শনিবার, ৫ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
ড. আতিউর রহমান

গরিব মানুষকে সাহায্য করাই আমার কাজ

গরিব মানুষকে সাহায্য করাই আমার কাজ

ছবি : জয়ীতা রায়

ড. আতিউর রহমান সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। এই সংগ্রামে নিজে যেমন জয়ী হয়েছেন, তেমনি অন্যদের দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন। সবার কাছে তিনি এখন গরিবের অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। জামালপুরের দিঘপাইত গ্রামের দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের এই শিক্ষক দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টানা দুই মেয়াদে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালনে অভিজ্ঞ। রাজধানীর বাংলামোটরে নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সমন্বয় কার্যালয়ে অনেকটা খোলামেলা ও প্রাণবন্ত হয়েই সমকালীন অর্থনীতি, নিজের জীবন কর্ম, স্বপ্ন নিয়ে বলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে। দীর্ঘ আলাপচারিতায় উঠে এসেছে— ড. আতিউর রহমানের সুচিন্তিত ভাবনা, আক্ষেপ ও কষ্টের কথা। লিখেছেন— রুহুল আমিন রাসেল

 

এখন ড. আতিউর রহমানের দিন শুরু হয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন সমন্বয়ে এসে। তিনি বলেন, ‘এখানে আমি বেশির ভাগ সময় গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এখানে যেসব জুনিয়র ছেলেমেয়ে কাজ করে তাদের গাইডলাইন দিচ্ছি আমি। এর সঙ্গে সপ্তাহে দুই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসও নিচ্ছি। আরেকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্লাস নিচ্ছি। এর বাইরে সবচেয়ে বেশি সময় কাটছে লেখালেখি করে।’ তিনি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় লিখছেন। এ বছর চারটি বই প্রকাশ পেয়েছে তার। এর মধ্যে দুটি ইতিমধ্যে বেরিয়েছে। একটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। আরেকটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক। নাম দিয়েছেন— গণমানুষের মুক্তিযুদ্ধ। এখনো পুরনো বিষয় নিয়েই গবেষণা করছেন। গরিব মানুষ নিয়েই তার কাজ। এখন কাজ করছেন এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ওপর। আরেকটি কাজ করছেন কৃষকের জন্য এনজিওদের মাধ্যকে কীভাবে সহজে কৃষি ঋণ দেওয়া যায়, তা নিয়ে। উপকূল ও চরের মানুষজনকে নিয়েও কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমি মনে করি— চরের মানুষের জন্য পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন—পিকেএসএফের মতো একটি সংগঠন গড়তে চাই। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে লিখিত চিঠি দিয়েছি। চরের মানুষ বা গরিব মানুষের প্রতি আমার সারাজীবনের ঋণ। সারাজীবন তাদের কথা ভেবেছি। গবেষণাও করেছি। আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদানের পর তাদের জন্য বেশি বেশি কাজ করেছি। আমি মনে করি বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিরসনটাই এখনো উন্নয়নের এক নম্বর চ্যালেঞ্জ। এটা আমার জীবনেরই চ্যালেঞ্জ। গরিব মানুষের জন্য পক্ষপাতিত্ব আমার সারাজীবনের। এটা তো সবারই জানা। কারণ— আমি দারিদ্র্যকে খুব সামনাসামনি দেখেছি। আমার চোখের সামনে দরিদ্র মানুষের দুঃখ, কষ্ট দেখেছি। এটা আমার জীবন সংগ্রামের অংশ। তাদের ভাগ্য পরিবর্তন না করতে পারলে, তার যে প্রভাব, তা পূর্ণ হবে না।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— ‘অনেকেই তো বলেন, আমি রুপার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছি। সুতরাং দারিদ্র্য আমি কী বুঝব। কিন্তু আমি তো পূর্ব-বাংলায় এসে দু-চোখ ভরে তন্ন তন্ন করে গরিব মানুষের জীবন গাথা দেখেছি। এবং তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছি।

রবীন্দ্রনাথ কিন্তু নিজে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম না করেও লেখার চেষ্টা করেছেন। আর আমি নিজের চোখে এই দারিদ্র্যকে দেখেছি। এই দারিদ্র্যের মধ্য থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেছি। আমার চ্যালেঞ্জটা হলো— পেছনটা যেন আমাকে আর না টানে। আমি যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই চেষ্টা করেছি কীভাবে গরিব মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা যায়। আমার পিএইচডির মূল বিষয় ছিল— বাংলাদেশের কৃষকের শ্রেণিবিন্যাস।’

 

ড. আতিউর রহমানের কাছে তার নিজের জীবনই নিজের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। কারণ— গরিব মানুষগুলো এতো অল্প সম্পদে কেমন করে বেঁচে থাকে, তা ছোট বেলা থেকে তিনি দেখেছেন। অল্প পয়সায় গরিব মানুষ নিজেরা বেঁচে থাকে। সন্তানদের বাঁচান। তাদের সংগ্রামটা বিরাট। সন্তানদের লেখাপড়া। এখন তো বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ শিশু স্কুলে যায়। মানুষ যে বুঝতে পেরেছে, লেখা পড়া একটা উপায়। একটা সিঁড়ি। তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— ‘সভ্যতায় উঠবার জন্য মহাসড়ক হলো শিক্ষা’। এখন দেখছি— শিক্ষার ওপর যে পরিবার জোর দিচ্ছেন, তারাই দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসছেন। সুতরাং শিক্ষাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।’

 

ড. আতিউর রহমান চেয়েছিলেন মানবিক হবে ব্যাংকিংখাত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি যখন প্রথম বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করেছি, সে দিন বলেছিলাম— আমি ব্যাংকিংখাত মানবিক করব। মানবিক ব্যাংকিং সেই সুবাদে শুরু। ব্যাংকগুলোকে বলেছি, এই সমাজের অর্থ দিয়েই আপনারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন। কিন্তু এই সমাজের জন্য আপনারা কি করছেন? সে জন্যই একটি সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক নীতিমালা করেছি। আমরা সামাজিক দায়িত্ব ও কৃষি ঋণের ওপর জোর দিয়েছিলাম। এসএমই ঋণ ও সবুজ শিল্পে অর্থায়নের ওপর জোর দিয়েছি। নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে জোর দিয়েছি। এসব উদ্যোগের উদ্দেশ্য ছিল— সমাজের বঞ্চিত মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন করা। যারা অবহেলিত, যারা পেছনে পড়ে আছে, তাদের সুযোগ করে দিয়ে সামনে আনতে চেয়েছি। এটা করেছি মূলত দারিদ্র্য যাতে নিরসন হয়, সেই উদ্দেশ্যে। আমি সবুজ শিল্পের যে উদ্যোগ নিয়েছি, তার ফসল এখন বাংলাদেশ পাচ্ছে। বিশ্বের প্রথম ১০টি শিল্পের ৭টি সবুজ পোশাক কারখানা এখন বাংলাদেশের। প্লামি ফ্যাশন পোশাক কারখানাটা এখন বিশ্বের এক নম্বর কারখানা। আমার একটা আবেদন থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে, তা হলো— সবুজ অর্থায়নের কাজটা দ্রুত এগিয়ে নিন। একটু সবুজ মন নিয়ে এগিয়ে যান।’

 

নিজের কষ্টের কথা জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমি অনেক কষ্ট করে বাংলাদেশ ব্যাংকের মান মর্যাদা, স্বায়ত্ত শাসন, সব কিছু বাড়িয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সাড়া বিশ্বে সুনাম অর্জন করেছিল। তিন তিন বার বিশ্বে পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুবার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর হিসেবে আমি পুরস্কার পেয়েছি। তবে আমার একটা আক্ষেপ। সেটি হলো— বাংলাদেশ ব্যাংকের যে নৈতিক বল ছিল, সেই বলটা ভেঙে পড়েছে। স্বার্থান্বেষী মহল আমার পদত্যাগের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে মেরুদণ্ডটা ছিল, সেটা ভেঙে দিয়েছে। এটা ভেঙে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। এটা আমার জন্য কষ্টকর। বাংলাদেশ ব্যাংক মাথা উঁচু করা একটি প্রতিষ্ঠান। সে কেন এতো দুর্বল হবে।’

 

প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশ খুব ভালো করছে বলে প্রশংসা করেন ড. আতিউর রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবই কিন্তু খুব ভালো লক্ষণ। কিন্তু খালি সতর্ক থাকতে হবে যে, এই প্রকল্পগুলো সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে যেন কোনো আর্থিক অস্থিতিশীলতার মুখে না পড়ে। বিশেষ করে নির্বাচনের এই বছরে। সুতরাং আর্থিক স্থিতিশীলতা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যে কোনো মূল্যে এই আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। এবং সহজেই যেন সবাই ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে, সেই পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। আরেকটি হলো— জিনিসপত্রের দাম যেন না বাড়ে সে দিকে নজর রাখতে হবে। ভোটাররা কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বাড়লে পরে তারা নিজের খুব কষ্ট পাবে। কোনো অবস্থাতেই মূল্যস্ফীতি যাতে না বাড়ে, সেই দিকে সবার নজর রাখতে হবে।’

 

ড. আতিউর রহমান মনে করেন এই সরকার জনগণের জন্য ভালো কাজ করছে। তবে ভালো কাজ করাই যথেষ্ট নয়। জনগণও যেন মনে করেন সরকার ভালো কাজ করছে। এই রকম একটি পরিবেশ সব সময় বজায় রাখতে হবে সর্বত্র। সবচেয়ে বড় কথা আর্থিক স্থিতি যেন বজায় থাকে। ডলারের দাম যেন স্থিতিশীল থাকে। মূল্যস্ফীতি যেন কম থাকে। সুদের হার যেন ঠিক থাকে। ব্যবসায়ীরা যেন কোনো রকম চ্যালেঞ্জের মধ্যে না পড়ে। এটাই এই সময়ে ড. আতিউর রহমানের সবচেয়ে বড় পরামর্শ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি নিজের আরেকবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ ব্যাংক যখন পরিচালনা করেছি, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছি। আমি যে প্রথম বাংলাদেশ ব্যাংকে পা দিলাম, সেদিন প্রধানমন্ত্রী আমাকে ছোট একটি এসএমএস (খুদেবার্তা) করলেন যে— প্লিজ ওয়ার্ক ফর দ্য পুর (গরিবের জন্য কাজ করবেন)। এই বার্তাকে আমার কাজের জন্য শিরধার্য মনে করেছিলাম। সারাক্ষণ আমি গরিবের জন্য কাজ করেছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই। তিনি একক সিদ্ধান্তে আমাকে গভর্নর বানিয়েছিলেন। আমি জনস্বার্থে যে কোনো দায়িত্ব পালন করতে রাজি। আমার এ জীবন জনগণের সমর্থনে শুরু করেছি। এবং জনগণ, বিশেষ করে সাধারণ মানুষের কল্যাণ আমার জীবনের একটা বড় ব্রত।’

সর্বশেষ খবর