হঠাৎ রুপার সঙ্গে নিউমার্কেটে দেখা।
রুপা অনিতার ছোট খালা। কলেজে পড়ে। অসম্ভব রূপবতী।
কোনো সৌজন্যতা না দেখিয়েই সে কথা শুরু করে, ‘দু’দিন ধরে আসছেন না যে! নেক্সট উইকে অনিতার এক্সাম সেটা জানেন?’‘জি, জানি’
‘তাহলে!’
‘একটা বিশেষ কারণে...কথা শেষ করতে পারে না রঞ্জু। গলার কাছে এসে আটকে যায় কথা। নিঃশ্বাস যেন ফুরিয়ে যায়।
‘বিশেষ কারণটা জানতে পারি কি?’ কৈয়িফত চাওয়ার মতো করে প্রশ্ন করে মেয়েটা।
‘আমার রুমমেট চয়ন খুবই অসুস্থ। হাসপাতালে ছিলাম।’
‘তাই!’
‘জি।’
‘বলেননি তো!’
রঞ্জু বলেছে। রঞ্জু ফোন করে অনিতার মাকে বলেছে দুই দিন সে আসতে পারবে না। হাসপাতালে থাকবে। তার বন্ধু খুবই অসুস্থ। রুপা নিশ্চয় জানে না। সে সামনের ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তাহলে তো আপনিও অসুস্থ হয়ে যাবেন। দেশের হাসপাতালের যা অবস্থা’!
মেয়েটার কথার ধরন বোঝা যায় না। কটাক্ষ করছে না সিম্প্যাথি দেখাচ্ছে। রুপা অবশ্য জানে, রঞ্জু কোনো মারাত্মক কারণ ছাড়া টিউশনি মিস করে না। ঝড়-বৃষ্টি, এমনকি হরতালের মধ্যেও চলে আসে।
রঞ্জুকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে রুপা বলে, ‘কাল তাহলে আসছেন তো!’
রঞ্জু এ কথার কোনো উত্তর দেয় না। আগামীকাল সে এমনিতেই যেত। তারপর রুপা আর কোনো কথা না বলে আচমকা সামনের কসমেটিকসের দোকানে ঢুকে পড়ে।
পরের দিন।
কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দেয় রুপা। বেশির ভাগ দিনই অনিতার মা অথবা বুয়া। আজ রুপা।
ঘরের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ ড্রয়িং রুমে বসে থাকে রঞ্জু। যাওয়ার সময় রুপা ফ্যানের সুইচ অন করে গেছে। স্লো-স্পিডে ফ্যানে সজনে পাতার মতো ঝিরঝিরে বাতাস হচ্ছে।
কিন্তু অনিতা পড়তে আসে না। একটু পরে ফলের ট্রে হাতে আসে রুপা।
সরষে ফুলের রং সিল্কের একটা শাড়ি পরেছে ও। শরীরের প্রতিটি বাঁকই দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে ম্যাচ করে পরেছে আকাশি ব্লাউজ। মেদহীন অনাবৃত তলপেট। পদ্মনাভীতে চাঁদের সৌন্দর্য। নগ্ন পা দুটি আপেলের মতো চকচকে। মসৃণ।
একটু আগেই বোধহয় গোসল করেছে ও। শরীর থেকে তাজা লেবুর ঘ্রাণ আসছে। শ্যাম্পু করা নরম চুলগুলো বুকের ওপর টেনে দেয় রুপা।
কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে অসহায় চোখে ঘরের জানালার দিকে তাকিয়ে রঞ্জু জানতে চায়, ‘অনিতা কি বাসায় নেই?’
সামনের সোফায় বসতে বসতে রুপা বলে, ‘না, অনিতা বাসায় নেই। ও আপু-দুলাভাইয়ের সঙ্গে ইয়ারপোর্ট গিয়েছে।’ তারপর রঞ্জুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাসায় আমি আর বুয়া।’ রুপা আবারও থামে। একটা বড় শ্বাস নেয়। তারপর বলে, ‘বুয়া কিচেনে মাংস রান্না করছে।’
জানালায় দুলে ওঠে জলপাই রঙের পর্দা। ওর মধ্যে আরও একটা রং। কিন্তু রংটা রঞ্জু চেনে না। রঞ্জু অনেক রংই চেনে না। ছোটবেলায় ঈদের আগের দিন বিকালে মা যখন শাড়ির আঁচল খুলে ২ টাকার জাফরান রং আনতে বলত তখন বাজার থেকে আসার সময় মোড়ক খুলে রংটা দেখত রঞ্জু। শিউলি ফুলের বোঁটার মতো সেই রং। মনের মধ্যে কী যে আনন্দ খেলে যেত তখন! কাল বাড়িতে পোলাও রান্না হবে। বাবা আসবে সিরাজগঞ্জ থেকে। রঞ্জুর জন্য একটা শার্ট নিয়ে আসবে। রঞ্জু হানিফ চাচার ফোনে বাবাকে বলেছিল ওর জন্য একসেট স্কুল ড্রেস যেন নিয়ে আসে। সময়ে- অসময়ে টিচাররা শুধু বকা দেয়। কিন্তু রঞ্জু জানে না বাবা ওর জন্য স্কুল ড্রেস আনবে কি না! তবে রঞ্জু নিশ্চিত স্কুল ড্রেস না আনলেও একটা শার্ট নিশ্চয় নিয়ে আসবে বাবা। তারপর ঈদের দিন সেই শার্ট পরে ঈদগাঁ থেকে ফিরে সবাই মিলে মজা করে পোলাও আর গোস্ত খাবে। হঠাৎ রুপার কথায় জানালার পর্দা থেকে চোখ সরায় রঞ্জু। চিন্তায় এলোমেলো হয়ে যায়। রুপা বলে, ‘অনিতার এক কাকু মালয়েশিয়া থেকে আসছে। নাম রাশেদ। দুলাভাইয়ের কেমন যেন ভাই হয়।’ তারপর রুপা দেয়ালে ঝুলানো সুলতানের আঁকা ‘চরদখল’ ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। চোখ নামিয়ে বলে, এক/দুই দিন থাকবে এখানে। তারপর গ্রামে যাবে।’
‘আপনি তো কালকেও এটা জানতেন!’
‘জানতাম।’
‘তাহলে আসতে বললেন যে!’
‘আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।’
‘আমার সঙ্গে!’ ভুরুজোড়া কুঁকড়ে যায় রঞ্জুর।
‘হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে।’
শ্যাম্পু করা মসলিন চুলগুলো ফিনফিনে বাতাসে ওড়তে থাকে এলোমেলো। চোখে, মুখে, বুকে। ওর নগ্ন পায়ের পাতা থেকে চোখ সরিয়ে রঞ্জু বলে, ‘কী কথা?’
কোনো ভণিতা না করেই রুপা বলে, ‘আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।’
‘বিয়ে!’ অনেকটা ভিরমি খাওয়ার মতো অবস্থা হয় রঞ্জুর।
‘হ্যাঁ, বিয়ে। আমি আপনাকে ভালোবাসি।’ আবারও থামে রুপা কয়েক মুহূর্তের জন্য। হৃৎপিন্ডে সাহস পুরে নেয় বেলুনের মতো। তারপর বলে, ‘আমার ধারণা আপনিও আমাকে ভালোবাসেন। শুধু ভালোবাসেন বললে ভুল হবে। গভীরভাবে ভালোবাসেন।’
যেন কেউ আঠা দিয়ে রঞ্জুর দুই ঠোঁট এক করে দিয়েছে। নড়ানোর শক্তি নেই। মেয়েটা বুঝল কী করে যে রঞ্জু তাকে ভালোবাসে। মনের কথা সত্যিই তাহলে মেয়েরা বোঝে! রুপা বলে, ‘যে লোকটা আজ বাসায় আসছে তাকে আমি চিনি। এর আগেও দুইবার এসেছে। ওর সঙ্গে আবার আমাকে...
আর বলতে পারে না। চোখের মধ্যে জল ছলছল করে। আচমকা রঞ্জুর দুই হাত চেপে ধরে, ‘আপনি আমাকে বাঁচান-প্লিজ। ওরা আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে।’
দুই ফোঁটা জল দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে গালে, ‘আপনি যদি বিয়ে না করেন তাহলে আমি আত্মহত্যা করব। বিষও জোগাড় করে রেখেছি, দেখবেন? ইঁদুর মারা বিষ। র্যাট কিলার। মোড়ের দোকান থেকে কিনেছি।’
সুন্দরী মেয়েদের অনেক যন্ত্রণা!
রাশেদ লোকটা স্ট্যাবলিশড। মালয়েশিয়াতে থাকে। গাড়ি-বাড়ি আছে নিশ্চয়! এরকম একটা ছেলেকে ছেড়ে রুপা রঞ্জুকে বিয়ে করতে চায়। চাল-চুলোহীন রঞ্জু। লোকের বাড়ি বাড়ি টিউশনি করে যার দিন চলে। ভবিষ্যৎ যার অনিশ্চয়তা। বুদ্ধিমতী মেয়েরা এরকম অনিশ্চিত ভবিষ্যতে সহজে পা রাখে না। কিন্তু এ আবার কেমন মেয়ে!
রঞ্জুর এক বন্ধু মেথিন একটা মেয়েকে ভালোবাসত। অনেক দিন। প্রায় চার বছর। এলাকার অলি-গলি সবাই জেনেছিল তাদের। কিন্তু তারপরও ওই মেয়েটা ওরকম বিদেশে থাকা একটা ছেলের সঙ্গে হঠাৎ বিয়ে করে ফেলে। কিন্তু এই রুপা! আসলেই একেক মেয়ে একেক রকম। সব মেয়েই বিত্ত-বৈভব ভালোবাসে না।
রুপা আচমকা যেমন কাঁদতে শুরু করেছিল আচমকাই আবার থেমে যায়। তারপর কিছু সময় ঘরের মধ্যে শ্মশানের নীরবতা নেমে আসে। রঞ্জু অসহায় চোখে ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকায়। সবুজ ফ্যানের দিকে তাকায়। শোকেসের রঙিন ফুলের দিকে তাকায়। ভিতরে ভিতরে অস্থির হতে থাকে।
রঞ্জু ধরেই নিয়েছিল বিয়ে ছাড়া কোনো নারীর হাত সে ধরতে পারবে না। যদি ধরতেই হয় অল্প টাকায়...আজ স্বর্গের এক অপ্সরী তাকে ভালোবাসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কী করবে সে এখন?
রঞ্জুর চোখে চোখ রেখে রুপা বলে, ‘বাগানে এক দিন আমাকে না দেখলে আপনার কষ্ট হয়, আমি জানি। সেদিন আমাকে না দেখে অনিতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তোমার ছোট খালামণি কোথায়। কি করেননি?’
‘করেছি। কিন্তু...
‘না, কোনো কিন্তু নয়। আপনি আমাকে বিয়ে করবেন। আমি শুধু আপনার। শুধু আপনার।’
কথাগুলো বলতে বলতেই গা ঘেঁষে আসে রুপা। মায়াভরা দুটি চোখে নীল সমুদ্রের আকর্ষণ। শরীরজুড়ে মোহনীয় মাদকতা। একেবারে মুখোমুখি।
‘আপনি আমাকে বাঁচান-প্লিজ।’ মন্ত্র পড়ার মতো করে কথাগুলো বলে সে।
রঞ্জু দুই হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয়। মুখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দেয় আলতো করে। তারপর জীবনে যা কখনো করেনি তা-ই করে বসে। চুমু খায় রুপাকে। ঠোঁটে, চোখের পাতায়, কপালে। তারপর অদ্ভুত এক ভালোলাগার শিহরণে কাঁপতে থাকে সে।
কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়ে রুপা। রঞ্জুর সংযম পরাজিত হয়। তার মনে হয় তেইশ বছরের তৃষ্ণার্ত বুকে রুপা যেন মুষল বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে।
ঠিক ওই মুহূর্তে ঘরে ঢোকে রুপার বোন এবং দুলাভাই। পিছনে রাশেদ, অনিতা। অবস্থা দেখে কিছুই বুঝতে পারে না প্রথমে। তারপরই দুলাভাই বুঝে যায় সবকিছু।
রঞ্জু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। মাথার মধ্যে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। রুপা কি তাহলে দরজা লাগাতে ভুলে গিয়েছিল!
শালিক যেমন গোসলের পর গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, রুপাও সেরকম গা ঝাড়া দেয়। রঞ্জু উঠে বসতেই ঠাস করে একটা চড় গালে এসে পড়ে। সকালের সেভ করা মসৃণ গাল মুহূর্তেই লাল হয়ে যায়। দুই কানে কেমন ভোঁ ভোঁ শব্দ বাজতে থাকে।
লোকটা তাকে বাংলা-ইংরেজিতে অনেক গালি দেয়। কিছুই শুনতে পায় না রঞ্জু। ওর কানের ভোঁ ভোঁ ক্রমেই বাড়তে থাকে।
জামার কলার ধরে লোকটা এক ঝটকায় ঘর থেকে বের করে দেয় রঞ্জুকে। একটা ঘোরলাগা, উ™£ান্ত মানুষের মতো ফুটপাত দিয়ে উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে থাকে রঞ্জু।