শনিবার, ৩০ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা
বৃত্তের বাইরে

ছুটির অবসরে বৃদ্ধাশ্রমে

শাহানা ইসলাম

ছুটির অবসরে বৃদ্ধাশ্রমে

চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নোয়াপাড়া, ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্য সেনের গ্রামে আমেনা বশর নামের পরিপাটি একটা বৃদ্ধাশ্রম। চারধারে সবুজে ঘেরা, স্বচ্ছ জলধারায় শান বাঁধানো ঘাট। পুরুষ-মহিলার জন্য আলাদা আলাদা ভবন। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান সবাই যার যার ধর্ম পালন করে যাচ্ছেন স্বাধীনভাবে। খাবারের ক্ষেত্রেও সবাই যার যার ধর্ম মতে স্বাধীন, মালিকের নাম জানলাম শামসুল আলম। খুব ইচ্ছে হলো এমন একজন নির্মল মনের মানুষকে একবার দেখার। দুইবার গেলাম, একবারও দেখা হলো না। মনে মনে তাকে আশীর্বাদ করলাম, এমন সন্তান যেন প্রতিটি ঘরে ঘরে একটা হলেও জন্মায়। শ্রদ্ধায় আমার মাথাটা নুইয়ে এলো তার প্রতি।

আশ্রমের আশ্রিতদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জানলাম, বেশির ভাগই সন্তানের মা। একটা বাক্য আমার বুকের ভিতরে সূচের মতো বিঁধল যেন, ‘ছেলে বউয়ের কথায় আলাদা করে দিল’! বউ শাশুড়ির মধ্যে মতের অমিল! ছোট বেলায় দেখেছিলাম, মা একটা লাউয়ের লতা লাগিয়েছিলেন। একটা চিকন লতার ওপর ভর করে মাচায় ঝুলেছিল একটা বিশাল আকারের লাউ। বিস্ময়ে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মা- এই ছোট্ট লতাটার ওপর এত বড় লাউটা ঝুলছে কীভাবে! ছিঁড়ে পড়ে যাবে না তো?

মা সারল্য মাখানো স্বরে বলেছিলেন, না-ছিঁড়বে না! ঠিক নারীর মতোই! আমরা যেমন পারি। দশমাস দশদিন গর্ভে ধারণ করি, রক্তক্ষরণ করে জম্ম দিই, লালন করি, ঠিক তেমনই।

বড় হতে হতে বুঝলাম আমরা নারীরা পারি একটা সংসারের বন্ধন অটুট রাখতে। সমাজ আলোকিত করার মতো সন্তান উপহার দিতে। সময়ের নির্মমতায় যখন দেখলাম, একজন সন্তান কীভাবে তার মা-বাবাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। লজ্জায় মাথাটা আমার হেট হয়ে এলো। যে বউটা তার শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য করছে সুস্থ মাথায় সে যদি একবার চিন্তা করত; একদিন আমি যখন শাশুড়ি হব তখন আমাকে যদি আমার ছেলে আর ছেলের বউ বৃদ্ধাশ্রমে যেতে বাধ্য করে তখন আমার মনের অবস্থাটা কেমন হবে? স্বামীর আদর ভালোবাসা, স্বামীর অর্থ বিত্তকে যদি ভালোবাসতে পারি তাহলে যে মা স্বামীকে জন্ম দিতে গিয়ে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করলেন তাকে কেন ভালোবাসতে পারব না? সন্তান তো মায়েরই শরীরের অংশ বিশেষ।

মা-বাবা যখন বৃদ্ধ হয়ে যায় তখন অনেক সময় তারা ছোট্ট শিশুটির মতো হয়ে যায়। সন্তান যখন ছোট থাকে তখন মা-বাবা কোলে পিঠে করে সন্তানকে বড় করে তুলেন। মা-বাবা যখন বৃদ্ধ হয়ে ছোট্ট শিশুটির মতো হয়ে যায় তখন সন্তান কেন পারেন না তাদের বুকের ওপর আগলে রাখতে? কেন তাদের যেতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে?

আমরা নাকি সভ্য জাতি, আদিম বর্বরতার অবসান করে আজ আমরা নাকি আলোর পথের যাত্রী। আদৌ কি আমরা আমাদের মনের ভিতর হতে আদিম-অন্ধকার দূর করতে পেরেছি? পারছি? যদি পারতাম তাহলে আজও কেন আমাদের মা-বাবাদের বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়? মনের ভিতরে ঘুরপাক খায় নানান প্রশ্ন, কেন মানুষ এত নিষ্ঠুর হয়? কেন আমরা পারি না ভালোবেসে ভালো রাখতে? একটা নিকষ কষ্টে বুকটা ভারি হয়ে এলো।

নমিতা মাসীকে দেখলাম নিবিষ্ট মনে পূজা করতে। জানলাম, চট্টগ্রাম শহরে তার নিজস্ব বাড়ি আছে। এক সময় কলকাতায় থাকতেন। সোশ্যাল ওয়ার্কের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সময়ের স্রোতে আজ তার স্থান বৃদ্ধাশ্রমে!

রেনু মাসীর কান্নায় আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলাম, ছেলে বি সি এস ক্যাডার, সরকারি কর্মকর্তা। মেয়েও সরকারি কর্মচারী। দুই নাতির একজন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংলিশে এম এ আর একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে এম এ।

আর একজনকে দেখলাম একদম চুপচাপ, নির্বাক বোবা যেন। জানলাম, অতিরিক্ত মানসিক চাপে পাগলপ্রায়। তার এক মেয়ে ডাক্তার।

চলে আসতে পা বাড়াতে গিয়ে থমকে থমকে পিছু ফিরে দেখলাম। আমার কণ্ঠনালী যেন স্তব্ধপ্রায়। ভাবলাম, বড় বড় ডিগ্রি নিলেই কি আমরা শিক্ষিত হয়ে উঠি? আমাদের অন্তরের কালিমা যদি দূরীভূত না হয় আমরা শিক্ষিত হয়ে উঠি কীভাবে? একটা নিকষ কষ্টে আমার বুকটা ভারি হয়ে এলো যেন। আমার এই ছোট্ট মন শুধু এটুকুই বুঝল-পরিবর্তনের প্রয়োজন, আমাদের এই সঙ্কীর্ণ মানসিকতার। সমাজের নির্মম রূপ রেখার। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ভারাক্রান্ত মনে চোখ তুলে দেখলাম উদার আকাশটাকে। ধীরে ধীরে মেঘের আঁচলটা অন্ধকার হয়ে উঠছে। সময় আমাকে যেন বলে দিচ্ছে-বৃষ্টি নামার আগেই গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। কিন্তু মনের ভিতর একটা কষ্টবোধ থেকেই গেল!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর