শুক্রবার, ৬ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

অক্টোবর

সিডন গ্যাব্রিয়াল কোলে, অনুবাদ : আকাশ মাহমুদ

অক্টোবর

সকাল। কাঠের ব্যালকনিতে পড়ে আছে থেঁতলানো ওইস্টেরিয়া ও চ্যাপ্টানো লাল সেলভিয়া পুষ্পগুচ্ছ। ওগুলো কাল রাতের দমকা হাওয়ায় উড়ে এসে এখানে পড়েছে। সেখানে গোলাপি ও সবুজরঙা দুটো প্রজাপতি। দেখতে পপি ফুলের ঝরে যাওয়া পাপড়ির মতো। ওগুলো ছোঁবার সময়টাতেও প্রায় জীবিত ছিলো। সে সময় ওদের ভঙ্গুর পাগুলো কোমল বুকের সূক্ষ্ম রোমের ওপর মৃদুভাবে কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। প্রজাপতি দুটোর একটি প্রায় তক্ষুনিই মরে যায়। অন্যটি বিদ্যুতায়িত পুষ্পের মতো আরও কয়েক মিনিট তিরতিরিয়ে কাঁপছিল। শুঁড় দুটোতেও ছিল অসহায় কাঁপন। 

আমি ওদুটোকে ওই কাঠের ব্যালকনিতে ফেলে চলে যেতে থাকি। আমি পেছন ফিরতে না ফিরতেই, জানি, চড়ুই আসবে আর দেখা যাবে আটটি পাখা নিখুঁতভাবে বিচ্ছিন্ন। অকস্মাৎ এসে পড়া এই হেমন্তে পাখার ওপর গোলাপিরঙা চাঁদের ছাপমারা এসব সংবেদনশীল প্রজাপতি নিশ্চয়ই যুৎ করে উঠতে পারে নি। কতদিন যে আমার বাড়ির উষ্ণ চিমনির ওপর ওদেরকে বসে থাকতে দেখেছি! যেন অক্টোবরের অশুভ সকাল থেকে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। প্রতিদিন এই ব্যালকনি থেকে আমি প্রশান্ত কিন্তু বিপদের মুখোমুখি বাগানগুলোর ক্রম-বিবর্ণতা দেখি। আমার বাগানও এর পাতার ছাদ হারাচ্ছে। কেবল জং ধরা লোহার কাঠামোতে বাঁধা কয়েকটি পত্রহীন শাখা ছাড়া গোলাপের তেতলা মাচাতেই বা কী রয়েছে? প্রতিবেশীদের বাগান? তথৈবচ! শুনতে পাই অদৃশ্য বাচ্চা-কাচ্চাদের হুটোপুটি, ছুটোছুটি আর হাসাহাসি। বিষণ্ন সীমানা প্রাচীরের গা ঘেঁষে সেলাই করে দেওয়ার মতো ঢ্যাঙ্গা বৃক্ষের সারি নিয়ে চৌকো পতিত মাঠ ছাড়া সেগুলোতো আর কিছুই নয়!

এই এলাকার পরিবেশ গ্রীষ্মেই বুঝি বিকশিত হয়ে ওঠে বেশি। কিন্তু বাগানগুলোকে বিবর্ণ করে দেয়। সেই বিকাশ যেন বন্ধ জানালার আড়ালে লজ্জায় লুকানো কেউ। নাঙ্গা শাখার ফাঁক দিয়ে দেখা অনুজ্জ্বল জামা আর চকচকা চুলের তারুণ্যের চাপল্যে ভরপুর তরুণীরাও সেখানে আর নেই- সূর্যালোকিত দিনে তারা ঘরে সাজানো চেয়ারে বসা।

একরাশ পাতায় রচিত পর্দার আড়ালে খুব কাছে থাকি বলে আমি তাদের কথা ও শব্দাবলি শুনি- লোহার টেবিলের ওপর সূচিকর্মের কাঁচির ঠনঠন, আঙ্গুঠের মেঝেতে গড়িয়ে যাওয়া, ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টানোর খসখসানি। কাপ-পিরিচ-চামচের আনন্দিত শব্দাবলি আমাকে জানান দেয় এখন পাঁচটা। যুগপৎ ক্ষুধাবোধ ও হাই জেগে ওঠে। এখন আমাকে ঘিরে চারপাশে আর কিছুই নেই কেবল স্মৃতিময় দীর্ঘ গ্রীষ্ম ছাড়া: একটি শূন্য দোলনা বাতাসে দুলছে আর কোনো এক বাগানের একটা ধাতব খেলনা ব্যাঙ হাঁ করে বৃষ্টি গিলছে। জীর্ণ-দীর্ণ বৃক্ষগুচ্ছের নিচে তার রহস্যময় বায়ুপ্রবাহ, হারানো বহমান পথ আর নগ্নগাত্র দেয়ালগুলো আমাদের বহুকাক্সিক্ষত স্বর্গ-ভাবনার সীমা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়।

বাগানের ওপাশের গোলাপঝাড় ছেঁটে দেওয়ার কাজ করা গোলাপি জামার সুঠামদেহী ঐ মেয়েটিকে না আবার এই মুহূর্তে কুৎসিতরূপে আবিষ্কার করি- এই ভয় মনে জাগছে। দিনে দুবার ঐ যে দম্পতির অলস পায়চারির শব্দ আমি শুনি তারা তরুণ না প্রবীণ সে বিষয়ে গাছগুলো আবার সবুজ না হয়ে ওঠা পর্যন্ত অনিশ্চিতই থাকতে চাই।

শোক পালনরতা মহিলাটির বাড়ির চত্বরের সিঁড়িতে বসে গান গাইতে থাকা ছেলেমেয়ে তিনটি আমি তাকাতেই হঠাৎ থেমে যায়। আমিই তাদেরকে অস্বস্তিতে ফেলে দেই। তবুও তারা ঠিকই জানে এই গ্রীষ্মে আমি এখানেই ছিলাম। ছাঁটানো আকাশিয়া ঝোপের ওপর দিয়ে তাদের হারানো বল ছুঁড়ে ফিরিয়ে দিলে এদের কোনজন আমাকে ‘ধন্যবাদ’ দিয়েছিল তা আমি জানি না। আমি এখন তাদের অস্বস্তিতে ফেলছি আর তারা আমাকে বিব্রত করছে। তাই ভেজাচুলে ড্রেসিংগাউন পরে বাগানের পথ পেরুনোর সাহস পাওয়া আমার আর ঠিক নয়।

আমার ভাবনারা ঘরে, প্রজ্বলিত অগ্নিতে আর বাতির দিকে ফিরে এলো। ওইতো এখানে বই, কুশন আর একগুচ্ছ রক্তরঙা ডালিয়া। আজকালকার স্বল্পায়ু অপরাহ্ন কাটিয়ে দ্রুত ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যায় বারান্দার তিনদিক ঘেরা জানালার রং ক্রমশ নীল হয়ে এলে ঘরের ভেতরই থাকা উত্তম। ঠিক এ সময়েই দেয়ালের আর ছাদের এখনো গরম টাইলসের ওপর দেখা যাচ্ছে রোঁয়াভরা লেজ, উৎকর্ণ কান, সতর্ক পা আর তীক্ষèদৃষ্টির বেড়ালগুলোকে; এরা আমাদের এই বাগানের নতুন মালিক।

দীর্ঘদেহী কালো বিড়ালটি এ বাড়ির কুকুরের খালি ঘরটির ছাদের দিকে সারাক্ষণ সতর্কদৃষ্টি মেলে রেখেছে। সবজি বাগান ও কাঁচা সবুজ গাছের গন্ধবহা নিশ্চল কুয়াশায় নীলবর্ণা রাতের দেহ হঠাৎ নরম পশমি ছায়াশরীরে ভরে যায়। তাদের পায়ের নখরে গাছের বাকল ছিঁড়ে যায়। তাদের নিচু ও কর্কশ কণ্ঠে শিহরণ জাগানো যে সংগীত শুরু হয় তা যেন আর থামবে না।

লোমশ পারশিয়ান বিড়ালটি আমার জানালার কার্নিশের সঙ্গে অজগরের মতো পেঁচিয়ে থাকার ভঙ্গিতে বসে আছে। তার নিচে রান্নাঘরের সামনে ঝিমুতে থাকা তার প্রেমিকার সম্মানে টানটান হচ্ছে আর গাইছে। নিঃশ্বাস চেপে এমনভাবে গাইছে যেন সে দীর্ঘ ছ’মাসের ঘুম থেকে এইমাত্র জেগে উঠছে। সে ছোট ছোট শ্বাসের সঙ্গে বাতাস টেনে নিচ্ছে। মাথা পেছন দিকে হেলানো। দিনের বেলা তো অদূরেই! তখন আমার বাড়িটি এর প্রধান শোভা এই দুটি বিশ্বস্ত এবং চমৎকার অতিথিকে হারাবে। বিড়ালগুলো লোমশ ‘সেজ’ আর ধূসর ‘এসপেন’ গাছের পাতার মতোই রুপালিরঙা- ঠিক যেন শিশিরছাওয়া মাকড়সা জাল। তারা একই প্লেটে খেতে নারাজ। কিন্তু তাৎক্ষণিক অথচ অনিবার্য চিত্তবৃত্তি নিরসনের অপেক্ষার সুবাদে সে দুটো পরস্পরের সামনে যার যার অংশের অভিনয় করে গেল। পরস্পরকে না চেনার সে প্রসঙ্গ বুঝি শুধু আনন্দ করার জন্যই।

পুরুষ বিড়ালটি তার শক্তিমত্তা লুকানোর ভান করার লক্ষ্যে পশ্চাৎদেশ নামিয়ে হাঁটতে থাকে। এতে তার পাছার রোমশ তুলতুলে অংশটি মাটির সঙ্গে ঘষা খেলো। মাদিটি পুরুষটিকে ভুলে যাওয়ার ভান করে। বাগানে পৌঁছে সে আর পুরুষ বিড়ালটির দিকে একটি পলক ফেলেও খাতিরের ভাব দেখায় না। ঘরের দিকে এসে মাদি বিড়ালটি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। নিজের বিশেষাধিকারের কথা স্মরণ করে সে সিঁড়িতে তাকে পথ দিতে গড়িমসি করলে তীব্র ঘৃণার চোখে পুরুষটিকে মুখ খিঁচিয়ে ওঠে। তার আরাধ্য কুশনটিতে পুরুষ বিড়ালটি উঠে বসলে আগুনে দেওয়া বাদামের মতোই ফেটে ওঠে সে রাগে। তক্ষুণিই সে সত্যিকারের ছোট্ট ভিতু মেয়ের মতো পুরুষ বিড়ালটির মুখ খামচে দেয়; আর চোখ ও নাকের নরম মাংসে নখ বাড়ায়।

পুরুষটি এই খেলার রূঢ় নিয়ম এবং গোপনে স্থিরীকৃত মেয়াদকে মেনে নেয়। খামচি খাওয়া মুখ নিয়ে অপমানিত চিত্তে সে অপেক্ষা করে। হয়তো আরও কিছুদিন পার হবে, সূর্য দিগন্তে ডুববে, আকাশিয়া এক এক করে গোলাকার মুদ্রার মতো স্বর্ণরঙা কম্পমান পত্রমোচনের আয়োজন স্থির করবে। তারপরও কিছু শুকনো নিরস রাত আসবে। আর আসবে পুবাল হাওয়া কাজুবাদাম গাছের শেষ কয়টি পাতাকে ঝরানোর ভয় পাইয়ে দিতে।

কাস্তের মতো চাঁদের নিচে তারা একত্রে বিস্ফোরিত হবে। সে সময় তারা আর একসাথে ঘুমানোর বা ঝগুড়ে যুগল নয় বরং তারা পরস্পর ভালোবাসাসৃজিত আবেগজারিত প্রেমসিক্ত শত্রু। পুরুষ বিড়ালটি নতুন ও উদ্দীপক লীলাকৌশলে সুদক্ষ। আর মাদিটিও লীলাবতী: কণ্ঠে করুণ চিৎকার এবং যুগপৎ পলায়ন আর প্রত্যাখ্যানের ভান তার ভঙ্গিতে। এই নির্ধারিত রহস্যময় সময়কে সবাক হতেই হয়।   তারা পুরানো প্রেমিক কিন্তু ইতোমধ্যে বিবিক্ত বন্ধু। নতুনভাবে প্রমত্তপ্রেমে অবগাহনের লক্ষ্যে আবার তারা পরস্পরের অচেনা হয়ে উঠবে।

[সিডন গ্যাব্রিয়াল কোলে, ফরাসি লেখিকা]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর