শুক্রবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২২ ০০:০০ টা
পর্ব ৪

একুল নেই ওকুল নেই

সমরেশ মজুমদার

একুল নেই ওকুল নেই

[পূর্বে প্রকাশের পর]

পরপর দারুণ রঙিন হয়ে থাকা ক্যাসিনোর সারি। খুব বেশি লোকজন যাওয়া-আসা না করলেও এমন কিছু কম নয়। শিবকুমার বলল, ‘সারা রাত ধরে লোকজন এখানে জুয়া খেলতে আসে। এখন বোধহয় একটু ঝিমিয়ে নেওয়ার সময়।’

কমল জিজ্ঞাসা করল, ‘কখন বন্ধ হয়?’

‘বন্ধ! না না। ক্যাসিনোগুলো বন্ধ হয় না। অনেকে বলে এরা হলো জুয়াড়িদের হার্টবিট। বন্ধ হলেই খতম।’ শিবকুমার বলল।

জুয়াড়ি শব্দটা পছন্দ হলো না কমলের। ক্যাসিনো এসে দুই পাঁচ ডলার মজা করে যারা খেলে তারা যদি জুয়াড়ি হয় তাহলে সেই খেলা যে দ্যাখে, দেখে উপভোগ করে তাকেও জুয়াড়ি বলতে হয়। এ রকম হলে তার তো এখানে আসা উচিত হয়নি। বাবা যদি শোনেন তাহলে খুব ধাক্কা খাবেন।

শিবকুমার ওদের নিয়ে একটা ফাস্টফুড জায়ান্টে গেল। সবাই কী খেতে চায় তা বাজেটের মধ্যে এনে অর্ডার দিল। এখানে নিজেকে নিজেই সাহায্য করতে হয়। ওরাই খাবার এনে টেবিলে রাখলে খাওয়া শুরু হলো। খেতে খেতে দিশা জিজ্ঞাসা করল, ‘এ দেশে কি এই প্রথমবার?’

কথা না বলে মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল কমল নিঃশব্দে। মধ্যবিত্ত বেকার বাঙালির পক্ষে অপ্রয়োজনে আমেরিকায় আসা যে অসম্ভব ব্যাপার তা কি দিশা জানে না? এবার এ চাকরি পাওয়ার জন্য এ দেশে আসতে পেরেছে সে বাবার উদার সাহায্যের জন্য। এ কথা বলে কী হবে। বারবার ‘আমি দরিদ্র’ বলতে বলতে সেটাই একসময় অহংকারে পরিণত হয়। দারিদ্র্যের অহংকার।

কমল খেলেনি। কিন্তু কয়েকটা ক্যাসিনোর ভিতর ঢুকে ঘুরে দেখতে গিয়ে তাদের কাছ থেকে অনেক গিফট পেয়েছে। ভালো কলম, রঙের বাক্স, ইরেজার থেকে পেনসিল বাক্স। পকেট ভরে গেল কমলের।

বিকালে ফেরার বাসে উঠে ওদের কথাগুলো শুনতে পেল।

শিবকুমারের এক বন্ধু সত্তর ডলার হেরেছে। তার মুখ খুব গম্ভীর। বাকিদেরও মুখে হাসি নেই। শিবকুমার যা জিতেছিল তা দিয়ে লাঞ্চ করিয়েছে সবার। দিশার অবস্থা কী তা কেউ জানে না। একজন সে কথা জিজ্ঞাসা করলে সে হাত তুলে প্রসঙ্গ চাপা দিতে ইশারা করেছিল।

নতুন আস্তানায় গিয়ে ভালো লাগল কমলের। একটাই সমস্যা তার। নিজে কখনো রান্না না করায় এখন কিছুতেই করতে পারছে না। কিন্তু ঘর ভাড়া দেওয়ার পরও রেস্টুরেন্টে খেলে অনেক খরচ হয়ে যাচ্ছে বলে সে শিবকুমারের সঙ্গে পরামর্শ করেছিল। কিন্তু সেখানেও আরেক সমস্যা। শিবকুমার মাদ্রাজের লোক। সে মাদ্রাজি খাবার রান্না করতে অভ্যস্ত। কারণ সেটাই সে খেয়ে থাকে। বাঙালি খাবারের বিন্দুবিসর্গ তার জানা নেই। শিবকুমার পরামর্শ দিল দিশার সঙ্গে কথা বলতে। যেহেতু দিশা বাঙালি মেয়ে তাই সে সাহায্য করতে পারে।

নতুন আস্তানায় গিয়ে ভালো লাগল কমলের। একটাই সমস্যা তার। নিজে কখনো রান্না না করায় এখন কিছুতেই করতে পারছে না। কিন্তু ঘর ভাড়া দেওয়ার পরও রেস্টুরেন্টে খেলে অনেক খরচ হয়ে যাচ্ছে বলে সে শিবকুমারের সঙ্গে পরামর্শ করেছিল।  কিন্তু সেখানেও আরেক সমস্যা...

শনি-রবিবার অফিস ছুটি থাকে। শুক্রবার বিকালে অফিস ছুটির পর দিশা যখন বাইরে বের হচ্ছে তখন শিবকুমার তাকে কমলের সমস্যার কথা বলল।

কমলের দিকে তাকাল দিশা, হেসে বলল, ‘সাত কোটি বাঙালি রে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি। মা ঠাকুরানের মতো রান্না করার কী দরকার? নিজের মতো করে খাবার বানিয়ে নিন।’

‘নিজের মতো করে মানে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল কমল।

‘গরম জলে চাল ফেললে ভাত হয়, সেটা জানেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘ছাই জানেন। কতক্ষণ ফুটলে ওগুলো ভাত হবে ঘ্যাট পাকিয়ে যাবে না সেটা কি জানা আছে?’ প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিল দিশা। ‘জানেন না। করতে করতে শিখবেন। তাতে আলু পটোল ছেড়ে দিলে সেদ্ধ হয়ে যাবে। সেই সেদ্ধ নুন তেল লঙ্কা দিয়ে মেখে গরম ভাতে মাখন ছড়িয়ে খেয়ে নিন। দিব্যি লাগবে। কদিন খাওয়ার পর যখন জিবে একঘেয়ে বলে মনে হবে তখন অন্য কিছু এক্সপেরিমেন্ট করবেন। মাছ টুকরো টুকরো করে কিনে এনে তেলে ভেজে গরম ভাতের সঙ্গে খেয়ে নেবেন। আমাদের মা-দিদিমাদের হাতে প্রচুর সময় ছিল তাই তারা রান্নাঘর থেকে উঠতেন না। আপনি তো বাঁচার জন্য খাবেন, খাওয়ার জন্য নিশ্চয়ই বাঁচবেন না।’ কথাগুলো বলে চলে গেল দিশা।

শিশু যখন হাঁটতে চেষ্টা করে তখন বারবার আছাড় খায়। সাঁতার শেখার সময়টা বেশির ভাগ সময় সুখকর হয় না। রান্না করতে গিয়ে নাজেহাল হতে হতে শেষ পর্যন্ত একটু ধাতস্থ হলো কমল। অন্তত ভাত আর সেদ্ধটা নিজের হাতে তৈরি করে তার মনে হলো, এত সুখাদ্য সে কখনো খায়নি।

দিন সাতেক পরে অফিস ছুটির পর সে দেখল দিশা দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতে দিশা জিজ্ঞাসা করল, ‘ছেলেবেলায় কি পড়েছিলেন, নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচাঘর খাসা।’

‘নিশ্চয়ই পড়েছিলাম। কিন্তু সেটা এখন কেন জানতে চাইছেন বুঝতে পারলাম না।’ খুব শান্ত গলায় বলল কমল।

‘আপনি দেখছি আর একজন টিউবলাইট।’ হাসতে হাসতে কথাগুলো বলে চলে গেল দিশা। অবাক হয়ে তার যাওয়া দেখল কমল। কোনো কারণ ছাড়াই দিশা তাকে এভাবে অপমান করল কেন? টিউবলাইটের মতো সে তৎক্ষণাৎ রিঅ্যাক্ট করেনি বলে এমন কথা বলা যে সৌজন্যের মধ্যে পড়ে না তা দিশাকে বুঝিয়ে বলা উচিত। তার পরই তার খেয়াল হলো এই লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে অফিসের বাইরে রোজ প্রায় কারও সঙ্গেই দেখা হয় না। অফিস থেকে ঘরে ফিরে নিজের খাবার তৈরি করে চুপচাপ শুয়ে থাকা ছাড়া তো অন্য কিছু করার নেই। ইংরেজি ছাড়া কথা বলার উপায় নেই। এই সামান্য কিছুদিন সে যত ইংরেজি বাক্য বলেছে তা দেশে থাকলে সারা জীবনে বলত কি না সন্দেহ। একমাত্র দিশার সঙ্গেই সে বাংলায় কথা বলতে পারে। বললে খুব তৃপ্তি পাওয়া যায়। ঝগড়া করে সরে দাঁড়ালে বাংলা ভাষায় কথা বলা বন্ধ হয়ে যাবে।

সত্যি তো, সে অনেক কিছুই চট করে বুঝতে পারে না। বুঝতে সময় লাগে।

এটা থেকে চট করে বেরিয়ে আসা কি সম্ভব!

দিন কয়েক পরে শিবকুমার তাকে বলল, ‘একটা সমস্যা হয়েছে।’

অবাক হয়ে তাকাল কমল। চোখে জিজ্ঞাসা।

শিবকুমার বলল, ‘খুব বিপদে পড়েছে দিশা। ওকে আমাদের কিউবার অফিসে বদলি করা হতে পারে।’

‘বিপদ কেন বলছ?’

‘ওখানে কোনো বাঙালি নেই, ওখানকার সব কর্মচারী অবিবাহিত। কারণ বিবাহিতদের যেসব পারিবারিক সমস্যা থাকে তা কোম্পানি ওখানে এড়িয়ে যেতে চায়। দিশা বিবাহিত হলে ওকে বদলি করা হতো না।’ শিবকুমার বলল।

‘একা থাকতে তো এখানেও হচ্ছে। তাহলে?’

‘নিরাপত্তার অভাব। যেটা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে না।’

‘ও’, কমল বলল, ‘দিশা আপত্তি জানাক।’

‘লাভ হবে না। নিয়ম সবার ক্ষেত্রেই নিয়ম।’ শিবকুমার বলল, ‘যদি দিশা বিবাহিত হতো তাহলে কোম্পানি ওকে কখনই পাঠাত না। এ ব্যাপারে তুমি কি ওকে সামান্য কিছুদিনের জন্য সাহায্য করতে পারবে?’ শিবকুমার জিজ্ঞাসা করল।

‘ঠিক বুঝতে পারলাম না! আমি সাহায্য করব।’ অবাক হলো কমল।

‘তুমি করলে ব্যাপারটা সহজ হয়।’

‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না!’ কমল বলল।

‘তোমাকে দিশার স্বামী হতে হবে!’ গম্ভীর গলায় বলল শিবকুমার

‘স্বামী! আমি? তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে?’

‘একটুও না। দিশা যদি বিবাহিত হয় তাহলে ওকে কিউবায় বদলি করতে পারবে না কোম্পানি। কিন্তু আমি বিবাহিত বললেই তো কোম্পানি মেনে নেবে না। বলবে বিয়ের সার্টিফিকেট দেখাও। সেই সার্টিফিকেটটা দরকার।’ শিবকুমার বলল।

‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ মাথা নাড়ল কমল, ‘অবিবাহিত হলে যদি কোম্পানি যেখানে ইচ্ছে সেখানে ট্রান্সফার করতে পারে তাহলে আমিও তো বিপদে পড়তে পারি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারে তো সে রকম কিছু লেখা ছিল না।’ কমল মিনমিনে গলায় বলল।

‘এই বিপদ থেকে উদ্ধারের একটা ভালো রাস্তা আছে।’ শিবকুমার বলল।

‘কী রকম?’

‘তুমি তো বিবাহিত নও, তাই না?’

‘না।’ মাথা নাড়ল কমল।

‘তোমার আর দিশার একই সমস্যা। কিন্তু তোমাদের পক্ষে এখনই এই এলএতে পার্টনার খুঁজে বিয়ে করা সম্ভব নয়। বিয়ে জীবনে একবারই করে মানুষ যদি না দ্বিতীয়বার করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তোমরা যারা কখনো বিয়ে করনি তারা লাসভেগাসে গিয়ে বিয়ে করে সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে পার।’ শিবকুমার বলল, ‘তাহলে তোমাদের কোম্পানি কিউবায় বদলি করতে পারবে না।’

‘আমি! বিয়ে? কী যা তা বলছ?’ আঁতকে উঠল কমল।

[চলবে]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর