পূর্ব প্রকাশের পর
আপনাকে নিয়ে। আপনি তাকে ভালোবাসেন কি বাসেন না তাও বোকা মেয়েটি জানতে চায়নি, বুঝতে চায়নি। সে বুঝেছিল নিজেকে। সে ভালোবাসে আপনাকে। এটাই তার কাছে সব। তার ভালোবাসাই তার কাছে মূল্যবান। মেয়েরা কাউকে ভালোবাসলে প্রথমেই বিয়ের কথা ভাবে। আপনার ডিভোর্স হয়ে গেছে। চাইলেই ঝুমকোকে বিয়ে করতে পারেন। ঝুমকো দেখতে খুবই আকর্ষণীয়া। যে কেউ তাকে দেখে মুগ্ধ হবে। কিন্তু সে এসব ভাবলোই না। নিজের গভীরতর ভালোবাসায় ডুবে আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিল সে। এক রাতে আপনি তাকে নিবিড়ভাবে চাইলেন। সে তো রোজই চাচ্ছিলেন। সেও সাড়া দিত আপনার ডাকে। পাগল হতো আপনার জন্য। সেই রাতে তার শরীর মন কোনোটাই সাড়া দিচ্ছিল না। ক্লান্ত লাগছিল। ফলে সে মানা করেছিল। তার পরও আপনি জোরাজুরি শুরু করলেন। সে করুণ আবেদন করছিল, বাধা দিচ্ছিল। একপর্যায়ে আপনি খুবই বিরক্ত হলেন। প্রথমে বাজে বাজে কথা বললেন ঝুমকোকে তার পর অতি নির্দয় ভঙ্গিতে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দিলেন। ‘‘যাও, তুমি গিয়ে দারোয়ানের সঙ্গে থাকো। তুমি ওই ক্লাসেরই মেয়ে। আমার সঙ্গে থাকার উপযুক্ত নও।’’
‘‘খালা কিছুই টের পেল না। এমনিতেই সে ঝুমকোর ওপর বিরক্ত। আপনাকে সে চেনে। প্রেম করা স্ত্রীর সঙ্গে জীবন কাটাতে পারেননি বাজে ব্যবহারের জন্য। এমনিতে আপনি শান্তশিষ্ট ভালো মানুষ টাইপ, কিন্তু আপনার ভিতর এক অসভ্য, বদমেজাজি আর মহা স্বার্থপর মানুষও বাস করে। কখনো কখনো সেই মানুষটা বেরিয়ে আসে। তখন এই আপনাকে আর চেনা যায় না।’’
‘‘সেই রাতে আপনার ভিতরকার মানুষটিকে দেখে ফেলল ঝুমকো। এত অপমানবোধ করল মেয়েটি! এত অভিমান হলো তার! সারাটা রাত বসে বসে কাঁদল। আপনি একবারও বেরিয়ে এলেন না তাকে ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বা অনুতপ্ত হওয়ার জন্য। ভোরবেলা নিজের ব্যাগটা নিয়ে, বোরখা পরে যেভাবে ঝুমকো আপনার ফ্ল্যাটে এসেছিল ঠিক সেইভাবে সে বেরিয়ে গেল।’’
আসিফ উদাস গলায় বলল, ‘‘তারপর আট বছর কেটে গেছে। ঝুমকোর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। সে যেন সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেল পৃথিবী থেকে। সেই খালাকে আমি গ্রামে পাঠিয়েছিলাম, যত চেনা পরিচিত জায়গা আছে সর্বত্র পাঠিয়েছিলাম। ঝুমকোর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।’’
‘‘পাওয়ার কথাও না। ওই শর্তেই মিজানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল সে। আপনার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে একটা মোবাইল ফোনের দোকান থেকে মিজানকে ফোন করেছিল। সেদিনই পাগলের মতো ঢাকায় ছুটে এলো মিজান। ঝুমকো সারাটা দিন এদিক ওদিক কাটিয়ে বিকালের দিকে সেই ফোনের দোকান থেকে আবার মিজানকে ফোন করল। কোথায় আছে তা জানালো। সন্ধ্যাবেলায় ওদের দেখা হল। মিজান অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। প্রচুর টাকার মালিক ওর বাবা। ঝুমকো মিজানকে অনেকগুলো শর্ত দিল। সে মিজানকে বিয়ে করবে ঠিকই কিন্তু পরিচিত কারও সঙ্গে কখনো দেখা করবে না। সে থাকবে সবার চোখের আড়ালে, দূর কোনো মফস্বল শহরে। সে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করবে। বাংলা সাহিত্য পড়বে। নিজেকে বোরখায় ঢেকে চলাফেরা করবে। মিজান তাকে সেই জীবনটাই দিয়েছে। একটা ছেলে আছে তাদের। এই শহরে বিশাল বাড়ি। মিজান এখানকার বড় ব্যবসায়ী। খুবই সুখের জীবন ঝুমকোর।’’
আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘‘আমি বুঝেছি তুমিই ঝুমকো। আমার ঝুমকোলতা।’’
‘‘এত কিছু বলার পর যে কোনো শিশুরও তা বোঝার কথা। শ্রাবণি এবং কলি নাম দুটো আমি বানিয়ে বলেছি। আমি ঝুমকো। তবে ‘আমার ঝুমকোলতা’ কথাটা আর বলবেন না। আপনি আমার কেউ নন। আপনার কোনো অধিকার নেই আমাকে ওই নামে ডাকার।’’
ঝুমকো ঝট করে মুখ থেকে বোরখার আবরণ সরাল। ‘‘বলেছিলাম আমার মুখ আপনাকে দেখাব না। এখন দেখাচ্ছি। কারণ আমার মুখ দেখলে আপনি বুঝবেন, কতটা ভালো থাকলে মেয়েদের মুখে সকালবেলার আলোর মতো লাবণ্য ঝলমল করে। আপনার কাছ থেকে সরে এসে আমি নর্দমায় পড়ে যাইনি। বোরখা পরে গ্রাম থেকে পালিয়েছিলাম। আপনার ফ্ল্যাট থেকেও বোরখা পরেই বেরিয়েছিলাম। নিজের বাড়ি ছাড়া বোরখা এখন আর কোথাও খুলি না। আজ আপনার সামনে খুললাম। দ্বিতীয় আরেকটা কারণ আছে বোরখা খোলার। আমার মুখ দেখে আপনার যেন গভীর অনুশোচনা আর তীব্র অপরাধবোধ হয়। আপনি যেন সারা জীবন এই অপরাধবোধে ভোগেন। অন্তর জ্বালায় জ্বলেন।’’
আসিফের মুখ ততক্ষণে একেবারেই ম্লান হয়ে গেছে। ঝুমকোর দিকে সে তাকাতেই পারছে না। অসহায় ভঙ্গিতে আরেকটা সিগ্রেট ধরাল।
ঝুমকো বলল, ‘‘মানুষ দু’রকম। বাইরে এক ভিতরে আরেক। মিজান পাগল হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। তার আচরণ আর গুন্ডামি দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পরে দেখি তার ওরকম হওয়ার কারণ ছিলাম আমি। আমাকে পাওয়ার জন্য সে অমন করেছে। আপনার ওখান থেকে বেরিয়ে আমি নিজ থেকে যখন তাকে ডাকলাম, সে যখন আমার সামনে এলো, এসে শিশুর মতো কাঁদতে লাগল। আমি যা যা বললাম সব মেনে নিল। দিনে দিনে দেখি সে একজন সত্যিকার মানুষ। খাঁটি মানুষ। খাঁটি প্রেমিক, খাঁটি স্বামী। প্রেমিকা কিংবা স্ত্রীর প্রতি আছে আশ্চর্য রকম শ্রদ্ধাবোধ, গভীর মমত্ববোধ, গভীর ভালোবাসা আর দায়িত্বশীলতা। সংসারের বাইরে, স্ত্রী সন্তানের বাইরে কিচ্ছু ভাবে না সে। খুবই সৎভাবে বিজনেস করে। যে মামা মামি আমাকে তাঁদের সন্তানের মতো প্রতিপালন করেছেন তাঁদের অবস্থা মিজান বদলে দিয়েছে। বাড়িতে পাকাঘর করে দিয়েছে। মামার মেয়ে দুটোর ভালো বিয়ে দিয়েছে। ছেলেটিকে বাজারে দোকান করে দিয়েছে। আপনার ফ্ল্যাটে থাকা সেই খালা যখন গ্রামে চলে গেল তাকেও সামান্য জমি কিনে ঘর করে দিয়েছে মিজান। অর্থাৎ আমার অসহায়ত্বের সময় যারা আমার পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের প্রত্যেকের পাশে মিজান দাঁড়িয়েছে। আমার চেহারা দেখে নিশ্চয় আপনি বুঝেছেন কতটা ভালো আমি আছি।’’
আসিফ সিগ্রেটে টান দিয়ে শুকনো গলায় বলল, ‘‘তুমি আগের চেয়েও সুন্দর হয়ে গেছ। একবার তাকালে তোমার দিক থেকে চোখ ফিরানো যায় না।’’
‘‘এ রকম সৌন্দর্য মাত্র কয়েকদিনের জন্য আগেও একবার শরীরে এসেছিল আমার। যে মুহূর্ত থেকে আমি আপনাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম, আপনাকে সর্বস্ব দিয়েছিলাম, আপনার ওপর নির্ভর করেছিলাম, নিজেকে আপনার ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, সেই সময়। মানুষ যখন সবদিক থেকে নির্ভার হয়, তখন তার চেহারায় আলাদা লাবণ্য আসে। নারীপুরুষ দু’জনারই। আমি ওই সময় নির্ভার হয়েছিলাম। তবে যার হাত ধরে নির্ভার হলাম, সেই মানুষটি, আমার প্রেমিকটি আসলে মানুষ ছিল না। মানুষের মতো দেখতে একটি জন্তু। অমানুষ। অসভ্য। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিচ্ছু বুঝত না। প্রেমিকাকে চূড়ান্ত অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিল নিজের স্বার্থ উদ্ধার হয়নি বলে। তাকে পাঠাতে চেয়েছিল দারোয়ানের ঘরে। ছি!’’
আসিফ মাথা নিচু করে বসে আছে। হাতে সিগ্রেট পুড়ছে। লম্বা হয়ে ঝুলছে ছাই।
ঝুমকো বলল, ‘‘কথা বলছেন না কেন? কথা বলুন।’’
মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে তাকালো আসিফ। ‘‘কী বলব, বলো!’’
‘‘আপনার তো বলার কথার অভাব নেই। টিভিতে দেখি মেয়েদের নিয়ে কত বড় বড় কথা বলেন। ‘নারী শুধু নারী নয়, তার প্রধান পরিচয় হবে ‘মানুষ’। আগে মানুষ হতে হবে। তাকে সচেতন হতে হবে নিজের সম্পর্কে। নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। শিক্ষিত হতে হবে।’ আজ আমি যদি আপনাকে প্রশ্ন করি, আপনি নিজে কি মানুষ হয়েছেন? হ্যাঁ বুঝলাম সেই রাতে শরীরের নেশায় আপনি পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে যতটা সম্ভব অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিলেন। আপনি তো মাতাল ছিলেন না। মদও খাননি সেই রাতে। তার পর পুরোটা রাত কেটে গেল। আপনি বুঝেছিলেন আমি ফ্ল্যাটেই আছি এবং কাঁদছি। আপনি বেরিয়ে এলেন না কেন? ভুল স্বীকার করে, আমাকে ফিরিয়ে নিলেন না কেন? সারা রাত দরজা বন্ধ করে ঘুমালেন। দরজা বন্ধ করলেন এই কারণে যেন আমি আপনার কাছে যেতে না পারি। আপনি মানুষ? কোন মুখে এত বড় বড় কথা বলেন টিভিতে? লজ্জা করে না? নিজের দিকে আপনি তাকান না? নিজে মানুষ হতে পারেননি কেন এই নিয়ে আপনার মনে কোনো প্রশ্ন জাগে না? মিজান তেমন লেখাপড়া করেনি আর আপনি একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ। দু’জনের তুলনা করলে আপনাকে আমার চূড়ান্ত অমানুষ মনে হয় আর মিজানকে মনে হয় প্রকৃত মানুষ। নারীর সম্মান কী, মিজান সেটা জানে। আর আপনি নারীকে মানুষ ভাববার কথা বলছেন, তাদের অধিকার সম্মান ইত্যাদি আদায়ের কথা বলে বিদেশ থেকে টাকা এনে খাচ্ছেন। নারীদের নিয়ে দালালদের মতো এক ধরনের ধান্দা করছেন! ছি! ঘৃণায় আমার বমি আসে। সব কিছুর আগে নিজে মানুষ হন। তার পর অন্যকে জ্ঞান দিতে আসবেন।’’
ঝুমকো থামল। বোরখায় আগের মতো মুখ ঢাকল। তার পর উঠে দাঁড়াল। ‘‘আমার এত ঘৃণা আপনার ওপর, এত রাগ ক্রোধ, বলে শেষ করতে পারব না। আমার ভালোবাসাকে আপনি অপমান করেছেন। নারীত্বকে অপমান করেছেন। আমি একজন শিক্ষিত মানুষ, রুচিবোধ তীব্র। আমার রুচিতে বাধছে, নয়তো আপনার মুখে আমি থুতু ছিটিয়ে দিতাম।’’
ঝুমকো আর দাঁড়াল না। রাজরানীর ভঙ্গিতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।
-সমাপ্ত