনে তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করে ধানমন্ডির ৫/এ সড়কের নামকরণ করা হয় ‘ভাষাসৈনিক কামরুদ্দীন আহমদ সড়ক’। 

সর্বশেষ খবর