শিরোনাম
শনিবার, ৫ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা

ইভটিজারকে ধরিয়ে দেওয়াই তার কাজ

শনিবারের সকাল ডেস্ক

ইভটিজারকে ধরিয়ে দেওয়াই তার কাজ

প্রতিদিন নারীরা নিপীড়ন ও হয়রানির শিকার হবে এটি যেন প্রায় অবধারিত। সকাল হলেই খবরের কাগজে শিরোনাম আসে এক বা একাধিক নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ এমনকি খুনের সংবাদের। সচেতন সমাজ কিছুদিন সরব থাকে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় চলে, হ্যাশট্যাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইভেন্ট খোলা হয়। কিন্তু দিন শেষে সেই একই ফলাফল। তোলপাড় যতই হোক কিছুদিন পরে তা ঠিকই থেমে যায়। প্রকৃত সুবিচার বা অন্যায় প্রতিহত আর হয় না। তবে সমাজে এমনও লোক আছেন যাদের চোখে এসব পরিণতি জ্বালা ধরায়, তাদের মনকে পীড়া দেয়। তেমনি একজন ব্যক্তি ভারতের দীপেশ। তিনি চেয়েছেন এ ধরনের অন্যায়ের স্থায়ী সমাধান। চেয়েছেন অপরাধ থেমে যাক অঙ্কুরেই। আর তাই তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন একটি ভিন্নধর্মী কাজের। তার উদ্যোগে মাত্র ছয় মাসে মুম্বাই পুলিশ ১৪০ জন যৌন নিপীড়ক ও হয়রানিকারীকে জেলবন্দী করতে সক্ষম হয়েছে।

 

প্রচলিত ধারণামতে, সমাজ সচেতন ও মানবিকতার প্রতীক হতে শিক্ষিত, মার্জিত ও ভদ্র সমাজে জন্মাতে হয়। অথচ এমন সমাজেও জন্ম নেয় মানুষরূপী বহু পশু। সেখানে বস্তিতে জন্মানো কোনো ছেলের কাছে কী আর আশা করা যায়? প্রচলিত এই ধারণা যে শতভাগই সত্য নয় তার প্রমাণ দিলেন দীপেশ। মুম্বাইয়ের বস্তিতে জন্ম নেওয়া দীপেশ আজ নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় রাখছেন অগ্রণী ভূমিকা। ছোটবেলা থেকেই তিনি দেখে এসেছেন তার মাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে। বাবা ছিলেন অসুস্থ শয্যাশায়ী। আর তাই মাকেই পুরো সংসার একা চালাতে হতো। তার মা একটি ক্যাটারিংয়ের ব্যবসা চালাতেন। প্রতিদিন ১২ ঘণ্টার ওপরে কাজ করে রাতে ফিরতেন প্রায়ই অনেক দেরি হয়ে যেত। এজন্য বস্তির অন্যান্য অধিবাসীরা দীপেশের মাকে নিয়ে বিভিন্ন কুৎসা রটাত। দীপেশের সামনেই তার মায়ের নামে অশ্লীল গালমন্দ করত। কিন্তু এসব শুনেও দীপেশের মনে তার মা সম্পর্কে কখনই অশ্রদ্ধা জন্মায়নি। কারণ ছোট্ট দীপেশ খুব কাছ থেকেই মায়ের জীবনসংগ্রাম দেখেছেন।

 

১৬ বছর বয়সে দীপেশ পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে একটি অফিসে চাকরি নেন। নিজের কাজের প্রতি দীপেশ ছিলেন খুবই সচেষ্ট। প্রতিদিন সবার আগে অফিসে উপস্থিত হতেন। অফিস থেকে বের হতেন সবার পরে। অন্যদের মতোই তিনি যাতায়াতের জন্য মুম্বাইয়ের লোকাল ট্রেন ব্যবহার করতেন। একদিন ট্রেন স্টেশনে তাকে মুখোমুখি হতে হয় একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার। তিনি দেখতে পান, লেডিস কম্পার্টমেন্টের সামনে কয়েকজন নারীকে একদল বখাটে ঘিরে ধরে উত্ত্যক্ত করছে। দীপেশ বুঝতে পারেন এই পরিস্থিতি তার একার পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই ছুটে যান স্টেশনে কর্মরত পুলিশের কাছে। দীপেশের অভিযোগ শুনে প্রথমে পুলিশ আমলেই নিতে চায়নি। বারবার তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু দীপেশ বারবার তাদের কাছে অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন। অবশেষে একজন পুলিশ তার সঙ্গে ঘটনাস্থলে যেতে রাজি হয়। কিন্তু ততক্ষণে অপরাধীরা কেটে পড়েছে।

