শুক্রবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
গল্প

পকেটমার

রোকন রেজা

পকেটমার

ঈশ্বরদী রেলস্টেশনের প্ল্যাটফরমে পানির ট্যাপে অজু করে পকেটে হাত দিয়ে কামরান সাহেব দেখলেন তাঁর রুমাল নেই। বড়ই ব্যথিত হলেন তিনি। এদিক-ওদিক তাকালেন। স্টেশনে তেমন একটা ভিড় নেই। তিনি মনে করার চেষ্টা করলেন রুমালটা কোথায় ফেলেছেন। কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। ভেজা দুহাত উপরে তুলে মাথার চুলের সঙ্গে মুছতে লাগলেন। তারপর আস্তে আস্তে প্ল্যাটফরমে থেকে নেমে সামনের মসজিদের মধ্যে ঢুকে গেলেন।

কামরান সাহেব একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব। বছর তিনেক হলো চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। অবসর নেওয়ার পর হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলেন তিনি একা। বড়ই একা। নিঃসঙ্গ। তাঁর সঙ্গে কথা বলার মতো আশপাশে কেউ নেই।

চাকরিজীবনে কামরান সাহেব তাঁর স্ত্রী রেবেকাকে কখনোই তেমন একটা সময় দেননি। রেবেকার কলেজের চাকরি। পাশাপাশি লেখালেখির নেশা। মাঝে মাঝে রেবেকার কবিতা পত্রিকায় ছাপা হয়। রেবেকা তাঁর নিজের মতো করে একটা জগৎ তৈরি করে নিয়েছে। সেটা নিয়েই সে ব্যস্ত।

কামরান সাহেবের বড় মেয়ে শিলা ডাক্তারি পাস করে স্বামীর সঙ্গে কানাডায় আর ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে স্টাইফেন পেয়ে এখন আমেরিকায়। বাড়িতে তিনজন মানুষ-কামরান সাহেব, তাঁর স্ত্রী রেবেকা আর কাজের লোক সেলিম।

কামরান সাহেবের মেয়ে কানাডা থেকে মাসে মাসে টাকা পাঠায়। যদিও তিনি প্রতিবারই বলেন, তাঁর টাকার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু সে শুনবে না। টাকা সে পাঠাবেই।

কামরান সাহেব এখন মাঝে মাঝে কিছু টাকা পকেটে নিয়ে স্টেশনে চলে আসেন। অযথাই স্টেশনের এমাথা-ওমাথা ঘোরাঘুরি করেন। কোনো কোনো দিন ওই টাকা দিয়ে খাবার কেনেন। খাবার কিনে স্টেশনে থাকা অচল অসহায় মানুষদের মধ্যে বিতরণ করেন। গত পরশু রাতে তিনি সেলিমকে সঙ্গে নিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে কম্বল বিতরণ করেছেন। তাঁর ইচ্ছা আছে তিনি একটি বৃদ্ধাশ্রম বানাবেন। যেখানে অসহায় বয়স্ক দরিদ্র মানুষেরা বিনা খরচে থাকবে। তিনি চান জীবনের শেষ কটা দিন বৃদ্ধদের একটু আনন্দে কাটুক। বিষয়টা তিনি তাঁর মেয়ে শিলার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। শিলাও টাকা দিতে রাজি হয়েছে। জানি না তাঁর এ ইচ্ছা আল্লাহ শেষ পর্যন্ত পূরণ করেবেন কি না!

মনা স্টেশনের টাইলসের বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে বসে বাদাম খাচ্ছিল আর কামরান সাহেবকে লক্ষ্য করছিল। প্রায় আধা ঘণ্টা পর কামরান সাহেব যখন মসজিদ থেকে বেরোলেন মনা তাঁর পিছু নিল। কামরান সাহেব যখন একটু নিরিবিলি জায়গায় এলেন মনা সাহস করে সামনে এসে দাঁড়াল।

-স্যার আমার নাম মনা। আমি একজন পকেটমার। আপনার রুমালটা স্যার আমি পকেট মেরেছি। এই যে আপনার রুমাল। স্যার আমি বুঝতে পারিনি এর মধ্যে টাকা নেই। আমার ভুল হয়েছে স্যার।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মনা থামল। পকেট থেকে রুমালটা বের করে মেলে ধরল। কামরান সাহেব হাত বাড়িয়ে রুমালটা নিতেই মনা আচমকা তাঁর পা জড়িয়ে ধরল।

-আমাকে মাফ করে দেন স্যার। আমি বুঝতে পারিনি। পরশুদিন আপনি আমাকে বিরানির প্যাকেট দিয়েছিলেন স্যার। আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।

কামরান সাহেব বেশ অবাক হলেন। তিনি দেখলেন মনা বড়ই অনুতপ্ত। এরকম পকেটমার তিনি আগে দেখেননি। তিনি মনাকে হাত ধরে তুললেন। আশপাশে দুচারজন লোক জড়ো হয়েছে। কামরান সাহেবের একটু সিগন্যাল পেলেই তারা শুরু করে দেবে মারপিট। কামরান সাহেব একটু কৌশলি হলেন। মনাকে ওখান থেকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। মানুষগুলো আস্তে আস্তে যে যার মতো কেটে পড়ল। তিনি বললেন, মনা তুমি রুমালটা ফিরিয়ে দিতে এলে কেন?

মনা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, আমি বুঝতে পারিনি স্যার। আমি আপনার রুমালের মধ্যে টাকা দেখেছিলাম যখন আপনি কোণার দোকানে চায়ের বিল দিলেন।

কামরান সাহেব মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, পরে আমি রুমাল থেকে টাকা সরিয়ে বুক পকেটে রেখেছিলাম। তুমি বোধহয় খেয়াল করনি।

তারপর কিছু সময় নীরবতায় কেটে গেল। মনা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল কামরান সাহেবের সামনে। কামরান সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, মনা তুমি থাক কোথায়?

-চাটমোহর স্টেশনের পাশের একটা বস্তিতে। মাঝে মাঝে স্যার... কথা শেষ করল না মনা।

কামরান সাহেব মনার দিকে তাকালেন। পরনে একটা কালো রঙের পুরনো ফুলপ্যান্ট আর হলুদ রঙের ময়লা হাফ-হাতা শার্ট। হাড় জিরজিরে দেহ। ফ্যাকাশে চোখ। কামরান সাহেব বললেন, তুমি কি নেশা করো মনা?

-জি না স্যার। সারা দিন আমি স্টেশনেই বসে থাকি। ট্রেন আসলে দু’একটা সুযোগ যদি পাই...

-দুপুরে কিছু খেয়েছ?

মনা একথার কোনো উত্তর দিল না। কামরান সাহেব মনাকে ১০০টা টাকা দিলেন আর একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দিয়ে বললেন, এখানে আমার ঠিকানা লেখা আছে। তুমি আগামীকাল সকালে আমার সঙ্গে দেখা করবে।

মনা পরের দিন কামরান সাহেবের সঙ্গে দেখা করল। কামরান সাহেব তাকে নিয়ে গেলেন রূপগঞ্জে পাইকারি সবজির হাটে। ওখান থেকে দুই বস্তা সবজি কিনে মনাকে বললেন, মোহনগঞ্জ হাটে তুমি এগুলো খুচরা দরে বিক্রি করবে। তাতে তোমার লাভ হবে। লাভের টাকা তোমার।

কামরান সাহেব মনাকে সবজি কিনে দিয়ে ধরে নিয়েছিলেন সে আর ফিরবে না। ওগুলো বিক্রি করে সে একবারে অনেক টাকা পাবে। তাতে তার বেশ কিছু দিন চলে যাবে। এ স্টেশনে দু’চার মাস সে আর আসবে না।

কিন্তু অবাক করে দিয়ে মনা সবজিগুলো মোহনগঞ্জ হাটে বিক্রি করে সন্ধ্যা নাগাদ ফিরে এলো। ফিরে এসে বলল, স্যার সবজি বেচে তিন শ দশ টাকা লাভ হয়েছে।

কামরান সাহেব বড়ই খুশি হলেন। তিনি টাকাগুলো মনার হাত থেকে নিয়ে আবার তার হাতেই ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, এই টাকাগুলো তোমার। তুমি এভাবে সবজি কিনে হাটে হাটে বিক্রি কর।

মনা এখন সফল ব্যবসায়ী। চাটমোহর বাজারে তার দুটি সবজির দোকান। দোকানের পাশেই চার শতক জমি কিনে টিনের ঘর করেছে সে। গত ফাল্গুনে বিয়ে করেছে মনা। কামরান সাহেবকে সপরিবারে দাওয়াত করেছিল। কামরান সাহেব তাঁর স্ত্রী রেবেকাকে নিয়ে মনার বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে সারা দিন আনন্দ করেছেন তাঁরা। আসার সময় মনার বউ যখন পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেল কেন জানি হঠাৎ করেই কামরান সাহেবের নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েটাকে আয়োজন করে বিয়ে দিতে পারেননি তিনি। পাত্রপক্ষের হাতে সময় ছিল খুবই কম। তারপরই মেয়েটা চলে গেল বিদেশ।

কামরান সাহেবের মনটা হঠাৎ করেই বিষণœ হয়ে গেল। চোখে পানি এসে গেল। তিনি মনার বউয়ের হাতে ১০ হাজার টাকা দিয়ে বললেন, এই টাকাটা নিয়ে তোমরা কোথাও বেড়িয়ে এসো। আমার পক্ষ থেকে তোমাদের বিয়েতে এটা আমার উপহার।

মনা নতুন বউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। কেন কাঁদছিল সে জানে না। অতিরিক্ত আনন্দে মানুষের চোখে বোধহয় এমনিতেই পানি এসে যায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর