শনিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

গিনেস বুকে বাংলাদেশের আশরাফুল

ফারুক তাহের

গিনেস বুকে বাংলাদেশের আশরাফুল

১৮ বছরের কিশোর চট্টগ্রামের আশরাফুল ইসলাম। ফুটবল নিয়েই কাটে তার দিনের ২ থেকে ৩ ঘণ্টা। ফুটবলই তার ধ্যান-জ্ঞান। এই ফুটবলই তাকে এনে দিয়েছে বিশ্বখ্যাতি। তবে তিনি খেলোয়াড় হিসেবে ফুটবল নিয়ে মাঠে নামেন না কখনো। নামেন ফুটবল নিয়ে নান্দনিক সব কসরত দেখাতে। ফুটবল কসরত দেখিয়ে তিনি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে নিজের নাম লিখিয়েছেন। গড়েছেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড। ভারতের ফুটবল কসরতকার আর্কিস প্যাটেলের রেকর্ড ভেঙে এই সম্মানজনক বিশ্ব রেকর্ড নিজের করায়ত্তে আনেন আশরাফুল। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই আশরাফুলের এই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন ভারতের অপর ফুটবল কসরতকার সতীশ কে। তাতে এই কিশোর মনোবলের দিক থেকে এতটুকু ভেঙে পড়েননি, বরং প্রতীজ্ঞচিত্তে বললেন, ‘পাঁচ মাসের মধ্যেই আমি আবার বর্তমান রেকর্ড ভাঙতে চাই। অলরেডি আমি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদনও করে রেখেছি।’

 

কে এই আশরাফুল ইসলাম

না এই আশরাফুল বাংলাদেশের ক্রিকেট কিংবদন্তি আশরাফুল নন। ছিপছিপে গড়নের এই কিশোর আশরাফুল পেশাদার কোনো ফুটবল খেলোয়াড়ও নন। তার ভাষায় ‘আমি একজন ফুটবল ফ্রিস্টাইলার (কসরতকার)। যখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র তখন টেলিভিশনের একটি বিজ্ঞাপন চিত্র আমাকে আকৃষ্ট করে। কোমল পানীয় পেপসির ওই বিজ্ঞাপনটিতে একজন বিদেশি মডেল ফুটবল নিয়ে নানা স্টাইল করত। তা দেখে দেখে আমিও বাসায় ফুটবল নিয়ে নানা কসরত শুরু করলাম। যখন নবম শ্রেণিতে, তখন ব্রাজিলের রোনালদিনহোকে দেখলাম মাঠের বাইরে তিনি ফুটবল নিয়ে নান্দনিক সব কসরত করতেন। এরপর আমি আরও জোর দিলাম এই কাজের প্রতি। দিনে অন্তত ২-৩ ঘণ্টা ফুটবল নিয়ে ফ্রিস্টাইল চর্চা করতাম। ইউটিউব ও গুগলে গিয়ে বিভিন্ন স্টাইল এবং স্টাইলারদের সম্পর্কে জানলাম। এভাবে করতে করতে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড সম্পর্কে জানলাম এবং সেই রেকর্ড ভাঙার জন্য আরও মনোযোগী হলাম।’

ফ্রিস্টাইল চর্চা নিয়ে মেতে থাকলেও আশরাফুল পড়ালেখার প্রতি কখনো অমনোযোগী ছিলেন না। রেডিয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে তিনি এসএসসি এবং চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পাস করে বিবিএতে ভর্তির অপেক্ষায় রয়েছেন।

 

ছাদের মাদুরই অনুশীলন মাঠ

আশরাফুলদের পৈতৃক বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলার ধর্মপুরে। চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও আবাসিকের একটি দ্বিতল বিল্ডিং তাদের। নিচতলায় থাকেন চাচা-চাচীরা আর ওপরে আশরাফুলরা। পরিবারের সদস্য বলতে তার মা সাদাদ আফজা এবং তৃতীয় শ্রেণিতে পড়–য়া ছোট বোন আয়ানা ইসলাম। ব্যাংকার বাবা শহীদুল ইসলাম অধিকাংশ সময়ই থাকেন ঢাকায়। একতলার ওপরে ছাদের অর্ধেকে বাসা, বাকি অর্ধেকে তার মায়ের করা ছাদবাগান এবং একপাশে তার অনুশীলন করার জায়গা। সেখানেই বিছানো আছে একটি হালকা ম্যাট বা মাদুর। মূলত এই মাদুরই আশরাফুল ইসলামের অনুশীলন মাঠ। মাদুরের একপাশে ছাদের একটি দেয়ালে লেখা 4FREESTYLE #Fslife Tekneek|। অন্যপাশে লেখা ও I AM KING|। ফুটবল কসরতের জগতে চট্টগ্রামের এই উদ্যমী কিশোর সত্যি সত্যি রাজা হতে চলেছেন! পড়ালেখার পাশাপাশি যে কাজটি খুব আবেগ এবং একাগ্রতার সঙ্গে করেন সেটি হচ্ছে ফুটবল কসরত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফ্রিষ্টাইলাররা সাধারণত যেসব কসরত চর্চা করে থাকেন আশরাফুল ইতিমধ্যে সেসব রপ্ত করে ফেলেছেন। ফ্রিষ্টাইলাররা যেমন মাথা, কাঁধ, হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ব্যবহার করে ফুটবল কসরত করেন, আশরাফুলও তাই করেন। এক কথায় ফুটবলকে বশ করে তিনি এখন দেশে তো বটেই, বিশে^র কাছে অনন্য ফ্রিষ্টাইলার হিসেবে গণ্য।

 

রেকর্ড গড়ার কাহিনী

এক মিনিটে মাথার একপাশ থেকে অন্যপাশে একনাগাড়ে কতবার একটি ফুটবলকে গড়ানো যায় তার ওপরই নির্ভর করে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড তাদের রেকর্ড সনদ দেন ফ্রিষ্টাইলারদের। অনলাইনে এই বিভাগের নাম হচ্ছে ‘মোস্ট সাইড হেড স্টাল বল কন্ট্রোল ট্রিকস ইন ওয়ান মিনিট’। অত্যন্ত কৌশলনির্ভর এই কাজটি মিনিটে ১০১ বার করে রেকর্ড করেছিলেন ভারতের আর্কিস প্যাটেল। তার সেই রেকর্ড চলতি বছরের মে মাসে ১০৪ বার করে ভেঙেছিলেন আশরাফুল ইসলাম। কিন্তু পরবর্তী মাসখানেকের মধ্যে আশরাফুলের এই বিশ^রেকর্ড কেড়ে নিলেন ভারতের ফুটবল কসরতকার সতীশ কে। তিনি করেছেন মিনিটে ১০৫ বার। এখন সতীশের এই রেকর্ড ভাঙতে অনুশীলন করে প্রতিদিন ঘাম ঝরাচ্ছেন বাংলাদেশের গর্ব আশরাফুল। আলাপচারিতার ফাঁকে আশরাফুল জানালেন, ‘এটা আমার জন্য কোনো ব্যাপারই না। আমি ১১০ বার করে সতীশের রেকর্ড ভাঙবো।’

 

স্বপ্ন দেখেন ‘সুপার বল’ করায়ত্তের

আশরাফুল জানান, চেক রিপাবলিকে বিশ্বের সেরা ফুটবল কসরতকারদের প্রতিযোগিতার আসর বসে প্রতি বছর। ‘সুপার বল’ খ্যাত এই প্রতিযোগিতার বর্তমান ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন নরওয়ের এরল্যান্ড (ERLEND)। এরল্যান্ডের সঙ্গে আশরাফুলের নিয়মিত যোগাযোগ হয় ইনস্টাগ্রামে। আশরাফুলের দৃঢ় বিশ্বাস একদিন এই চ্যাম্পিয়নশিপ তার হাতে আসবে। বিশ্বের বুকে উড়াবেন বাংলাদেশের জয়পতাকা।

ফুটবল কসরত নিয়ে ভাবনা

দেশে ফুটবল কসরত নিয়ে তেমন কোনো আয়োজন-প্রদর্শন বা প্রতিযোগিতা হয় না। ঢাকায় নটর ডেম এডভেঞ্চার ক্লাব গত বছর একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। সেখানে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন আশরাফুল। আশরাফুল বলেন, ‘ফুটবল কসরত শেখানোর কোনো প্রতিষ্ঠানও গড়ে ওঠেনি। এ কাজে আমার শিক্ষক বলতে ব্রিটিশ ফুটবল ফ্রিষ্টাইলার টম ফলান এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক সৈয়দ মুক্তাসিদ। তাদের দুজনকে আমি বেশি ফলো করি। এ ছাড়াও আম্মু-আব্বুর অনুপ্রেরণাতেই আমি এতটুকু অর্জন করতে পেরেছি।’

ইউটিউবে তাদের আপলোড করা কসরতগুলো বেশ উপভোগ করেন আশরাফুল। তাদের শিল্পনৈপুণ্যকে রীতিমতো গুরু মানেন কিশোর আশরাফুল। টম ফলানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ না হলেও সৈয়দ মুক্তাসিদের সঙ্গে হয়েছে। ২০১৫ সালে সৈয়দ মুক্তাসিদ বাংলাদেশে এলে তার সঙ্গে দেখা করেন আশরাফুল। আশরাফুলের ফুটবল কসরতের কৌশল ও শিল্পনৈপুণ্য দেখে স্বয়ং গুরুই নাকি মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তার (সৈয়দ মুক্তাসিদ) অনুপ্রেরণাতেই নাকি তিনি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। এখন আশরাফুল নিজের কিছু প্রোগ্রাম ইউটিউবে আপলোড করেন, যাতে অন্যরা তা দেখে অনুপ্রাণিত হন। গত মাসেই ‘জাগলিং’ নামের একটি কসরতের ভিডিও ইউটিউবে দিয়েছেন তিনি। এক মাসেই এর দর্শক সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানান। এতে তিনি আরও উৎসাহিত হয়েছেন। এখন নতুন কিছু কসরতের ভিডিও আপলোড করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এতে দেশে এবং বিদেশে ফুটবল ফ্রিষ্টাইলার বাড়বে বলে মনে করেন আশরাফুল। তার মতে ফুটবল কসরতও হতে পারে একটি পৃথক সম্ভাবনাময়ী ক্রীড়াশিল্প। সুযোগ বাড়লে এবং নিয়মিত প্রদর্শন ও প্রতিযোগিতা বাড়লে দেশের অনেক কিশোর ও তরুণ-তরুণী এ কাজে অংশগ্রহণ করবে এবং তারাও নিজেদের কৃতিত্ব দেখাতে পারবে। এটার জন্য আশরাফুল অনুশীলনের পাশাপাশি ফুটবল স্টাইলার তৈরিতে কাজ করার স্বপ্ন দেখেন। তার এই স্বপ্নের হাত ধরে গড়ে উঠুক ফুটবলের এই নিপুণ শিল্প।

সর্বশেষ খবর