শিরোনাম
শনিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৮ ০০:০০ টা

বাংলাদেশে ৫৭ বছর

রাহাত খান, বরিশাল

বাংলাদেশে ৫৭ বছর

পরিবার-পরিজন ছেড়ে ৫৭ বছর আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন যুক্তরাজ্যের সেন্ট হ্যালেন্সে জন্মগ্রহণকারী লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হোল্ট। ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে থেকে মানবসেবায় দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী একজন তিনি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেবা করতে চান সুবিধাবঞ্চিতদের।

 

দীর্ঘ ৫৭ বছরের লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়েছে যুক্তরাজ্যের নাগরিক মানবসেবী লুসি হেলেন হোল্টের। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার, সেটা আবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে। এর থেকে বেশি চাওয়া আর কী থাকতে পারে। জীবনের শেষ ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার। সে লক্ষ্যে অনেক চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু পাননি। বহু প্রত্যাশিত সেই নাগরিকত্ব স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পাওয়ায় খুবই আনন্দিত লুসি। এরপর থেকেই নিজেকে বাংলাদেশি বলে পরিচয় দিচ্ছেন তিনি।

 

৩১ মার্চ গণভবনে লুসির নাগরিকত্ব পাওয়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ অন্যরা। সদ্য বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পাওয়া লুসি এখন বাংলাদেশ এবং ধর্ম নিয়ে নিজের লেখা বইগুলো প্রকাশ করতে চান। পাশাপাশি অসহায়-দুস্থদের নিয়ে আজীবন সেবামূলক কাজ করতে চান তিনি। বাংলাদেশ সরকারের নাগরিকত্ব পেলেও ব্রিটেনের নাগরিকত্ব ত্যাগ করবেন না লুসি। এর কারণ হিসেবে লুসি বলেন, ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৭৪.৫৬ পাউন্ড (সাড়ে ৮ হাজার টাকা) বয়স্কভাতা পান তিনি। ওই ভাতার টাকা তিনি বাংলাদেশি শিশুদের কল্যাণে খরচ করেন। ব্রিটেনের নাগরিকত্ব ত্যাগ করলে ওই ভাতা প্রাপ্তি বন্ধ হয়ে যাবে। পরিবার-পরিজন ছেড়ে ৫৭ বছর আগে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য থেকে মানবসেবা করার জন্য বাংলাদেশে এসেছিলেন যুক্তরাজ্যের সেন্ট হ্যালেন্সে জন্মগ্রহণকারী লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হোল্ট।

১৯৬০ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসে বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে যোগ দিয়েছিলেন শিক্ষানবিস সিস্টার হিসেবে। পরে যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করেন কিছুদিন। ওই সময় লুসি বুঝলেন, মিশনের সিস্টার হয়ে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট গণ্ডির কিছু মানুষকে হয়তো সেবা দিতে পারবেন, কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য কিছুই করার সুযোগ থাকবে না তার। তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে মিশনের সিস্টারের দায়িত্ব ছেড়ে সুবিধাবঞ্চিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন লুসি। সেই থেকে অসহায় দরিদ্র মানুষের সেবা করেই দিন কাটিয়েছেন তিনি। শারীরিক অক্ষমতার কারণে ৪৪ বছরের কর্মজীবন থেকে ২০০৪ সালে অবসরে যান তিনি। এরপর থেকে বই লিখে, অনুবাদ করে, অসহায় দুস্থ শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। ব্রিটেনে অবস্থানরত লুসির বন্ধু-স্বজনদের কাছে চিঠি লিখে তহবিল গঠন করেছেন। নিয়মিত পাঠদানের মাধ্যমে এ দেশে আগ্রহীদের ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী করে তোলার চেষ্টা করছেন কুমারী লুসি। মাতৃভূমি এবং সংসারের মোহ ত্যাগ করে মানবসেবার ব্রতী নিয়ে লাল-সবুজের দেশেই থেকে যান তিনি। বাংলাদেশের নাগরিক হয়েই সমাহিত হতে চান এ দেশের মাটিতে।

 

এতদিন লুসি প্রতি বছর ৩৮ হাজার টাকা দিয়ে বাংলাদেশি ভিসা নবায়ন করেছেন যা তার জন্য দুরূহ হয়ে উঠেছিল। যে ভিনদেশি মানুষটি বাংলাদেশের প্রেমে পুরো জীবন উৎসর্গ করল তার মানবিক আবেদনের বিষয়টি উঠে আসে গণমাধ্যমে। জেলা প্রশাসনের প্রচেষ্টায় ফি মওকুফসহ লুসিকে ১৫ বছরের আগাম মাল্টিপল ভিসাও দেয় বাংলাদেশ সরকার। দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত সেই ভিসা (ফি মওকুফসহ) ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পেয়ে আনন্দিত আবেগাপ্লুুত প্রবীণ মানবসেবী ব্রিটিশ নাগরিক লুসি হোল্ট। এখানেই শেষ নয়, ১২ ফেব্রুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে লুসিকে দ্বৈত নাগরিকত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ৩১ মার্চ সকালে লুসিকে ঢাকায় জরুরি তলব করা হয়। ওই দিন বিকেলে গণভবনে লুসির হাতে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব রাখাল চন্দ্র বর্মন ২৯ মার্চ লুসির নাগরিক সনদপত্রে স্বাক্ষর করেন।

 

১৯৩০ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের সেন্ট হ্যালেন্সে বাবা জন হোল্ট এবং মা ফ্রান্সিস গ্রেসের দাম্পত্যে জন্মগ্রহণ করেন লুসি হেলেন ফ্রান্সিস হোল্ট। দুই বোনের মধ্যে বড় বোন রুথ ফেলটন এবং লুসি ছোট। ছোটবেলা থেকেই সিস্টার (ধর্মীয় সেবক) হওয়ার স্বপ্ন ছিল লুসির। ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরের ফাতেমা হাসপাতালে সেবিকা থাকাকালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদেরও সেবা করেন লুসি। ওই সময় ব্রিটেনে মায়ের কাছে চিঠি লিখে লুসি জানিয়েছিলেন—

 

‘পূর্ব পাকিস্তানিরা স্বাধীন হতে চাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর মতো একজন যোগ্য নেতা পেয়েছে। বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ চায় না’

 

এভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় এর স্বপক্ষে জনমত গড়ে তোলেন লুসি। মায়ের মৃত্যুর পর চিঠিটি আবার লুসির কাছে ফেরত পাঠায় তার বড় বোন রুথ ফেলটন। লুসি বলেন, বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণা ছিল তার সহধর্মিণী। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি উপহার পাঠিয়েছিলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে। এর জবাবে ১৯৭৩ সালের ২০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ছোট মেয়ে রেহানা শেখের নিজের হাতের লেখা একটি ধন্যবাদপত্র পেয়েছিলেন লুসি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যশোর থেকে রাজশাহী এবং কুড়িগ্রামে মিশনভিত্তিক সেবিকার কাজ করে ফের ৩০ বছর পর ২০০৩ সালে বরিশাল অক্সফোর্ড মিশনে আসেন তিনি। মিশনের কর্মজীবন থেকে ২০০৪ সালে অবসরে যান তিনি। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের মানুষের আন্তরিকতা, ভালোবাসা এবং আতিথিয়েতার বন্ধন ফিরে যেতে দেয়নি ব্রিটেনে।

 

প্রধানমন্ত্রী লুসির হাতে নাগরিকত্ব সনদ তুলে দেওয়ার পর জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, এই পাওয়া শুধু লুসির নয়, বরিশালবাসীর। লুসিকে নাগরিকত্ব দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন জেলা প্রশাসক। একই সঙ্গে লুসির নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে যারা বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানান জেলা প্রশাসক।

 

নাগরিকত্ব পাওয়ায় লুসি বাংলাদেশ সরকার, সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং এই প্রক্রিয়ায় যারা বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন তাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

দীর্ঘ ৫৭ বছর বাংলাদেশে বসবাসকারী লুসি ৩/৪ বছর পর পর একবার বেড়াতে যান তার জন্মভূমিতে। সেখানে গিয়ে ৪ থেকে ৫ মাস থাকেন আবার ফিরে আসেন বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার টানে। মাঝে মধ্যে বড় বোন ফ্রান্সিস হোল্টের সঙ্গে যোগাযোগ হয় চিরকুমার লুসির। মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার প্রয়াসে শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে বিয়েও করেননি তিনি। থেকে যান চিরকুমারী।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর