শুক্রবার, ১৮ নভেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
ইমদাদুল হক মিলন এর বড় গল্প

পাতালপুরি

পর্ব ০২

পাতালপুরি

[পূর্ব প্রকাশের পর]

অর্জুন লাফ দিয়ে খাট থেকে নামল। গৌতমও নামল। শুধু প্রতিমা হতভম্ব হয়ে বসে রইল তার খাটে।

    ঘরের দরজায় তখন টুক টুক করে শব্দ হচ্ছে। ‘অর্জুন, অর্জুন! দরজা খোল বাবা। আমি এসেছি। তোর পিসিমণি।’

অর্জুন ছটফটে ভঙ্গিতে দরজা খুলতে গেল। তার সঙ্গে গেল গৌতম। প্রতিমা বিছানা থেকে নেমে বলল ‘খুলো না, খুলো না। দরজা খুলো না। ব্যাপারটা অন্য রকম কিছুও হতে পারে।’

গৌতম বলল, ‘কী রকম?’

‘অনেক সময় তেনারা এসে নাম ধরে ডাকেন। ঘরের বাইরে ডেকে নিয়ে...।’

অর্জুনও শুনল কথাটা, তবে বিশ্বাস করল না। তার নাম ধরে এরকম স্পষ্ট ডাক, দরজায় শব্দ, না মা ভুল বলছে।

অর্জুন কথা বলবার আগেই বাইরে থেকে ডাক এলো। ‘অর্জুন, ভয় পাসনে। আমি তোর পিসিমণিই। দরজা খোল, বাবা।’

‘এখনই খুলছি, পিসিমণি।’

অর্জুন দরজার কাছে যেতেই প্রতিমা তার হাত চেপে ধরল। ‘দাঁড়া, দাঁড়া। একটু পরীক্ষা করে নিই।’

তার পর শিউলির উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোমার সঙ্গে আর কেউ আছে? থাকলে তাকে কথা বলতে বলো।’

বাইরে থেকে শিউলির গলা ভেসে এলো। তবে প্রতিমার কথার জবাব দিল অর্জুনের মাধ্যমে। ‘শোন অর্জুন, আমি একা এসেছি। তবে তুই ছাড়া কারও সঙ্গে আমি কথা বলব না। শুধু তোর সঙ্গে বলব। দরজা খোল বাবা। নয়তো আমি এখনই ফিরে যাবো।’

গৌতম বলল, ‘তোর গলা শুনে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, তুই শিউলি। আমার বোন। এত রাতে কোত্থেকে এলি?’

‘বললাম তো, অর্জুন ছাড়া কারও সঙ্গে আমি কথা বলবো না। অর্জুন, আমি কি চলে যাবো, বাবা?’

‘না না পিসিমণি। তুমি দাঁড়াও, আমি দরজা খুলছি।’

অর্জুনের এখন সাতের ওপর বয়স। এই বয়সেই ভালো লম্বা হয়েছে। শরীরে শক্তি অন্য শিশুদের তুলনায় বেশি। সাহসও অনেক। সে আর কোনও কিছুর তোয়াক্কা করল না। দরজা খুলে দিল।

ঘরে ততক্ষণে আলো জ্বেলেছে প্রতিমা। সেই আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল, দরজার বাইরে শিউলি দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের আলো আর চাঁদের আলো দুটোই পড়েছে তার শরীরে। সেই আলোয় রাজকন্যার মতো লাগছে তাকে। কী সুন্দর চেহারা হয়েছে! চাঁদের আলোর মতো গায়ের রং। পরনের শাড়িটা অনেক দামি। গা-ভর্তি গহনা। পায়ে চুমকি বসানো জুতো। গা থেকে আসছে অপূর্ব সুগন্ধ। নিজের সৌন্দর্যে ঝলমল ঝলমল করছে মেয়েটি।

এ তো সেই শিউলি নয়! এ তো অন্য শিউলি! এ তো এক রাজকন্যা! যেমন রূপ তেমন গহনা আর পোশাক, তেমন সুগন্ধে ভরা শরীর। কোথায় সেই গরমে ঘামে আর সংসারের কাজে ম্লান হয়ে যাওয়া মেয়েটি আর কোথায় এই মেয়ে!

তিনজন মানুষ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল শিউলির দিকে।

কয়েক মুহূর্ত মাত্র সময়, অর্জুন ছুটে এসে শিউলিকে জড়িয়ে ধরল। ‘পিসিমণি তুমি, সত্যি তুমি?’

শিউলিও জড়িয়ে ধরল অর্জুনকে। ‘হ্যাঁ রে বাবা। সত্যি আমি! কেন, আমাকে তুই চিনতে পারছিস না?’

‘পারছি তো! তবে তুমি অনেক বদলে গেছ।’

শিউলি হাসল। ‘কেমন বদলেছি, বল তো?’

‘পাতালপুরির রাজকন্যার মতো দেখাচ্ছে তোমাকে। সেই রাজকন্যার গল্প তুমিই আমাকে বলেছিলে।’

গভীর আবেগে বোনকে জড়িয়ে ধরার জন্য এগিয়ে গেল গৌতম। শিউলি ছিটকে সরে গেল। ‘অর্জুন, তোর বাবাকে বলে দে, আমার সামনে যেন না আসে। তোর মাকেও বল। তা হলে আমি এক্ষুণি চলে যাবো। তুই ছাড়া আমার সামনে কেউ আসতে পারবে না। আমাকে ছুঁতে পারবে না। তা হলে...।’

অর্জুনের এখন সাতের ওপর বয়স। এই বয়সেই ভালো লম্বা হয়েছে। শরীরে শক্তি অন্য শিশুদের তুলনায় বেশি। সাহসও অনেক। সে আর কোনো কিছুর তোয়াক্কা করল না। দরজা খুলে দিল।

ঘরে ততক্ষণে আলো জ্বেলেছে প্রতিমা। সেই আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল, দরজার বাইরে শিউলি দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের আলো আর চাঁদের আলো দুটোই পড়েছে তার শরীরে। সেই আলোয় রাজকন্যার মতো লাগছে তাকে। কী সুন্দর চেহারা হয়েছে! চাঁদের আলোর মতো গায়ের রং। পরনের শাড়িটা অনেক দামি। গা-ভর্তি গহনা। পায়ে চুমকি বসানো জুতো। গা থেকে আসছে অপূর্ব সুগন্ধ। নিজের সৌন্দর্যে ঝলমল ঝলমল করছে মেয়েটি।

এ তো সেই শিউলি নয়! এ তো অন্য শিউলি! এ তো এক রাজকন্যা!

কথা শেষ করল না শিউলি। গৌতম থতমত খেয়ে থেমে গেল।

প্রতিমা কাতর গলায় বলল, ‘কেন, আমরা কি তোমার কেউ না?’

‘অর্জুন, তুই ছাড়া এই বাড়িতে আমার আর কেউ নেই। এই পৃথিবীতেও তুই ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তুই ছাড়া কেউ আমায় ভালোবাসেনি। আদর স্নেহ করেনি। ছোটবেলায় মা বাবা করেছেন। তাঁরা গত হওয়ার পর আমার দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। শুধু তুই আমাকে ভালোবেসেছিস। আমার জন্য কেঁদেছিস। অন্তর থেকে ভালোবাসা আর অন্তর থেকে কাঁদা আমার জন্য তুই-ই কেঁদেছিস। এ জন্য আমি আজ তোর কাছে এসেছি। আর কারও সঙ্গে কথা বলবো না, কারও দিকে তাকাবও না।’

পিসিমণির কোমরের কাছটা দু’হাতে জড়িয়ে ধরে গভীর আবেগে অর্জুন বলল, ‘আমার খুব ভালো লাগছে, পিসিমণি। খুব ভালো লাগছে। আর কারও সঙ্গে তোমার কথা বলবার দরকার নেই। তুমি শুধু আমার সঙ্গেই বলো। তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? কোথা থেকে এতদিন পরে এলে? আমরা সবাই ভেবেছি তুমি জলে ডুবে...।’

প্রতিমা বলল, ‘শুধু আমরা না, পাড়ার সবাই, গ্রামের সবাই তাই জানে। আরতি আর সন্ধ্যার চোখের সামনে তুই নদীতে ডুবে গিয়েছিলি।’

গৌতম বলল, ‘শুধু আমাদের পাড়া আর শোনাতলা গ্রামই নয়, এলাকার সবাই তাই জানে। দশ গ্রামের লোক।’

এসব কথায় কানই দিল না শিউলি। অর্জুনের হাত ধরে বলল, ‘চল, নিমতলায় বসে তোকে আমি সব বলবো।’

‘চলো, চলো।’

এই বাড়িটা দক্ষিণমুখী। বাড়ির সঙ্গে পায়েচলা একটা পথ। তার পর কিছুটা পতিত জমি। তার পরই শীর্ণ ইছামতী, যে নদীতে ডুবে গিয়েছিল শিউলি।

বাড়িতে তিনটা ঘর আর রান্নাচালা। রান্নাচালার পাশে চাপকল বসানো একটুখানি পাকা জায়গা। বড় ঘরটায় এখন সবাই থাকে। অর্জুনকে নিয়ে শিউলি থাকত পশ্চিম দিককার ছোট ঘরটায়। পুবদিককার ঘরটায় কেউ থাকে না। সংসারের হাবিজাবি জিনিসে ভর্তি। মাঝারি ধরনের গৃহস্থবাড়ি। সামনের দিকে টিনের বেড়া। তার মাঝখানে টিনের একটা দরজা। ওই দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে হয়। রাতেরবেলা সেই দরজা ভিতর থেকে বন্ধ থাকে। আজ কি খোলা ছিল? না হলে শিউলি ঢুকল কী করে?

এই প্রশ্ন এলো গৌতমের মাথায়।

অর্জুনকে নিয়ে শিউলি উঠোনে নেমে যাওয়ার পরই কথাটা সে বলল। ‘তুই ঢুকলি কী করে? দরজা তো ভিতর থেকে বন্ধ ছিল! আমি নিজ হাতে বন্ধ করেছি।’

অর্জুনকে নিয়ে নিমতলার দিকে হাঁটতে হাঁটতে শিউলি বলল, ‘শোন অর্জুন, এখনই একটা কাণ্ড হবে। তোর মা-বাবা দুজনেই এখন বড়ঘরের বারান্দায় বসে পড়বে, তার পর থেকে একটাও কথা বলবে না। একদম চুপচাপ বসে থাকবে। উঠে দাঁড়াবেও না।’

‘কেন?’

‘আমি সেই ব্যবস্থা করছি। নয়তো তোর আমার কথার মাঝখানে তোর বাবা-মা মাঝে মাঝে কথা বলে খুবই বিরক্ত করবে আমাদের।’

‘সেটা কীভাবে করবে?’

‘আমি এসব পারি। ওই দেখ দুজনেই বারান্দায় বসে পড়েছে। ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।’

অর্জুন মুখ ঘুরিয়ে দেখল, পিসিমণি যা বলেছে ঠিক তাই হয়েছে। বাবা মা বারান্দায় বসে বোবার মতো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে চেষ্টা করেও তারা কথা বলতে পারছে না।

শিউলি বলল, ‘আমি অনেক কিছু পারি। বাইরে থেকে বন্ধ দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেছি। আমি মনে মনে শুধু বলেছি, দরজা খুলে যাক। দরজা খুলে গেছে। তোর বাবা মাকে বলেছি, বসে পড়ো আর বোবা হয়ে যাও। তাই হয়েছে।’

অর্জুন ভয় পেল। ‘মা বাবা কি তা হলে আর কথা বলতে পারবে না? উঠে দাঁড়াতে পারবে না?’

‘সবই পারবে। আমি চলে যাওয়ার পর।’

‘তুমি কি চলে যাবে?’

‘হ্যাঁ যেতে তো আমাকে হবেই। রাত ভোর হওয়ার আগেই আমি চলে যাবো। শুকতারা ওঠার আগেই।’

‘কেন চলে যাবে পিসিমণি?’

‘না গিয়ে যে উপায় নেই বাবা।’

উঠোনের দক্ষিণে জোড়া নিমগাছ। পাশাপাশি যমজ শিশুর মতো বহুদিন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নিমের হাওয়া স্বাস্থ্যকর। এজন্য নিমতলায় কাঠের একটা পুরনো বেঞ্চ পাতা আছে। তার দু’পাশে বেশ কিছু ফুলের ঝাড়। হাসনুহেনা, গন্ধরাজ, বেলি, কামিনী, জবা আছে দু’রকমের। বড় একটা শিউলি ঝাড়ও আছে। গ্রীষ্মকালে সুগন্ধি ফুল ফোটে অনেক। ফোটে রাতেরবেলা। আজও ফুটেছে। নিশিরাতের হাওয়ায় ফুলের গন্ধ ভাসছে। চাঁদের আলোয় ফকফক করছে চারদিক। তুলসী মঞ্চে তুলসীর ঝাড় বেশ বড় হয়েছে। শিউলি একবার সেদিকটায় তাকালো।

‘তোর মনে আছে অর্জুন, এরকম জ্যোৎস্না রাতে তোকে নিয়ে আমি নিমতলার বেঞ্চটায় এসে বসতাম। তুই আমার কোলে মাথা দিয়ে পাতালপুরির গল্প শুনতে চাইতি। সারা দিনের অত খাটাখাটনির পরও আমি তোকে একটার পর একটা গল্প বলে যেতাম। সেই সব গল্প বলতে আমার খুব ভালো লাগতো।’

‘সব মনে আছে পিসিমণি। আমি তোমার একটা কথাও ভুলিনি। রোজ তোমার কথা ভাবি। নদীর দিকে তাকিয়ে, ওদিকটায় গেলে রোজ তোমার জন্য আমার কান্না পায়।’

‘আমি জানি বাবা। আমি সব জানি। আয় আমি বেঞ্চটায় বসি আর তুই আমার কোলে মাথা দিয়ে শো। আজ আমি তোকে খুব সুন্দর একটা পাতালপুরির গল্প বলবো।’

অর্জুন তাই করলো। শিউলি বেঞ্চে বসার পরই তার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল।  সাদা মাটির উঠোন চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে।

[পরবর্তী পর্বে সমাপ্য]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর