শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
গল্প

বেগুনি রঙের নেলপলিশ

জয়শ্রী দাস

বেগুনি রঙের নেলপলিশ

সরকারি হাসপাতালের ২৭১ নম্বর রুম। একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ রোগী দেখছেন। তানভীর  ডাক্তারের রুমের সামনে দীর্ঘক্ষণ বসে আছে। সে পেশায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা। বছর আটেক আগে বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করেছে।

হঠাৎ তানভীরের চোখ চলে যায় কাছেই দাঁড়ানো এক মহিলার পায়ের দিকে। তার পরনে কালো রঙের বোরকা। মুখে মাস্ক। তবে অদ্ভুত ব্যাপার  পায়ের নখে বেগুনি রঙের নেলপলিশ লাগানো।

তানভীর কয়েক দিন যাবৎ উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগছে। আজ এই বেগুনি রঙের নেলপলিশ তাকে কেমন আনমনা করে দিল। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। এমন নেলপলিশ সাকিনার ভীষণ পছন্দ ছিল। সাকিনা... মনে পড়তেই আরও বেশি আনমনা হয়ে উঠল তানভীর। প্রথম প্রেম প্রথম স্পর্শ আর প্রথম আবেগের কথা মানুষ ভুলতে পারে না। সাকিনা তানভীরের তেমন আবেগেরই নাম। ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল মাস্ক পরা। কাজলটানা চোখগুলোতে কেমন যেন একটা মায়া। ঝট করে পাশের ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণের জন্য তানভীরের মনে হলো এ মহিলাই যেন তার সাকিনা। সে ভদ্রমহিলা বের হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল।

ততক্ষণে ডাক্তারের রুম থেকে তানভীরের ডাক এলো। দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার পরামর্শ দিয়ে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন ডাক্তার। তানভীর কোনোরকম ডাক্তার দেখিয়ে দ্রুত বের হয়ে এলো। আশপাশের সব জায়গায় সাকিনাকে খুঁজতে লাগল। কোথাও খুঁজে পেল না। সাকিনার সঙ্গে একজন বয়স্ক মহিলা ছিল। তাকে নিয়ে এত দ্রুত কীভাবে হাওয়া হয়ে গেল? হাসপাতালের মূল ফটকে এসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল তানভীর। কিন্তু সেই বোরকা- সেই মাস্ক- সেই কাজলটানা চোখ আর নীল নেলপলিশের কোনো দেখা নেই।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে তানভীর আর সাকিনার পরিচয়। দুজনই পড়ত কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। তবে সাকিনা যখন ফার্স্ট ইয়ারে তানভীর তখন থার্ড ইয়ারে। ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই হিসেবে সাকিনার সঙ্গে তানভীরের পরিচয়। নোট আদান-প্রদান করতে গিয়ে অপূর্ব সুন্দরী সাকিনার সঙ্গে একটা সখ্য তৈরি হয় তানভীরের।

একদিন সন্ধ্যাবেলা ক্যাম্পাসের সবচেয়ে বয়স্ক রেইনট্রি গাছটার নিচে বসে গল্প করছিল তানভীর আর সাকিনা। ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলা একদম পছন্দ না তানভীরের। সরাসরি বলে ফেলল ভালোবাসার কথা। সাকিনা কোনো জবাব দিল না। আবার প্রতিবাদও করল না। মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ হয়ে চলতে থাকল দুজনের প্রেম। এক কান দুই কান করে ওদের প্রেমের ঘটনা ছড়িয়ে পড়ল গোটা ক্যাম্পাসে। হাত ধরে, বিকাল নাগাদ মাঠের ধারে বসে গল্প করতে করতে, সূর্যটা ডুবে যেত। অন্ধকার চারদিক। সেদিন দুজন দুজনের স্পর্শ পেয়েছিল গভীরভাবে। সময় বয়ে যেতে থাকে। দুজনের সম্পর্ক আরও গভীর থেকে গভীর হয়ে উঠল।

এক সময় সাকিনা নিশ্চিত হয় সে গর্ভবতী। এখন উপায়? তানভীর আর সাকিনা মিলে অনাগত সন্তানকে নষ্ট করে। এ ঘটনা এ দুজন এবং ডাক্তার ছাড়া আর কেউ জানেন না।

তবে ভালোবাসা থেমে থাকে না। তানভীরের শক্ত হাতটি সবসময় জড়িয়ে রাখে সাকিনাকে। এক বৃষ্টির দিনে তারা দাঁড়িয়ে থাকে ক্যাম্পাসের সঙ্গে লাগোয়া চায়ের দোকানে, তারা দুজন খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছিল। গাছপালায় ঘেরা এই জায়গাটিতে কেমন জানি একটা অন্ধকার ভাব। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার।  সাকিনার বাবা এসেছিলেন হল থেকে সাকিনাকে নিয়ে শহরে তার ছেলের বাড়িতে যাবেন বলে। তিনি দূর থেকে এভাবে দুজনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে খুব কষ্ট পেলেন। বুঝলেন সবই কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। বাবা সাকিনাকে নিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ শহরে আসেন। তারা এক ভাই এক বোন। ভাই দুবাই থাকেন। ছয় মাসের জন্য বাংলাদেশে এসেছেন। বাবা সাকিনাকে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটি কে?

সাকিনা বলে, কোন ছেলে?

-ন্যাকামি বন্ধ করো। বলো?

-আমি তাকে পছন্দ করি। বিয়ে করতে চাই।

-সে কী করে?

-ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে।

-ছেলের বাড়ির ঠিকানা দাও। আমি ছেলের বাবার সঙ্গে দেখা করব। তোমাদের বিয়েটা করিয়ে রাখব পরে চাকরি-বাকরি করে ছেলে তোমাকে তাদের বাড়িতে তুলে নেবে।

বাবার কথা শুনে সাকিনা মনে মনে খুব খুশি হলো। পরদিন যোগাযোগ করে সাকিনার বাবা তানভীরের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। তানভীরের বাবা দুটো বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। তার ছেলে হচ্ছে তানভীর। পরের ঘরে তিন ছেলে। বাড়িঘরের অবস্থা খুব ভালো না। তানভীরের দ্বিতীয় মা অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছেন বিছানায়। তানভীরের বাবার কথাবার্তায় মধ্যে অনেক রুক্ষতা ছিল। তিনি সাকিনার বাবাকে তেমন কোনো আদর-যত্ন করেননি। সাকিনার বাবা মনে মনে ভাবলেন, বেঁচে থাকতে এই ধরনের পরিবারের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে তিনি সাকিনাকে কিছুই বললেন না। তিনি সাকিনার বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। সাকিনার বড় ভাই বোনকে নিয়ে দুবাই ঘুরে আসার প্রস্তাব করল। প্রথমে আমতা আমতা করলেও বিয়ের শপিংয়ের কথা বললে সাকিনা রাজি হয়ে গেল। তানভীরকে একটু জানিয়ে সাকিনা, ভাই ও বাবার সঙ্গে দুবাই চলে যায়। দুবাইতে ভাইয়ের সংসার আছে। দুটো বাচ্চা আছে। সাকিনার খুব আনন্দে দিন কাটতে লাগল। ১০ দিনের মাথায় এক বড় প্রবাসী বাঙালি হোটেল ব্যবসারীর সঙ্গে এক প্রকার জোর করে বেঁধে সাকিনার বিয়ে দেওয়া হলো।

সাকিনার বিয়ের কথা জানার পর তানভীর বারবার ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। সাকিনা ছাড়া হৃদয়ের কান্নাই তার একমাত্র সঙ্গী হয়ে যায়। শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে সেই বছরই তানভীর বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করে, অপেক্ষা করতে থাকে সাকিনার।

আজ হাসপাতালে হঠাৎ করে সাকিনাকে কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলল সে। তানভীরের ধারণা এক দিন না এক দিন এই হাসপাতালে সাকিনা আবার আসবে। তিনি একজন পুলিশের সোর্সকে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত হাসপাতালে বসে থাকতে বলল। প্রায় এক মাস পর হঠাৎ এক দিন সোর্স বলল, ‘স্যার আপনার বর্ণনা অনুযায়ী একজন মহিলা এসেছেন ডাক্তারের কাছে।’ সেদিন তানভীর অনেক ব্যস্ত। কিন্তু সবকিছু ফেলে সে হাসপাতালে ছুটে চলে এলো। আজ যেভাবেই হোক তানভীর সাকিনাকে ধরবে। মনের জমানো অনেক কথা বলবে।

সাকিনা এবং তার সঙ্গী ভদ্রমহিলা বের হলেন। সঙ্গে সঙ্গে তানভীর আবেগের উত্তেজনায় বলল, সাকিনা দাঁড়াও।

মহিলাটা খুব ভদ্রভাবে বলল, আমি সাকিনা না।

-কে আপনি। কী নাম আপনার। আমি কি জানতে পারি?

-বাবা মায়ের দেওয়া একটা নাম আছে।

- বাবা মা যে নাম রেখেছেন। সেই নামটাই বলুন না।

-আপনাকে নাম বলতে বাধ্য নই আমি।

-তা ঠিক। তবে আপনার নামটা আমার জানা খুব জরুরি ছিল। যদি বলতেন তাহলে আমার খুব উপকার হতো।

আর কোনো কথা না বলে সাকিনা এবং তার সঙ্গীকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এলো। পেছনে পেছনে তানভীর। তানভীর কিছু বলছে না, কারণ সব লোক তাকিয়ে আছে। তানভীর ওদের পিছু নিল। সাকিনাদের অটোরিকশা চলা শুরু করল। পেছনে পুলিশের জিপে তানভীর।

শহরের উপকণ্ঠে একটি একতলা পুরনো ভাঙাচোরা বাড়িতে ঢুকল তারা দুজন। দরজা বন্ধ করে দিল। বাড়িটির সামনে দুটি পুরনো জরাজীর্ণ দোকান, বাড়ির ছাদ চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। বাড়ির কার্নিশ ধরে দেখা যাচ্ছে কিছু আগাছা ধরনের বটগাছের চারা গজিয়েছে। বিদ্যুতের লাইন কাটা, এই অন্ধকার ভিতর বাড়িতে মানুষ থাকতে পারে, তানভীর সেটা চিন্তাও করতে পারে না। সে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগল। কিন্তু ভিতর থেকে কোনো শব্দ নেই। ভয় পেল। দরজা খুলছে না। তানভীরের সঙ্গে থাকা একজন পুলিশ বলল, ‘স্যার দরজা ভেঙে ফেলি।’ ভিতর দিয়ে সব কথাই শোনা যাচ্ছিল। এবার দরজা খুলে বয়স্ক মহিলা বললেন, বাবা আপনারা চলে যান।

-রাগ করবেন না, দয়া করে সাকিনাকে ডেকে দিন।

ঘরের কোনায় একটি মোমবাতি জ্বালানো। মোমের আলোতে সাকিনার নিবারণ মুখটি দেখে তানভীর হতবিহবল হয়ে তাকিয়ে রইল। ক্ষীণ সাকিনা যেন আরও সুন্দর। ভাঙা ভাঙা গলায় তানভীর বলল, তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ সাকিনা।

- তুমি চলে যাও।

-আমার জানতেই হবে, তোমার কী হয়েছিল? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করে করে এখনো একা। এক দুই দিন না আট বছর অপেক্ষা করে আছি। তুমি চলে যাওয়ার বছরই আমার পুলিশে চাকরি হয়। তোমার কী হয়েছিল বল সাকিনা?

-আমাকে জোর করে দুবাই নিয়ে যায় আমার ভাই। এরপর দুবাইয়ের এক হোটেল ব্যবসায়ীর সঙ্গে আমাকে বিয়ে দেয়। লোকটা প্রতিদিন আমাকে শারীরিক অত্যাচার করত। বিভিন্ন ধরনের মানুষ নিয়ে আসত বাসায়। আমাকে তাদের মনোরঞ্জন করতে হতো। না করলেই চলত মারধর। আমি কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করি। পারিনি। এভাবে চলে সাত বছর। এই যে মহিলাকে দেখছো উনি আমার শাশুড়ি মা। আমার দ্বিতীয় জন্মদাতা। এক দিন আমাকে প্রচন্ড মারধর করা হয়। আমি সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। উনি সব সময় নামাজ পড়তেন আর কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে আমার জন্য দোয়া করতেন। একটু সুস্থ হলে তিনি আমাকে নিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে যান। এরপর আমার ভাইয়ের সহযোগিতায় আমি আর  শাশুড়ি মা ঢাকায় চলে আসি। এই বাড়িটা আমার শাশুড়ি মায়ের। সামনের দুটি দোকান দিয়ে সামান্য কিছু টাকা পাই। ওই টাকা দিয়ে আমরা খুব কষ্ট করে চলি। তবুও এই মানুষটা আমাকে ছেড়ে কোনো দিন যাননি।

কথাগুলো বলতে বলতে সাকিনা অঝোরে কেঁদে চলছে, কাঁপছে তানভীর। সে কি বলে সান্ত¡না দেবে কোনো ভাষা খুঁজে পায় না।

কিছুদিন পর তানভীর অনেক কষ্ট করে সাকিনার স্বামীর সন্ধান পান। তাকে অনেক ভয়ভীতি প্রদর্শনের পর সে দুবাই থেকে তালাকনামা পাঠিয়ে দেয়।

আশ্বিন মাসের পূর্ণিমার দিন তানভীর ও সাকিনার বিয়ে হয়। সাকিনার স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়েছে। এত নির্যাতন সহ্য করার পর তার চেহারার কত পরিবর্তন হয়েছে তবুও এত বছর পর সাকিনাকে কাছে পেয়ে তানভীর অবাক দৃষ্টিতে শুধু সাকিনাকে দেখে আর মনে মনে ভাবে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য সাকিনার ভিতর লুকিয়ে আছে। প্রকৃত ভালোবাসার মানুষকে পরিবেশ পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেক সময় দূরে চলে যেতে হয়। আবার সেই ভালোবাসার টানেই, পাখি যেমন নীড়ে ফিরে আসে তারাও ফিরে আসে আপন ঘরে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর