শিরোনাম
শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

চারুকলায় কালারস ফরটিন

চারুকলায় কালারস ফরটিন

ভালোবাসার প্রকাশ কতই না বিচিত্র! সাধারণ থেকে অসাধারণ; প্রত্যেকের জীবনেই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে কোনো না কোনো বিচিত্র গল্প রয়েছে। এই ভালোবাসা আর কিছু নয়, চারুকলাকে কেন্দ্র করে। রঙের প্রতি ভালোবাসার টানে দীর্ঘ সময় পরও আপন ভুবনে ফেরেন এই নারীরা। জানাচ্ছেন— আবদুল কাদের, ছবি তুলেছেন— মহসিন আব্বাস

 

ওদের কথা

কালারস; নামটিতেই রয়েছে রঙের মাধুর্য। কালারস নামকরণের ছোট্ট ইতিহাসও রয়েছে। ঢাবির চারুকলায় ১৯৮৯-৯০ ব্যাচের ৩০ জন শিক্ষার্থী সবসময় একসঙ্গে আড্ডা দিতেন। মজার বিষয় হচ্ছে, তারা কেউই একই অনুষদের শিক্ষার্থী ছিলেন না। ২০০১ সালে পাস করার পর সবাই ব্যক্তিজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু কিটি পার্টি তখনো থেমে থাকেনি। ২০১৫ সালের এমনই এক আড্ডায় প্রথম আলোর প্রকাশিত কিটি পার্টির গল্পকথা উঠে আসে। সেখান থেকেই তারা সিদ্ধান্ত নেন তাদের রপ্ত করা শিল্পচর্চাকে আবারও জাগিয়ে তুলবেন। প্রকাশ করবেন বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে। সে সময় ১৩ জন শিক্ষার্থী ২০১৬-এর প্রদর্শনীতে ছিলেন বলে তার নামও দিয়েছিলেন কালার থার্টিন। এ বছর পুরনো একজন না থাকলেও ৮৯-৯০ ব্যাচের আরও দুজন এই আয়োজনে যোগ দেন। নামকরণও হয় কালারস।

 

 

চারুশিল্পে ভালোবাসা প্রকাশের বিচিত্র উদাহরণ নেহায়েতই কম নয়। চারুশিল্পের ভালোবাসার টানেই ১৯৮৯-৯০ ব্যাচের কয়েকজন দীর্ঘ সময় পর আবারও ফিরে আসেন আপন ভুবনে। ফিরে আসার গল্পকে আরও সুন্দর করে রং-তুলিতে রাঙিয়ে তোলাই লক্ষ্য। ব্যস্ততম দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ সবাই। কেউবা আবার করেন চাকরি। কিন্তু আপন ভুবনের প্রতি টানটা যেন আগের মতোই। তাদের বন্ধুত্বের বন্ধনটা সেকালে যেমন ছিল একালেও ঠিক তেমনি। সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। ভিন্ন ভিন্ন অনুষদের হয়েও আড্ডার বেলায় সবাই সমান। বন্ধুত্বের রসায়নটা তাদের কাছে ভিন্ন। দাম্পত্য জীবনে পা রেখেও বন্ধুত্বের মেলবন্ধনটা একই সুতায় গাঁথা। এখনো সেই আড্ডা চলে। তবে আড্ডার বিষয় বস্তুতে এসেছে পরিবর্তন। আর সেখান থেকেই কালারসের উৎপত্তি।

 

আপন ভুবনে ফেরার সময়টাও কম ছিল না, দীর্ঘ ১৫ বছর। সংসারজীবন সামাল দিতে গিয়ে অনেকেই ভুলতে বসেছিলেন আপন সত্তাকে। তাদের মধ্যে ফারজানা ইসলাম ও রেবেকা সুলতানা নিয়মিত শিল্পচর্চা করেন। বাকিরা চাকরি ও সংসার; অর্থাৎ ব্যস্ততার বেড়াজালে থেকে ছবি আঁকার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে পারেননি। ফলে চারুশিল্প থেকে এক প্রকার নির্বাসনেই ছিলেন অনেকে। তবে শিল্পের প্রতি ভালোবাসার কারণেই দীর্ঘ সময় পর হলেও রং-তুলির আঁচড়ে জীবনকে নতুন করে রাঙাতে তারা একত্র হয়েছেন। যদিও তাদের আপন ভুবনে ফেরাটা শেষবারের মতো নয়। আবার এই প্রত্যাবর্তনও হঠাৎ করেই নয়। বরং এই প্রত্যাবর্তন ছিল দীর্ঘদিনের অদম্য ইচ্ছা ও শিল্পের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ক’দিন বাদে চারুকলায় অনুষ্ঠিত হবে তাদের শিল্প প্রদর্শনী। এটাই প্রথম নয়, ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে এক প্রদর্শনীর মাধ্যমে নিজেদের দীর্ঘ বিরতির অবসান ঘটান। এবারও ৯ ফেব্রুয়ারি তারা আবার আয়োজন করতে যাচ্ছেন নতুন আরেকটি প্রদর্শনী।

 

কথা হচ্ছিল দলটির বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। চোখে মুখে আনন্দের ছাপ স্পষ্টই বোঝা যায়। ফিরে আসার গল্পকে আরও সুন্দর করে সাজাতেই তাদের এই আয়োজন। ব্যাপক উৎসাহ আর উদ্দীপনার সঙ্গে জানাচ্ছিলেন তাদের অভিজ্ঞতার কথা। দীর্ঘ সময় পর হলেও দ্বিতীয়বারের মতো তারা একত্র হয়েছেন নিজেদের শিল্পচর্চাকে নতুন করে মেলে ধরতে। চারুকলায় নতুনদের উৎসাহ দেওয়ার জন্যই এই ফিরে আসা। তাদেরই একজন ভাস্কর্য বিভাগের ফারজানা ইসলাম মিল্কি। তিনি জানালেন কালারসের উত্থানের গল্প। ‘আসলে ১৯৮৯-৯০ ব্যাচের সবাই একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। ২০০১ সালে পাস করার পর সবাই যার যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও মাঝে মাঝে আড্ডা-কিটি পার্টি-টুগেদার ইত্যাদি ঠিকই চলত। আর সেখান থেকেই উঠে আসে এই পরিকল্পনার কথা। এক দিন সবাই আড্ডার ছলেই সিদ্ধান্ত নিই আবারও একটি প্রদর্শনী করব। কিন্তু তখনো ভাবতে পারিনি পুরনো সেই বন্ধুরা মিলে চারুকলায় চিত্র প্রদর্শনী করতে পারব। যেই বলা সেই কাজ, প্রথম প্রদর্শনী করলাম ২০১৬-এর ৯ ফেব্রুয়ারি। ২০০১-এ পাস করে বের হওয়ার পর অনেকেই কাজের সঙ্গে সখ্য ছিল না বললেই চলে। কয়েকজন ছাড়া সবাই যার যার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।’

 

একই সুরে সুর মিলিয়েছেন সিরামিক বিভাগের শিল্পী রেহানা ইয়াসমিন শিলা। তিনি নিজের চারুশিল্পের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। ভিন্নধর্মী এই কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলেন, ‘কাজগুলো খুব চ্যালেঞ্জধর্মী ও কষ্টদায়ক। স্কাল্পচার বা ভাস্কর্য তৈরি করা কোনো সাধারণ বিষয় নয়। সময় নিয়ে মেটাল ঘষে মেজে অনেক সাধনার পর সুন্দর একটি ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। পোড়ামাটির ভাস্কর্য তৈরি করাটাও বেশ ঝামেলার। খুব শূক্ষ্মভাবে কাজগুলো করতে হয়। কাজকে ভালোবাসতে না পারলে হয়তো এত সুন্দর ক্যানভাস, স্কাল্পচার বা ভাস্কর্য তৈরি করা সম্ভব হতো না।’

 

এবারের প্রতিটি ক্যানভাস ও ভাস্কর্যের রঙে থাকবে মাধুর্য। এ ছাড়া আমাদের এই প্রদর্শনী ও ১৯৮৯-৯০ ব্যাচ হয়তো ভবিষ্যতে চারুকলা থেকে পাস করা শিল্পীদের অনুপ্রেরণার অংশ হয়ে থাকবে। কেননা, আমরা যে দীর্ঘ একটা সময় পর আপন ভুবনে ফিরে এসেছি। অনেকের পক্ষে এই ফেরাটা সম্ভব হয় না। বিশেষত মেয়েদের বেলায় অসম্ভবই বলা চলে। তবে যে যেখানেই অবস্থান করি না কেন কাজকে যেন প্রত্যেকেই ভালোবেসে আগলে ধরে রাখি। এমনটাই জানালেন আরেক নাগরিক শিল্পী রিফাত জাহান কান্তা।

আসলে ছবি যাদের শখ, তাদের ক্ষেত্রে ছবি আঁকা মনের খোরাকই বলা চলে। কোনো পেশাগত বিষয় নয়। এর মাধ্যমে ফুটে ওঠে মানুষের মাঝের সৌন্দর্যবোধ, জীবনে বাঁচার চেতনা এবং ভালোবাসা। সবকিছু মিলিয়ে পুরো জীবনটাই একটি অসম্ভব সুন্দর ক্যানভাস। এমনই সব দারুণ পরিকল্পনা নিয়ে তৈরি করা এসব ভাস্কর্য ও ক্যানভাসগুলো ভিন্ন ভিন্ন বার্তা বহন করে। গতবারের মতো এবারের প্রদর্শনীতে ছাপচিত্র, ভাস্কর্য, জলরং, টেরাকাটা, অ্যাক্রোলিকের বহুমাত্রিক কাজের সংযোজনা স্থান পাবে। এতে সম্পূর্ণ বাস্তববাদী বিমূর্ত সমবিমূর্ত চিত্রকলার প্রাধান্য বেশি। এবারের প্রদর্শনীতে থাকছে ১৪ জন শিল্পীর নানা সংযোজন। তাদের মধ্যে রেহানা ইয়াসমিন শীলার উপজাতিদের কর্মজীবন ও পুরনো গাছের ক্যানভাস, রেবেকা সুলতানার ওমেন উইথ বার্ড এবং অচেনা ভালোবাসার অ্যাক্রিলিক ক্যানভাস, মার্জিয়া সুমির মাছের কাঁটা ও বাড়ির অবশিষ্ট দরজার অক্রিলিক ক্যানভাস থাকছে। এদিকে মুক্তি ভৌমিকের ফুল ও কবুতরের ক্যানভাস, মণিদীপা দাশগুপ্তার বহুতল ভবনের নকশাখচিত পেইন্টিং হবে নজরকাড়া। ফারজানা আফরোজ বাপ্পীর হিউম্যান সাইকোলজির ওপর অ্যাক্রিলিক পেইন্টিং, ফারজানা ইসলাম মিল্কির পেপারের ওপর অ্যাক্রিলিক কালার মিক্সড মিডিয়ার কাজের সঙ্গে থাকছে মেটাল রিলিফের দৃষ্টিনন্দন স্কাল্পচার এবং রিফাত জাহান কান্তার যাপিত জীবনের অ্যাক্রিলিক ক্যানভাস।

 

শিল্পচর্চাকে সবাই ভালোবাসেন তার প্রমাণ মেলে চারুকলার ভিন্নধর্মী এই আয়োজনে। পুরনো বন্ধুরা মিলে আগের সেই উদ্যামে কাজ করবে একসঙ্গে। ভবিষ্যতেও শিল্পচর্চার মাধ্যমে সৃজনশীল শিল্পের সমাহার ঘটবে বলে বিশ্বাস করে প্রদর্শনীর আয়োজক কালারস। তাদের একটাই কথা— ‘ফেরা যখন হয়েছে থেমে যাওয়া নয়। এগিয়ে যাব শিল্পভুবনে আপন আলোয়।’

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর