না, তেমন কোনো পরিশ্রম করতে হয়নি পুলিশকে। মাত্র আধহাত মাটি খুঁড়েই পেয়ে গেছে লাশটা। আর মানুষটাকে চিনেও ফেলেছে মুখের দিকে একঝলক তাকিয়েই। আসলে রোজ কয়েকবার যার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তাকে চেনার জন্য দ্বিতীয়বার তাকানোর দরকার পড়ে না। ওসি শরাফত মজুমদার লাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনকে জিজ্ঞেস করেন, নিহত তোতা পাগলার পরিবার-পরিজন কিংবা আত্মীয়স্বজনকে কোথায় পাওয়া যাবে। উত্তরে মুদি দোকানদার শরিফ মিয়া বলে- তার দূর-সম্পর্কের এক চাচারে আমি চিনি স্যার। বউ-বাচ্চা নিয়া সে নামাপাড়া থাকে।
তোতা পাগলার চাচাকে খুঁজে বের করা হয়। আনুষ্ঠানিকতা শেষে লাশ বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাকে। আর শরাফত মজুমদার নেমে পড়েন তদন্তে। ইতোমধ্যে প্রমাণিত, তোতা পাগলার মৃত্যু হয়েছে বিষ মাখানো খাবার খেয়ে। এখন তদন্ত করে বের করার পালা, খাবারটা কে খাইয়েছে। অবশ্য এই প্রশ্ন সামনে আসত না, যদি তোতা পাগলার লাশটা মাটিচাপা দেওয়া অবস্থায় না পাওয়া যেত। সবাই ধরে নিত, বিষ মাখানো খাবার সে নিজের ইচ্ছেতেই খেতে পারে। পাগল মানুষ। কোনটা বিষ, কোনটা মধু, সেটা বোঝার মতো জ্ঞান তার আছে নাকি!
শরাফত মজুমদারের কাছে এটা পরিষ্কার- যে বা যারা তোতা পাগলার লাশ মাটিচাপা দিয়েছে, সে বা তারাই তাকে বিষ মাখানো খাবার খাইয়েছে। কিন্তু একটা পাগলকে মেরে কার কী লাভ? শরাফত মজুমদার স্কুল এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেন। যেহেতু লাশটা পাওয়া গিয়েছিল স্কুলের পঞ্চাশ গজের মধ্যে। কিন্তু শতাধিক মানুষের সঙ্গে কথা বলেও যখন কাক্সিক্ষত তথ্য পান না, তখন তিনি তদন্তের ধরন পাল্টান। তোতা পাগলার খুনের বিষয়ে জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলা বাদ দিয়ে কথা বলতে শুরু করেন জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে। তবে কোনো ফল পান না। তাই বলে হতাশ হয়ে থেমেও যান না। তিনি নতুন উদ্যমে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকেন কাউন্সিলর রইস মৃধাকে। তারপর তাকে নিয়ে বসেন নিজের রুদ্ধদ্বার কক্ষে।
প্রশ্নের মুখে রইস মৃধা আয়েশি ভঙ্গিতে বলেন, তিনি স্বচ্ছ রাজনীতি করেন। খুন-খারাবির কথা চিন্তাও করেন না। শরাফত মজুমদার হাসেন। রইস মৃধাকে জিজ্ঞেস করেন চা খাবেন কি না। তিনি জবাব না দিয়ে বলেন- একটা কথা বলব বলব করেও বলিনি। সংকোচ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, কথাটা বললেই আপনি বলবেন, আমি প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে চাচ্ছি। আসলে এখানে রাজনীতির একটা মারপ্যাঁচ আছে। আমি কাউন্সিলর হয়েছি, অন্যেরা হতে পারেনি। এটা অবশ্যই তাদের জন্য হিংসার একটা ব্যাপার। আর মানুষ হিংসার বশবর্তী হয়ে যেকোনো অপকর্ম করতে পারে।
: তার মানে আপনি বোঝাতে চাচ্ছেন, আপনার প্রতিপক্ষ আপনাকে ফাঁসানোর জন্য খুনটা করিয়েছে?
: হতেই পারে। আমার নির্বাচনি এলাকায় শান্তি বিরাজ করুক, এটা তারা কেন চাইবে? একটা হাঙ্গামা লেগে থাকলে ভালো না? তাদের জন্য ক্ষমতায় আসা সহজ হবে।
রইস মৃধার কথাগুলো যৌক্তিক মনে হয় শরাফত মজুমদারের। তাই তিনি জানতে চান, সন্দেহভাজন কে। আবদুল লতিফ কিনা। যেহেতু এই মানুষটাই তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী এবং শক্ত প্রতিপক্ষ। রইস মৃধা বলেন- আপনার তো কিছু জানার বাকি নেই। সবই জানেন। লতিফ লোকটা যদি পারত, তাহলে আরও বহু আগে আমাকে মেরে ফেলত। অতএব এমন জঘন্য একটা লোক তার লোকজনকে দিয়ে আমার এলাকায় মানুষ খুন করিয়ে নানান ফায়দা লোটার চেষ্টা করবে, এটা খুব সহজ হিসাব।
পর দিন আবদুল লতিফকে থানায় ডাকেন শরাফত মজুমদার। সরাসরি জানতে চান, একটা পাগলকে মারতে হলো কেন! এলাকায় বিশৃঙ্খলা তৈরির আর কোনো রাস্তা কি ছিল না? আবদুল লতিফ বলেন- একটা মানুষকে শুধু শুধু সন্দেহ করে আপনাদের কী লাভ আপনারাই ভালো জানেন। আরে, আমি প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীকে না মেরে কেন একটা পাগলকে মারব? এলাকায় হাঙ্গামা বাধানোর জন্য? হাঙ্গামা তো বাঁধত গুরুত্বপূর্ণ কোনো নেতাকে মারতে পারলে। একটা পাগল বাঁচল না মরল; পাবলিকের কি এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর টাইম আছে?
: আপনি তাহলে তোতা পাগলাকে মারেননি?
: অবশ্যই না।
শরাফত মজুমদার আর কথা বাড়ান না। তিনি আবদুল লতিফকে বিদায় দেন। তারপর চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করেন। ক্লান্ত শরীর। তাই ঘুমঘুম ভাব চলে আসে। এমন সময় আবার রুমে ঢোকেন আবদুল লতিফ। গলা খাঁকারি দেন। এতে শরাফত মজুমদার চোখ খুললে তিনি বলেন- আপনি আমার পেছনে ম্যালা সময় ব্যয় করেছেন। আপনার মতো ইম্পর্ট্যান্ট একজন মানুষ আমার মতো আমজনতাকে এত সময় দেবে, বিষয়টা আনন্দের। আমি আনন্দিত, গর্বিত। এ জন্য আমার পক্ষ থেকে আপনার জন্য থাকছে ছোট্ট একটা গিফট।
শরাফত মজুমদার চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়ে ওঠেন। জানান, পুরো চাকরি জীবনে তিনি কারও কাছ থেকে উপহার নেননি, একটা পয়সা ঘুষ খাননি। আবদুল লতিফ বলেন- আপনি আমার কথা না বুঝেই সেন্টিমেন্টাল হয়ে গেলেন। আমি আপনাকে গিফট দিতে চেয়েছি মানে কিন্তু ঘুষ দিতে চাইনি। বরং স্পেশাল একটা ইনফরমেশন দিতে চাচ্ছি। যেটা আপনার তদন্তে কাজে লাগবে। তার আগে বলে নিই, আমার বাসায় যে মেয়েটা ছুটা বুয়ার কাজ করে, সে মোটামুটি এই এলাকা চষে বেড়ায়। অনেকের বাড়িতেই কাজ করে তো!
: স্পেশাল ইনফরমেশনটা দিন, প্লিজ।
: যেখানে তোতা পাগলার লাশ পাওয়া গেছে, মেয়েটা এইদিক দিয়ে রেগুলার আসা-যাওয়া করে। ও, এটা একটু বলে নিই, তার নাম মরিয়ম।
: কথা টেনে লম্বা না করে স্পেশাল ইনফরমেশনটা দিয়ে ফেললে ভালো হয়। আপনারও সময় বাঁচে, আমারও সময় বাঁচে।
: তোতা মিয়ার লাশের আশপাশ থেকে আপনারা একটা বাটি পেয়েছিলেন না? যেটা আলামত হিসেবে পুলিশের হেফাজতে আছে? মরিয়ম বলেছে, বাটিটা নাকি তার পরিচিত।
এবার খুশিতে মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে শরাফত মজুমদারের। তিনি নিজেও বসেন, আবদুল লতিফকেও বসতে বলেন। আর জানতে চান বাটিটা মরিয়মের কেমন পরিচিত, কীভাবে পরিচিত। আবদুল লতিফ না বসেই বলেন- বললাম তো, সে অনেকের বাড়িতে কাজ করে। কোন বাড়িতে নাকি দেখেছে। তার সঙ্গে কথা বললে জানতে পারবেন। আমি নিশ্চিত, বাটির মালিকের খোঁজ পেলে খুনির খোঁজ পেতে সময় লাগবে না। নেন, মরিয়মের নাম্বারটা লিখেন।
আবদুল লতিফ মরিয়মের ফোন নম্বর বলেন। আর শরাফত মজুমদার নিজের মোবাইলে ওঠান। তাকে ধন্যবাদ জানান। কফি খাওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু আবদুল লতিফ আগ্রহ না দেখিয়ে বেরিয়ে যান রুম থেকে। এর ঘণ্টা দুয়েক পরেই শরাফত মজুমদার থানায় ডেকে আনেন মরিয়মকে। আর তার সামনে রাখেন বাটিটা। জানতে চান জিনিসটা সে কীভাবে চেনে। মরিয়ম বলে- স্যার, ঢালের কাছে বারোতালা একটা বিল্ডিং আছে না? তালুকদার মঞ্জিল। আমি এই বিল্ডিংয়ে কিছু দিন সিঁড়ি মোছার কাজ করছি। ওই সময় এই বাটিটা আমি দারোয়ানের হাতে দেখছি।
: এই বাটিটাই যে দেখেছ, এতটা শিওর কীভাবে হচ্ছ? বাটির মতো বাটি থাকতে পারে না?
: তা পারে স্যার। তবে এইটা ওই বাটিই। এ বিষয়ে কোনো সন্দে নাই। কারণ, সাইডে অল্প একটু ভাঙা আছে। এই যে, দেখেন।
মরিয়ম ভাঙাটা দেখায়। আর শরাফত মজুমদার তাকে বিদায় দিয়ে ডেকে আনেন দারোয়ানকে। জানতে চান তার বাটি তোতা পাগলার লাশের পাশে কেন গিয়েছিল, কীভাবে গিয়েছিল। দারোয়ান যেন আকাশ থেকে পড়ে। বলে- আমি বাটি পামু কই স্যার? আর বাটি দিয়া আমি করমুই বা কী? পেলেট, বাটি, গেলাস এইগুলা তো আমার লাগে না। কারণ, ওই বিল্ডিংয়ে আমি খুব অল্প সময় ডিউটি করি। মাত্র তিন ঘণ্টা। এই তিন ঘণ্টার মইধ্যে বিড়ি ছাড়া আর কিছু খাওয়া পড়ে না।
শরাফত মজুমদার বোঝান, তিনি দারোয়ানের কথা বিশ^াস করেছেন। আসলে একফোঁটাও বিশ^াস করেননি। কারণ, কথাবার্তা শুনে তাকে তার ধূর্ত মনে হয়েছে। তিনি তালুকদার মঞ্জিলে যান। সভাপতি-সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলেন। আর দারোয়ানের মাথার উপরের সিসি টিভি ক্যামেরাটার ফুটেজ চান। পেয়েও যান খুব তাড়াতাড়ি। এরপর পেয়ে যান কাক্সিক্ষত সেই ফুটেজ। যেখানে দারোয়ানকে পায়েশ জাতীয় কিছু একটা খেতে দেখা যায়। আর বাটির ডিজাইনটা হুবহু লাশের পাশে পাওয়া বাটির মতোই।
আবার দারোয়ানের মুখোমুখি হন শরাফত মজুমদার। তবে এবার তিনি আগের মেজাজে থাকেন না। তার চোখ দিয়ে আগুন ঝরে। আর হাত তৈরি থাকে গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দেওয়ার জন্য। দারোয়ান বুঝতে পারে, চালাকি করলে বিপদ হবে। তাই সে বলে- আমার যে বাটি নাই, এইটা কিন্তু সত্য স্যার। তবে কোনো ফ্ল্যাটে মেহমান-টেহমান আসলে, ভালো-মন্দ পাক হইলে আমিও পাই। আমার লাইগা বাটিতে বা পেলেটে কইরা পাঠায় তো! বুঝতেই পারতেছেন স্যার, যেই বাটিটা দেখছেন, এইটা একটা ফ্ল্যাট মালিকের বাটি। আমার না।
: কোন্ ফ্ল্যাট মালিকের?
: তা তো মনে নাই স্যার।
: মনে করানোর ব্যবস্থা করব?
শরাফত মজুমদারের হুমকিমূলক প্রশ্নে ভয় পেয়ে যায় দারোয়ান। সে সশব্দে ঢোক গেলে। আর বলে দেয় ফ্ল্যাট নম্বর। বলে দেয় মালিকের নামও। শরাফত মজুমদার অভিযান চালান তৃতীয় তলার সেই ফ্ল্যাটে। আর সত্যতা পান দারোয়ানের কথার। তিনি ফ্ল্যাট মালিক আশরাফুল আলম এবং তার স্ত্রী নাজমা উভয়কেই নিয়ে আসতে চান থানায়। কিন্তু আপত্তি করে প্রতিবেশীরা। জানায় নাজমা সন্তানসম্ভবা। তাকে টানা-হেঁচড়ায় ফেললে বড় কোনো বিপদ হয়ে যেতে পারে। শরাফত মজুমদার তাই শুধু আশরাফুল আলমকে নিয়েই থানায় ফেরেন।
দুই কাপ চা আসে। শরাফত মজুমদার একটা কাপ হাতে নিয়ে অন্যটা নিতে বলেন আশরাফুল আলমকে। কিন্তু তিনি নেন না। এমনকি তাকানও না। বসে থাকেন চোয়াল শক্ত করে। শরাফত মজুমদার তৃপ্তি সহকারে দুই চুমুক চা খেয়ে কাপটা আগের জায়গায় রেখে বলেন- বাড়তি কোনো কথার দরকার নেই। আমি শুধু জানতে চাই আপনার বাসার বাটিটা কীভাবে তোতা পাগলার লাশের কাছে গেল। আপনাকে দেখে ভদ্রলোক মনে হয়। অতএব মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেন না। তাহলে কিন্তু ভদ্রলোক হিসেবে যে ইজ্জতটা দিচ্ছি, সেটা আর দেব না।
আশরাফুল আলম এবার মুখ তুলে তাকান। তার শক্ত চোয়াল স্বাভাবিক দেখায়। তবে তিনি কিছু বলেন না। শরাফত মজুমদার তাকে নীরব থাকতে বারণ করেন। আর জানতে চান একটা পাগলের সঙ্গে তার কিসের শত্রুতা ছিল। কেন তাকে বিষ মাখানো খাবার খাওয়াল, কেন মাটিতে পুঁতল। হঠাৎ কথা বলতে শুরু করেন আশরাফুল আলম- তারা এই কাজটা ঠিক করেনি। আমি একবারও মাটিতে পুঁততে বলিনি। বলেছিলাম লাশটা যেন দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসে। কিন্তু তারা নিজেদের পরিশ্রম কমানোর জন্য এই কাজটা করেছে। করেছে তো করেছে, গর্তটা আরেকটু গভীর করতে পারত না?
এবার নীরব হয়ে যান শরাফত মজুমদার। কারণ, আশরাফুল আলমের কথাগুলো তার অবিশ^াস্য মনে হয়। তবে মিথ্যা মনে হয় না। তাই বাকিটুকুও শোনার তীব্র ইচ্ছে জাগে। আর আশরাফুল আলম তার ইচ্ছে পূরণ করেন- আমি আগে যেখানে থাকতাম, ওই এলাকা থেকে এই এলাকায় চলে আসি তোতার যন্ত্রণায়। কিন্তু কীভাবে যেন সে টের পেয়ে যায়। আমি আসার একদিন পরেই দেখি সেও এই এলাকায় হাজির। আপনি হয়তো জানেন, তোতা শরীরে কোনো কাপড় রাখত না। উলঙ্গ হয়ে হাঁটত। আর আমাকে দেখলেই ছুটে আসত। আমি লজ্জায় মরে যেতাম।
: এবার মনে হয় আপনি মিথ্যা বললেন। আমার জানা মতে, তোতা পাগলা মানুষের কাছে তেমন ভিড়ত না। কারও দিকে ছুটে যাওয়া তো দূরের কথা, সে তার মতো এখানে-ওখানে বসে থাকত, শুয়ে থাকত।
: আমি মিথ্যা বলছি না। আমাকে দেখলে আসলেই সে ছুটে আসত। জড়িয়ে ধরারও চেষ্টা করত।
: কিন্তু কারণটা কী?
আশরাফুল আলম জানালা দিয়ে বাইরে তাকান। একটা দীর্ঘশ^াসও ছাড়েন বোধ হয়। তারপর অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলেন- কারণ আর কী! রক্তের টান। তোতা আমার ছোটভাই না?