এমন তিক্ততার ঘটনা দীপেশের মনে গভীর দাগ কাটে। তিনি বুঝতে পারেন, কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছে না। বিষয়টিকে তারা খুব সামান্য ভেবেই যে আমলে নিতে চান না তা তার বুঝতে বাকি থাকে না। কিন্তু এই ঘটনা দীপেশ কিছুতেই ভুলতে পারেন না। বরং তিনি তার মায়ের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েন। কারণ প্রতিরাতে তার মায়ের বাড়ি ফিরতে দেরি হয়। মাথায় দুশ্চিন্তার পাহাড় চেপে বসে, চলার পথে তার মায়ের সঙ্গেও যদি বাজে কিছু হয়ে যায়! এই ভাবনা থেকেই দীপেশ তখন বন্ধুদের নিয়ে এক অভিনব কাজ শুরু করেন। তারা কয়েক দিন মুম্বাইয়ের বেশ কিছু বাস ও রেলস্টেশন ঘুরে বুঝতে পারে, এই জায়গাগুলোই মূলত অপরাধীদের প্রধান আখড়া। অন্তত শতকরা ৮৫ জন নারী প্রতিদিন এসব জায়গাতে হয়রানির শিকার হয়। তখন তারা চিন্তা করেন, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। এখনই কিছু একটা করতে হবে, যাতে বখাটেরা আর কাউকে উত্ত্যক্ত করতে না পারে।

দীপেশ তখন এমন একটি সানগ্লাস কেনেন, যার ভিতরে ছিল এইচডি ক্যামেরা বসানো। এই সানগ্লাসটি পরে তিনি প্রতিদিন ট্রেন স্টেশনের  লেডিস কম্পার্টমেন্টগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। দীপেশের দৃষ্টিসীমার মধ্যে সবকিছুকে ক্যামেরায় রেকর্ড করতে থাকেন। বেশ কয়েক দিন এমন করার পর তিনি ধরে ফেলেন একটি চক্রই নিয়মিত নারীদের হেনস্তা করে আসছে। ততক্ষণে তার কাছে উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ চলে আসছে। সেগুলো নিয়ে দীপেশ যান পুলিশের কাছে। সবকিছু পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পুলিশও ঘটনার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারে। এবার তারাও ৪০ সদস্যের একটি দল গঠন করেন, যারা দীপেশ ও তার বন্ধুদের সঙ্গে একই কাজ করা শুরু করেন। এভাবে মাত্র তিন থেকে চার বছরের মধ্যেই এই দলটি দেড় শতাধিক অপরাধীকে হাতেনাতে ধরে জেলে পুরতে সক্ষম হয়।

 

দীপেশের এই অভিনব কৌশলের বদৌলতে সাম্প্রতিক সময়ে মুম্বাইয়ের রাস্তাঘাটে নারীদের ওপর হয়রানি ও নিপীড়নের হার অনেকাংশে হ্রাস  পেয়েছে। কিন্তু তারপরও দীপেশ মনে করে, তার কাজ এখনো শেষ হয়নি। তার চাওয়া গোটা সমাজ থেকেই নারী নির্যাতনের মতো একটি ন্যক্কারজনক শব্দকে মুছে ফেলা। তাই দীপেশ এখন বড় পরিসরে কাজ শুরু করেছেন। যারা বাড়িতে স্বামী, গৃহকর্তা বা অন্যান্য পুরুষের কাছে নিগ্রহের শিকার হন তাদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজ থেকে এই সমস্যাটি নির্মূল করতে চাইলে শুধু নিজে ভালো থাকলেই চলবে না, যারা এসব কাজ করেন তাদের বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থান নিতে হবে। আর যতদিন না সেটি সম্ভব হচ্ছে, দীপেশের সংগ্রামও অব্যাহত থাকবে।

সর্বশেষ খবর