শিরোনাম
শনিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

উপকূলের বাতিঘর উবা

♦ ‘উপকূল বাঁচলে, বাঁচবে দেশ’ স্লোগান নিয়ে ২০১২ সালে গঠিত হয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘উপকূল বাঁচাও’ আন্দোলন (উবা)। ♦ কোনো দাতা সংস্থার সহযোগিতা ছাড়াই উপকূলের ভূমিহীন, জেলে, সাধারণ মানুষের অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জলবায়ু নিয়ে কাজ করে চলেছে উবা।

জয়শ্রী ভাদুড়ী

উপকূলের বাতিঘর উবা

মাঝরাতে হঠাৎ শোঁ শোঁ শব্দ। দিগি¦দিক চূর্ণ করে ছুটে আসছে ঝড় সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। চারদিকে চিৎকার কান্নার রোল। বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে নোনা পানি। এক সময় বৃষ্টির তোড়ে খড়ের ঘরের অর্ধেক উড়ে যায় শফিকদের। পাখি যেমন ডানা দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখে ঠিক তেমনভাবে পাঁচ মেয়ে আর দুই ছেলেকে কোনো রকমে বুকে আগলে সেই রাত পাড়ি দেয় বাবা-মা। সেই ভয়াল রাত মনে দাগ কেটে যায় ছোট্ট শাহেদ শফিকের। উপকূলের জেলা নোয়াখালীর দ্বীপ হাতিয়ায় এরকম প্রতি বছরই হানা দেয় ঝড়-ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাস। প্রতিকূল প্রকৃতির সঙ্গে টিকে থাকতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করছে উপকূলের জেলাগুলোতে বসবাসকারী মানুষ। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহাণি ঘটে। মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরি এবং বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা তৈরির প্রত্যয় নিয়ে শাহেদ শফিকের নেতৃত্বে মাঠে নামে একদল যুবক। ১২ নভেম্বরকে স্মরণ করে ‘উপকূল বাঁচলে, বাঁচবে দেশ’ স্লোগান নিয়ে ২০১২ সালে তারা গঠন করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘উপকূল বাঁচাও আন্দোলন (উবা)’। স্বেচ্ছাসেবী এ সংগঠনটি সরকার, এনজিও বা কোনো দাতা সংস্থার সহযোগিতা ছাড়াই উপকূলের ভূমিহীন, জেলে, সাধারণ মানুষের অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জলবায়ু নিয়ে কাজ করে চলছে। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলের অন্তত ৩ হাজার পরিবারের মধ্যে পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছে। ৫ শতাধিক বঞ্চিত শিশুর হাতে ঈদের নতুন জামা তুলে দিয়েছেন সংগঠনের সদস্যরা। উপকূলীয় অঞ্চলের সহস্রাধিক শীতার্ত মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছে। এ মাসেই ঝড়ে ঘর হারা হয়ে খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নেওয়া নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চরচেঙ্গা গ্রামের সালাহ উদ্দিনের পরিবারকে একটি ঘর বানিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছেন উবার সদস্যরা। এর আগেও ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতে ক্ষতিগ্রস্ত বেশ কয়েকটি পরিবারকে ঘর তৈরিতে সহায়তা, জাতীয় উদ্যান নিঝুমদ্বীপের বন ও হরিণ রায় মানববন্ধন, শিশুদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, প্রতিবন্ধীদের মাঝে হুইল চেয়ার বিতরণসহ নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। অনলাইন ভিত্তিক প্রচারের মাধ্যমে ও সংগঠনের সদস্যদের ব্যক্তিগত সহযোগিতায় এই কাজগুলো করছে তারা। বাংলাদেশের এক-দশমাংশ এলাকা উপকূল। বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, পুষ্টিহীনতা, নিরাপদ পানি, পুঁজির তীব্র অভাব ও কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণসহ নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে উপকূলের জেলাগুলোতে। এসব মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই বার বার আঘাত হানে প্রকৃতি। গত ২০০ বছরে অন্তত ৬৪ বার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে উপকূলবাসী। উবার কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে সংগঠনের সভাপতি শাহেদ শফিক জানান, বর্তমানে উপকূলীয় অঞ্চল- হাতিয়া, সুবর্ণচর, নোয়াখালী, মনপুরা, ভোলা, খুলনা, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম, মহেশখালীসহ বেশ কয়েকটি উপকূলীয় জেলা ও উপজেলায় তাদের কমিটি রয়েছে। এ ছাড়া উপকূল বাঁচাও আন্দোলন (উবা) নামে ফেসবুক ভিত্তিক একটি গ্রুপও রয়েছে। এই গ্রুপে প্রতিনিয়ত উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে পোস্ট দেওয়া হয়। এ ছাড়া অসহায়দের সহায়তাসহ বিভিন্ন মানবিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয় পোস্টের মাধ্যমে। এই ফেসবুক গ্রুপের বর্তমান সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৩৫ হাজার। এই গ্রুপের অ্যাডমিনের দায়িত্বরত সদস্যরা প্রতি মাসে ৫০ টাকা করে চাঁদা দেয়। বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সময় ফান্ড সংগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, কারও হয়তো ঝড়ে ঘড় ভেঙে গেছে। প্রথমে সরেজমিন সে জায়গা পরিদর্শন করে ঘড় তৈরিতে কেমন খরচ হবে সেটার একটা হিসাব করা হয়। এরপর গ্রুপের অ্যাডমিন সদস্যরা যে যেমন পারে নিজেরা কিছু টাকা দেয় এরপর অন্য সবার কাছে বাকি সহযোগিতা চাওয়া হয়। তবে আমরা সাধারণত নগদ টাকা নেই না। চেষ্টা করি টাকার বদলে ওই ব্যক্তির ঘর তৈরির টিন বা কাঠ কিছু একটা কিনে নেওয়ার। সততা এবং স্বচ্ছতা আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য ওই ব্যক্তির ইনবক্সে দোকানের রশিদ পাঠিয়ে দিই অথবা দোকানির সঙ্গে তার একটু ফোনে কথা বলিয়ে দিই। অন্তত ওই দাতা ব্যক্তি যেন এটুকু সন্তুষ্ট হন যে আমার কষ্টের উপার্জন মানবতার কাজে লেগেছে। সদস্যরা যদি সহায়তার জন্য অর্থ দেয় তাহলে কে কত টাকা দিল তার তালিকা গ্রুপে পোস্ট দিয়ে জানানো হয়। কেউ দানের বিষয়টি গোপন রাখতে চাইলে আমরা অন্য কারও কাছে না জানিয়ে তার ইনবক্সে তালিকাটি পাঠিয়ে দিই। আমাদের এই সংগঠনে অনেক বিদেশি দাতা সংস্থা সহযোগিতা করতে চেয়েছে। কিন্তু আমরা সরকারি-বেসরকারি কারও সহযোগিতায় নেইনি। কারণ আমাদের বিশ্বাস শুধু অর্থ দিয়ে উপকূলের মানুষের অবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাদের সচেতন করতে হবে। সচেতন করে আচরণ পরিবর্তন করাই আমাদের লক্ষ্য। বর্তমানে শাহেদ শফিক উবার সভাপতি ও সারোয়ার হোসেন হৃদয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। এ ছাড়া অ্যাডমিন সদস্য হিসেবে রয়েছেন এসটি হোসাইন, ডি এইচ রাসেল, আরিফুল ইসলাম আজাদ, ডা. মো. নোমান, বখতিয়ার উদ্দিন, নাহিদা ইসলাম, ইসতিয়াক নূর, আমান খান রাফি, তুষার দে, হাসিব শান্ত, এম সাইফুল ইসলাম, টিএম রাকিবুল ইসলাম, রাজিব হোসাইন রাজু, মিসু সাহা নিক্কন, এসএম রুবেল, শাহেদ গনি, তানিসা  চৌধুরীসহ অনেকেই।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর