শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০২২ ০০:০০ টা
অন্যরকম

সাহিত্যে নোবেল প্রত্যাখ্যান করা জ্যাঁ পল সার্ত্রের গল্প

সাহিত্যে নোবেল প্রত্যাখ্যান করা জ্যাঁ পল সার্ত্রের গল্প

সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন দুজন খ্যাতিমান। একজন জ্যাঁ পল সার্ত্রে অন্যজন বরিস পাস্তের্নাক। সেই তালিকায় আরও একজরে নাম প্রায় যুক্ত হয়েই গিয়েছিল। তিনি আর কেউ নন, জনপ্রিয় গায়ক ও সাহিত্যিক বব ডিলান। বব ডিলান প্রথমে নোবেল নিতে চাননি। পরে অবশ্য বব ডিলান পুরস্কারটা নেন। আজ রইল জ্যাঁ পল সার্ত্রের গল্প।

জ্যাঁ পল সার্ত্রে নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন, এমন গুজব অনেকের মতো সার্ত্র নিজেও শুনেছিলেন। কিন্তু এই পুরস্কার তিনি চান না। তিনি ছিলেন বিশ্বখ্যাত ফিলোসফার ও সাহিত্যিক। ৪ অক্টোবর ১৯৬৪ প্যারিসের ল্যঁ ফিগারো দৈনিকে সার্ত্র নোবেল পাচ্ছেন, এই মর্মে একটি খবর ছাপা হয়। কিন্তু সার্ত্র তা প্রত্যাখ্যান করেন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে এবং অন্য কারণে। সার্ত্র মূলত দার্শনিক হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নাটক, উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখেছেন। রোডস টু ফ্রিডম, আইরন ইন দ্য সোল কার বিখ্যাত উপন্যাস। লিখেছেন আত্মজৈবনিক। তাই তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান সাহিত্যিকদের একজন বলে বিবেচনা করা হয়। সে খবর তার নজরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নোবেল কমিটির সচিবের উদ্দেশে একটি চিঠি পাঠিয়ে সার্ত্র জানালেন, এই পুরস্কার তাঁর কাম্য নয়। শুধু এই বছর নয়, অন্য কোনো সময়েই এই পুরস্কার তাঁকে দেওয়া হোক, তা তিনি চান না। বিস্তর বিনয় ও ক্ষমা প্রার্থনা করে অনুরোধটি করলেন তিনি। নোবেল কমিটি বা পুরস্কারকে কোনোরূপ দোষারোপ না করে এই প্রত্যাখ্যানকে একেবারেই ‘ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত’ বলে জানান তিনি। কিন্তু অনেকে বলেন যে সার্ত্রের এই প্রত্যাখ্যানের নেপথ্যে কারণ তাঁর আগে আলবেয়ার কামুর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি। আলবেয়ার কামু ফিলোসফিক্যালি সার্ত্রে দ্বারাই প্রভাবিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল গুরু-শিষ্যের। আলবেয়ার কামুর মৃত্যু সংবাদে সার্ত্রের চোখে কান্না দেখা গিয়েছিল। কামু পুরস্কারটি পেয়েছিলেন ১৯৫৭ সালে এবং খবরটি পাওয়ার পর খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে নোবেল কমিটিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন সার্ত্রে। কিন্তু এরপর সার্ত্র আর কামুর মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়। আগে পুরস্কার পেয়ে কামু এগিয়ে গেলেও কয়েক বছর পর ওই একই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে সার্ত্র হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন নোবেল প্রাপ্তি আদতে তেমন মহান কিছু নয়। কিন্তু সার্ত্রের বন্ধু প্লেভে সে সময় জানিয়েছিলেন, সার্ত্রের মধ্যে আলবেয়ার কামুকে নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না। থাকলে তিনি কামু মারা যাওয়ার পর কান্না করতেন না। নিচে সার্ত্রের চিঠিটি দেওয়া হলো :

১৪ অক্টোবর, ১৯৬৪, প্যারিস

প্রিয় সচিব মহোদয়,

আমি আজই জানতে পেরেছি, কোনো কোনো সূত্র অনুসারে আমি এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেতে পারি। পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার আগে তা নিয়ে কথা বলা অবিবেচনাপ্রসূত মনে হতে পারে, কিন্তু কোনো ভুল বোঝাবুঝি ঠেকানোর জন্য এই চিঠি লিখছি। আপনাকে আমি আশ্বস্ত করতে চাই যে সুইডিশ একাডেমি, যা অনেক খ্যাতিমান লেখককে সম্মানিত করেছে, তার প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে। তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত ও বস্তুগত কারণে আমি সেসব লেখকের তালিকাভুক্ত হতে চাই না। শুধু ১৯৬৪ সালে নয়, এর পরে কোনো সময়েই এই সম্মান আমার কাক্সিক্ষত নয়।

বিনম্র শ্রদ্ধাসহ,

জ্যাঁ পল সার্ত্র

২২ অক্টোবর সুইডিশ ও ২৩ অক্টোবর ফ্রান্সের একটি পত্রিকায় ছাপা হয় তাঁর প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা। এখানে দীর্ঘ বিবৃতিতে তিনি ব্যাখ্যা করেন পুরস্কার গ্রহণে নিজের অনীহার কথা :

‘আমি ১৯৪৫ সালের পর থেকে সব ধরনের অফিশিয়াল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করে আসছি। আমি জ্যাঁ পল সার্ত্র লিখে স্বাক্ষর করা আর নোবেলজয়ী জ্যাঁ পল সার্ত্র লিখে স্বাক্ষর করা এক নয়। একজন লেখক যখন এ ধরনের কোনো পুরস্কার গ্রহণ করেন, তিনি আদতে পুরস্কার প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।’

সার্ত্রের বন্ধু প্লেভে জানান, ‘বিশ্বযুদ্ধের পর সার্ত্রে নিউটন বোমার আবিষ্কারকের ‘নোবেল’ নিতে অনাগ্রহী ছিলেন এবং মনে করতেন এ পুরস্কার নেওয়া মানেই নৈতিকভাবে তার মানবিকতার পরাজয় ঘটবে।’

সর্বশেষ খবর