ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেলেও তার শিকড়টা বাংলাদেশেই। নিজেকে বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন অপু। আর ভ্রমণপ্রিয় মানুষ হিসেবে পৃথিবীর নানা প্রান্তে এঁকেছেন নিজের পদচিহ্ন। একেক দেশের মানুষের জীবন, সংস্কৃতি আর ইতিহাস একেক রকম। সেই বৈচিত্র্য থেকে একজন মানুষ যে জ্ঞান আর আনন্দ পেতে পারে সেটি অন্য কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ৬৫ দেশের ৬৫০টি শহর ঘুরে বেড়ানো তানভীর এসেছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনে। জানিয়েছেন তার ঘুরে বেড়ানোর গল্প।
‘বিচিত্র জীবন। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় এসে দাঁড়াই চার রাস্তার মোড়ে! একেকটি রাস্তার গন্তব্য একেক দেশে। অনেক স্বপ্নের জাল বোনা মিসরের মিথ আর পিরামিডকে পেছনে ফেলে এবার আরও এক নতুনের উদ্দেশ্যে যাত্রা। এবার যাব ফিলিস্তিনে...।’
ভ্রমণপিয়াসী। বাংলায় আরও ভালো শব্দ পরিব্রাজক। এই আধুনিক পরিব্রাজকের মুখে চেনা-অচেনা সব শহরের গল্পগুলোই অসাধারণ। ছোটবেলা থেকেই তানভীর অপুর অ™ভুত একটা বাতিক ছিল। টাকা জোগাড় হতেই বেরিয়ে পড়তেন ঘুরতে। বড়বেলায় ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতাটা বড় হবে এটাই স্বাভাবিক। আর সেই সময়টায় তানভীর যখন ফিনল্যান্ডে বসবাস করতে শুরু করলেন তখনই তার আসল পর্যটক জীবনের শুরু। সেখান থেকে এস্তোনিয়া, সুইডেনের পথে পথে ঘুরে তানভীরের পর্যটক মনের ক্ষুধা গেল বেড়ে। তিনি আরও নতুন নতুন দেশ আর শহরে ঘুরে বেড়ানোর পরিকল্পনা করতে লাগলেন। কিন্তু এত ভ্রমণ সময় এবং ব্যয়সাপেক্ষ বিষয়। সেটাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন তানভীর? ‘দেখুন আপনি ঘুরতে ভালোবাসলে সময় আর অর্থ কোনোটাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। ঘুরতে ভীষণ ভালোবাসি। ভ্রমণের জন্য মনের ইচ্ছাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি, অর্থ নয়। আমার ভ্রমণব্যয় একেবারেই সামান্য। কারণ আমি আমার ভ্রমণটাকে নিজের সামর্থ্য মতো সাজিয়ে নিই। আমি সস্তা হোটেলে রাত কাটাই, সস্তা খাবার খাই, প্রচুর হাঁটি। যতটা সম্ভব খুচরো পথে যানবাহন এড়িয়ে চলি। নতুন একটা শহরে হেঁটে হেঁটে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলি। জীবন সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। তখনই আসলে ভ্রমণের সত্যিকার আনন্দটা খুঁজে পাওয়া যায়।’খুব সহজভাবে ভ্রমণের সূত্রটা বলে দিলেন ৩৮ বছর বয়সী এই তরুণ।
বাংলাদেশে তানভীরের বেড়ে ওঠা রাজশাহীতে। বাবা ইব্রাহীম আলী দেওয়ান ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক। মা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকাও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরে ছিলেন। দুই ভাই, এক বোনের মধ্যে তানভীর সবার বড়। অষ্টম শ্রেণি পাসের পর তানভীর বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলেন। হকি খেলেছেন বিকেএসপি, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের হয়ে। এরপর আবার ফেরেন রাজশাহীতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ার সময়টাতেই অপু পাড়ি জমান ফিনল্যান্ডে।
অপুর ভাষায়- ‘ঠিক প্ল্যান করে পরিব্রাজক হইনি। আসলে যখন শুরু করি তখনো জানতাম না যে এত দেশ আর এত এত শহর ঘুরব। তবে মনের ভিতর বিশ্ব ঘুরে দেখার একটা সুপ্ত আকাক্সক্ষা ঠিকই ছিল। সেই আকাক্সক্ষাটাই আমাকে পরিব্রাজক বানিয়েছে।’
ফিনল্যান্ডের নাগরিকত্ব পেলেও সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে ছুটে আসেন অপু। দেশের প্রতি যে অকৃত্রিম টান, সেটাকে কখনই খাটো করে দেখেন না তিনি। কথা হচ্ছিল জীবন বোধ নিয়ে। স্বভাবসুলভ সরল ভঙ্গিতে তানভীর বললেন, ‘জীবন নিয়ে আমার গভীর কোনো বোধ নেই। আমি কেবল জীবনকে উদযাপন করতে চাই। আমি যখন কোনো দেশে যাই কিংবা কোনো শহরে যাই তখন সেখানকার মানুষ দেখে আমি আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করি। মানুষের টাকা-পয়সা ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা কিংবা জীবন দর্শন চিরস্থায়ী। এটা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।’
তানভীর বিশ্বাস করেন মানুষের দুর্নিবার আকাক্সক্ষা কেবল ভ্রমণই নয়, যে কোনো অসাধ্যকেই সাধন করতে পারে। আর ঘুরে বেড়ালে মানুষের মন উদার হয়। জীবন বোধের পরিবর্তন হয়। এসব বোধ ভাবনা আর মানুষের জীবন ও শহর নিয়ে তানভীর ছবি তুলেছেন অসংখ্য। সেগুলো একসঙ্গে করে বইয়ের মোড়কে আবদ্ধ করতে চান। নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলিটা খুলে দিতে চান সবার জন্য। সবার কাছে তুলে ধরতে চান বাংলাদেশি এক পরিব্রাজকের অনিঃশ্বেষ গল্প। এর মধ্যে একটি বই বেরও হয়েছে। এখানটায় তিনি সফল হবেন- আমাদের প্রত্যাশা এমনই।
ছবির গল্প
বিশ্বের অন্যতম আলোচিত প্রাচীর এটি। জার্মানির বার্লিনে অবস্থিত এই ‘বার্লিন প্রাচীর’। ইতিহাসে পরিচিত হয়ে আছে পশ্চিম বার্লিন ও পূর্ব বার্লিনের সীমানা প্রাচীর হিসেবে, যেটি পশ্চিম জার্মানি ও পূর্ব জার্মানির একটি সীমানা ছিল। ১৩ আগস্ট, ১৯৬১ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২৮ বছর এটি পশ্চিম বার্লিন থেকে পূর্ব বার্লিন এবং পূর্ব জার্মানির অন্যান্য অংশকে পৃথক করে রেখেছিল।
ইতিহাস কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘জেনারেল শারম্যান ট্রি’। এই গাছের মাথা খুঁজে পাওয়া যায় না। জাঁদরেল, বয়সী আর আকাশছোঁয়া এ বৃক্ষের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া সিকোয়া ন্যাশনাল পার্কে। পৃৃথিবীর সবচেয়ে বড় গাছ এটি। উচ্চতা ২৭৫ ফুট, অর্থাৎ প্রায় ৩০ তলা ভবনের সমান উঁচু। এই গাছের গুঁড়ির পরিধি প্রায় ১০৯ ফুট, ব্যাস প্রায় ৩৭ ফুট। বয়স আনুমানিক ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ বছর।
স্পেস মিউজিয়াম, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম আকর্ষণীয় একটি স্থান। এখানে রয়েছে বিজ্ঞান কিংবা মহাকাশ সংশ্লিষ্ট নানা উপকরণ। যেমন এই ছবিটি এ্যাপোলো ১১ একটি অংশ। এই যান করেই চাঁদের বুকে পা রেখেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং।
পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের শেষ শহর। নাম হেমারফেস্ট। নরওয়ের একটি প্রাচীন শহর এটি। এখানে বছরের একটা সময় তিমি শিকারিদের আনাগোনা বেশি দেখা যায়।
ছবিটি বেথলেহেম শহরের। দ্য নেটিভিটি অ্যান্ড পিলগিমেজ রট চার্চ। যেখানে যিশুর জন্ম। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৯ সালে এই গির্জার প্রতিষ্ঠা। যদিও এর অনেক পরে ষষ্ঠ দশকে অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হওয়ার পর পুনঃসংস্কার করা হয়। তা সত্ত্বেও ইতিহাসের সব চিহ্ন বেঁচে আছে সগৌরবে। সে জন্যই এই গির্জা এখনো ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। গির্জার কাছাকাছি যেতেই প্রথমে চোখে পড়ে মসজিদ। এটি মসজিদে ওমর নামে পরিচিত। পাশাপাশি চার্চ আর মসজিদ! এক জায়গায় যিশুর জন্ম আর ঠিক পাশেই আছে মসজিদ। এতে কারও কোনো সমস্যা বা আপত্তি নেই! যে যার মতো ধর্ম পালন করে চলছে।