গল্প
ঘুমটা সাত সকালেই ভেঙে গেল। ভেবেছিলাম ছুটির দিন, আরও কিছুক্ষণ ঘুমাব। উঠে পড়লাম, অযথা শুয়ে থেকে লাভ কী? বাইরে আসতেই রোদেলা সকাল, ঘাসের ডগায় হালকা শিশির বিন্দু সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে। এখনো তেমন শীত পড়েনি। বাড়ির কোণায় শিউলি গাছের নিচে ফুল পড়ে সাদা হয়ে আছে। কিছু ফুল গাছের পাতায় আটকে আছে। দারুণ লাগছে। হঠাৎ সেলফোন বাজলে ঘরে আসলাম। এত সকালে কে আবার ফোন করল? বুকটা ধুক করে উঠল।
- হ্যালো হ্যালো, কে বলছেন?
- কীরে, গলার স্বর ভুলে গেলি? অবশ্য অনেক দিন পর ফোনে কথা হচ্ছে। নাহার আপা বলছি।
- ও নাহার আপা, মোটেই ভুলে যাইনি, কেমন আছ? ভালোবাসা প্রকাশ করতে নেই।
- কে বললো প্রকাশ করতে নেই। কী করে বুঝব তুই এখনো মনে করিস।
- মনে পড়ে, তবে ব্যস্ততার কারণে ফোন করা হয়ে ওঠে না।
- অন্তরা, আগামী মাসের সাত তারিখে আমার বিয়ে। এখনো বারো দিন বাকি আছে।
- তোমার বিয়ে? কী যে খুশি লাগছে, অবশ্যই যাব। তোমার বর কী করেন?
- আসলেই জানতে পারবি।
-জলিকে বলেছ?
- হ্যাঁ বলেছি, তোরাই তো সব চাইতে কাছের।
- আমার আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে।
- এখানে এসে নাচিস। সাদামাটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান।
- আচ্ছা রাখি, পড়ে কথা হবে। অনেক কাজ পড়ে আছে।
বহু বছর আগের কথা। স্কুলের পাশে নাহার আপাদের বাসা। আমার বান্ধবী জলির দূর সম্পর্কের বোন। প্রায় সময় স্কুল ছুটির পর নাহার আপাদের বাসায় যেতাম। তিনটা টিনের ঘর, একটু দূরে রান্নাঘর। পাশেই টিউবওয়েল। সামনে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা।
আশপাশের বিল্ডিংয়ের মাঝে একটু বেমানানই লাগত। তবে ভিতরে গেলে মনটা ভরে যেত, খুব সুন্দর ফুলের বাগান ও ফলের গাছ আছে বেশ কয়টা। পরিষ্কার ঝকঝকে।
আমাদের দেখলেই হেসে বলবে আয় আয়, খুব ক্ষিধে পেয়েছে জানি, বোস ভাত নিয়ে আসি।
- ভাত খাব না নাহার আপা।
- তাহলে অন্য কিছু আনি।
নাহার আপাদের বাসায় আমি প্রথম যবের ছাতু, দুধ, গুড় খেয়েছিলাম। আজও সে স্বাদ মুখে লেগে আছে।
মুড়ির মোয়া, নারিকেলের নাড়ু অসাধারণ লাগত খেতে।
নাহার আপার বয়স প্রায় চল্লিশের কাছে। তার ছোট বোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ভাই বিয়ে করেছে। যখনি প্রশ্ন করেছি তুমি বিয়ে করবে না?
-আমার মতো মেয়েকে কে বিয়ে করবে? বেঁটে কালো মোটা। টাকা-পয়সা নাই।
- দেখো, একদিন তোমার সব হবে।
নাহার আপা মাকে নিয়ে থাকেন। ভাই বউকে নিয়ে বিদেশে। বোনটা অন্য জায়গায়। তবে বেশি দূরে না, সময় পেলেই আসে। নাহার আপার বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ায় তাকেই সব দায়িত্ব নিতে হয়। খুব ভালো সেলাই করতে পারত। কাপড় সেলাই করে কোনোমতে সংসার চালাত। নিজেদের বাড়ি বলে কোনো মতে চলে যাচ্ছিল। এখন নাহার আপা বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্ডার পায়। নিজে একটা কারখানা করেছে। বিশজন মেয়ে কাজ করে। ঈদ, পয়লা বৈশাখ, কথা বলার ফুরসত থাকে না। এত কাজের ব্যস্ততা। বাড়িতে পাকা ঘরের সংখ্যা বাড়িয়েছে। ছাদটা রঙিন টিন দিয়ে এমনভাবে করেছে, বাংলোর মতো লাগে।
বাড়ির ছবি তুলে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বর্ষার সময় একবার আসিস। বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দে তোর ভালো লাগবে। যে কদম গাছটা লাগিয়েছিলাম, এখন প্রচুর ফুল ফোটে। গাছভরা কদম ফুল বৃষ্টির শব্দ অন্য এক মাদকতা। মুগ্ধতার স্পর্শে সারা মন জুড়িয়ে যায়। এত কষ্টের মধ্যে সব কিছু ভুলে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
শুধু মা সব সময় কাঁদে। আমাকে নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। আচ্ছা বল, এক জীবনে মানুষ সব কিছু পায়। কখনো কখনো অসম্পূর্ণ জীবনেও অপরিমেয় সৌন্দর্য থাকে। নাহার আপা তোমার সেদিনের কথাগুলো মনে পড়ছে।
যতবার বিয়ের প্রস্তাব আসে ছোট বোনকে পছন্দ করে। নাহার আপাকে দেখলে বিয়ে ভেঙে যায়। অবশেষে নাহার আপা জোর করে ছোট বোনকে বিয়ে দেয়।
নাহার আপাকে দেখে কখনো খারাপ লাগেনি। মেঘের মতো ধূসর জীবনেও একটা গোলাপ ফুল। প্রাণখোলা হাসি, সুন্দরভাবে কথা বলা। অপূর্ব গানের গলা। এসব মানুষকে কেন মুগ্ধ করে না?
- মন খারাপ করিস না, বিয়ের চিন্তা বাদ। এ বয়সে আর কে বিয়ে করবে? এতগুলো মেয়ে কারখানায় কাজ করে। ওদের সংসার চলে, এই আমার বড় পাওয়া।
বুকের মধ্যে ধুকধুক শব্দ, এ বিয়ে যেন ভেঙে না যায়। বয়সের দোলনায় দোল খাওয়া মানুষটা এখনো যেন সদ্য যুবতী। মনের আর বয়স কী?
বাচ্চা দুটোকে মায়ের কাছে রেখে রওনা হলাম খুলনার দৌলতপুরে। প্রথমে উঠবো আমার বান্ধবী জলির বাসায়, তারপর বিয়েবাড়ি। কিছু সময় নিজের করে কাটাতে চাই। জলির সাথে অনেক দিন দেখা হয় না, তবে প্রায়ই কথা হয়।
আমাকে দেখে জলি খুব খুশি।
-যাই হোক, বিয়ের কারণ হলেও তো আসতে পারলি। কতদিন দেখা হয় না।
সেই স্কুল থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত এক সাথে থাকা। কীভাবে সময় চলে যায়। অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না, সবাই ব্যস্ত। দুজনে প্রায় পুরো রাতই গল্প করছিলাম। ও জানে আমি কফি খেতে ভালোবাসি, তাই মাঝে মাঝে কফির পর্ব চলছিল।
বিয়ের দিন সকাল সকাল নাহার আপার বাসায় গেলাম জলি আর আমি। নাহার আপার ছোট বোন নাজমাও ছিল।
নাহার আপা খুশিতে আমাদের জড়িয়ে ধরল। -জানতাম তোরা দুজন অবশ্যই আসবি।
হালকা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছিলেন। বেশ ভালোই লাগছিল।
কিন্তু বাড়িটা ঠিক বিয়েবাড়ি মনে হচ্ছে না। বাড়ির পেছনের দিকে রান্নার আয়োজন। সামনে শামিয়ানা টাঙিয়ে ডেকোরেটররা চেয়ার টেবিল ঠিক করছে।
নাহার আপাকে বললাম বাসার মধ্যেই সব আয়োজন।
- বেশি কেউ আসবে না। আমার কারখানার মেয়েগুলো আর বর পক্ষ থেকে বরের বাবা, মামা, ছোট ভাই আর দু-একজন বন্ধু, ব্যাস। এই বয়সে বেশি কিছু ভালো লাগে না।
-এ ধরনের কথা বলবে না। আচ্ছা তুমি কি প্রেম করে বিয়ে করছ?
- প্রেম কিনা জানি না। মাঝে মাঝে আমার কারখানায় আসত।
অনেক সময় বসে গল্প করত। একদিন আমার গান শুনে ফেলেছিল। হয়তো সেদিন থেকে তার ভালো লাগা। বয়সও আমার কাছাকাছি। সেও বিয়ে করেনি। ভাবলাম একটা কথা বলার সঙ্গী দরকার। অচেনা এক অনুভূতি মাথার মধ্যে বাসা বাঁধলো। পার্থিব জীবনে একাকী জার্নিটা বড় কষ্টের। ভিতরের অনেক কথা সবাইকে বলা যায় না। হয়তো সে আমার বন্ধুও হবে। তাই যখন আমাকে বিয়ে করতে চাইল, না করতে পারিনি।
অনেকেই আপত্তি করেছিল কিন্তু আমি শুনিনি।
জলি বলে উঠল, পরে কথা হবে কাজগুলো সেরে ফেলি। অন্তরা ওরা বিয়ের সুটকেস আগেই পাঠিয়েছে। নাহার আপা, আসো তোমাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দিই।
- তোমার এই লম্বা চুলগুলো তোমার বর দেখেছেন?
“সই ভাল করে বিনোদ বেণী বাঁধিয়া দে
বঁধু যেন বাঁধা থাকে বিনুনী ফাঁদে”
- অন্তরা, তোর দুষ্টুমি করার স্বভাবটা এখনো গেলো না।
-সেই জন্যই তো বাচ্চা দুটোকে রেখে এসেছি। ওরা অবশ্য আমার চেয়ে খালা-নানুকে বেশি পছন্দ করে।
- নাজমা চা বানায় নিয়ে আস, মাথা ধরেছে।
জলি বললো আমাদের সবার জন্য এনো।
- মিষ্টি আনি?
- এখন থাক, পরে খাব।
- জুম্মার নামাজের পর সবাই আসবে। যা তোরাও রেডি হয়ে নে।
- দাঁড়াও তোমার খোঁপায় ফুলের মালা জড়িয়ে দিই।
- এতো সাজের দরকার নেই।
- আজকের দিনে তুমি কিছু বলবে না।
বর আসলো, বিয়েও হয়ে গেল। বরকে দেখলাম তার ভাই হাত ধরে নিয়ে এসে নাহার আপার পাশে বসাল। খাবার টেবিলে হাত ধরে নিয়ে গেল। তবে কি নাহার আপা একজন অন্ধকে বিয়ে করেছে? বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। জলিরও মনটা খারাপ হয়ে গেল।
নাজমাকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না।
পরের দিন নাহার আপা বললো, আয় তোদের দুলাভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। ও কিন্তু চোখে দেখে না। তাতে কী, লেখাপড়া জানে। আমার অনেক কাজে সাহায্য করে। খুব বড় মনের মানুষ।
আমি স্তব্ধ বোবা হয়ে গেলাম। অনেক কষ্টে কান্না চেপে রাখলাম।
-কিরে অন্তরা, চুপ করে আছিস কেন? যাদের চোখ আছে তারা তো আমাকে পছন্দ করে না। ও মনের চোখ দিয়ে দেখেছে।
এই মানুষটার বুকে সমুদ্রের গর্জন আছে; তার ঢেউ আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি সেই সমুদ্র থেকে মুক্তো কুড়িয়ে এনেছি। আমার কোনো দুঃখ নেই।
ভাবলাম কিছু মানুষের জীবনে নাটকীয় মুহূর্ত আসে। পাল্টে যায় জীবনের হিসাব-নিকাশ। কিছু সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে রহস্য ঘেরা জ্যোৎস্নারাতে।
-প্রকৃতি তোমাকে বর্ণিলতায় সাজিয়েছে, নাহার আপা। তোমার মতো এতো আকাশছোঁয়া মনের মানুষ আমি দেখিনি।
আমার মগজের নিউরোনগুলো দৌড়ে বেড়াচ্ছে! কফির ধোঁয়ায় উড়ে যাওয়া স্বপ্ন এক চুমুকে ফিরে আসল মৌনতার অজানা বাস্তবে।