শনিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

সাড়ে তিন শ সাইকেল বালিকার স্কুল

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

সাড়ে তিন শ সাইকেল বালিকার স্কুল

পিচঢালা কোনো সড়ক নেই নিশিন্দার পাড় গ্রামে। পুরোটাই আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু মেঠোপথ। এই পথ দিয়েই প্রতিদিন দ্বি-চক্র বাহন নিয়ে ছুটছে একদল বালিকা। চোখে তাদের রাজ্যের স্বপ্ন। মনে আত্মবিশ্বাস। পরনে গাঢ় আকাশি ও সাদা রঙের স্কুল ড্রেস। বলছিলাম ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার কালাদহ ইউনিয়নের শিবরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে আসা প্রায় ৩৫০ ‘সাইকেল বালিকাদের’ কথা। স্কুলটি এখন ‘সাইকেল বালিকাদের স্কুল’ নামেও পরিচিত।

কাঁধে বইয়ের ব্যাগ আর মুখে অমলিন হাসি নিয়ে বাইসাইকেলে প্যাডেল মেরে ঝাঁকে ঝাঁকে কিশোরী এক থেকে পাঁচ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে স্কুলে পৌঁছায়। প্রখর রোদ অথবা বৃষ্টি কিংবা তীব্র শীত কোনোটাই স্কুলে আসা-যাওয়া থেকে দমিয়ে রাখতে পারে না এসব দুরন্ত ‘সাইকেল বালিকাকে’। সব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে শিবরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের মেয়েরা।

নিজেদের অজান্তেই এই মেয়েরা এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে পুরনো চিন্তা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। মেয়েদের শিক্ষিত হওয়ার এ লড়াই-সংগ্রামের নেপথ্যে থেকে উৎসাহ দিয়ে চলছেন শিবরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। শুধু মেয়েদের সাহসী করাই নয়, লেখাপড়াতেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে প্রত্যন্ত গ্রামের এ আলোর বাতিঘরটি। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফলে ব্যাপক সফলতা রয়েছে বিদ্যালয়টির। গত পাঁচ বছরে এই স্কুলটি থেকে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় ১৫১ জন জিপিএ ৫ ও ৯৮ শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পায়।

 

স্কুল পরিচিতি

ফুলবাড়িয়া উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম শিবরামপুর। এ গ্রামেই ১৯৬৭ সালে মরহুম নিরাজ আলী সরকার ও মৌলভি ওয়াহেদ আলী প্রতিষ্ঠা করেন ‘শিবরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়’। ৩.৭২ শতাংশ জমির ওপর এখন দাঁড়িয়ে এই শিক্ষাঙ্গন। চারদিকে সবুজে ঘেরা, রয়েছে বিশাল খেলার মাঠ। শিক্ষার্থীর সংখ্যা রয়েছে ৬৫০। তার মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫০। বিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি বালিকা বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসে যায়। এ ছাড়াও ছেলেরাও সাইকেল নিয়ে যাতায়াত করে বিদ্যালয়টিতে। বর্তমানে এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার আলোয় আলোকিত গোটা গ্রাম। পাঠ্য বইয়ের শিক্ষার পাশাপাশি ভ্রাতৃত্ববোধসহ নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে বিদ্যালয়টিতে।

 

বাইসাইকেল যাত্রা যেভাবে শুরু

নাম দীপা দেবনাথ। সময়টা ২০০৬। দীপা তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া। বাড়ি থেকে প্রিয় প্রতিষ্ঠানটির দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। রিকশা অথবা ভ্যানে চেপে যেতে যেতে সঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছানো অনেকটা দুষ্কর ছিল। বড় ভাইয়ের সাইকেলটি দেখে তারও মনে হয় সেও সাইকেল চেপে স্কুলে যেতে পারে। বাইসাইকেলের জন্য আবদার করেন দাদু সুরেন্দ্র চন্দ্র দেবনাথের কাছে। তবে প্রথমে তিনি সাইকেল কিনে দিতে অস্বীকার করলেও পরে ঠিকই কিনে দেন। সেই থেকে শুরু। পরে তার দলে ধীরে ধীরে যোগ হয় ঝরা, স্মৃতি, আকলিমা, সুইটিসহ পাঁচ থেকে সাত বান্ধবী। এখন এর সংখ্যা প্রায় ৩৫০। আর আলোক বাতি দীপা দেবনাথ এখন রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্রী। পরবর্তীতে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষকরা অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন এ বিদ্যালয়ে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসবে। প্রথমদিকে অনেক অভিভাবক এ সিদ্ধান্তের বিরোধী ছিলেন। মেয়েদের সাইকেল যাত্রা দেখে বখাটেরা হাসিঠাট্টাও করত। সব উপেক্ষা করে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসা অব্যাহত রাখে মেয়েরা।

 তৈরি হয়েছে অনেক দীপা

এক দীপা দেবনাথকে অনুকরণ করে দেশের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিবরামপুর বিদ্যালয়ের মেয়েরা পড়াশোনা করছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী আফসানা ইয়াসমিন সুইটি ও চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আফরিনা ইয়াসমিন সুমা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফারজানা ইয়াসমিন শিফাও একসময় ওই স্কুলের ‘সাইকেল বালিকা ছিলেন’।

 

অভিভাবকদের কথা

বাইসাইকেলে চেপে স্কুলে আসার সুফল পাচ্ছে শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা। একদিকে মেয়েরা যেমন সময়মতো স্কুলে যাওয়া আসা করতে পারে, অপরদিকে যানবাহনের জন্য রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। এখন শিবরামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে মেয়েরা ভর্তি হলেই অভিভাবকরা তাদের বাইসাইকেল কিনে দেন যাতায়াতের জন্য। এতে করে স্কুলে আসতে সময় কম লাগছে, সঠিক সময়ে স্কুলে পৌঁছাতে পারছে। যানবাহনের জন্য রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না, যাতায়াতের খরচও লাগছে না। এমন মন্তব্য ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া সাদিয়া আফরিন স্মৃতির বাবা আবদুল মোতালেবের।

 

প্রধান শিক্ষকের বয়ান

প্রধান শিক্ষক আফসার আলী বলেন, একসময় মেয়েদের প্রতি পরিবারের একটা বিরূপ আচরণ ছিল। এখন আর তা নেই। মেয়েদের সফলতাই তাদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এখন ৯৫ ভাগ মেয়েই সাইকেল নিয়ে স্কুলে আসে। তবে শুরুর দিকে এলাকার ছেলেরা নানাভাবে উক্ত্যক্ত করত। বিষয়গুলো শিক্ষকরা অভিভাবকদের নিয়ে প্রতিবাদ করায় ধীরে ধীরে এসব বন্ধ হয়ে যায়। আমারও তিন মেয়ের মধ্যে দুজন বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করেছে, তারা দুজনেই এখন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আর ছোট মেয়েটি এই স্কুলেই ৮ম শ্রেণিতে পড়ে। তবে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মানুষ গড়ার কারিগর আফসার আলী জানান, বিদ্যালয়ে ২০ থেকে ২৫ জন মেয়ে আছে যাদের পরিবার একেবারে অসচ্ছল। পরিবারের ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাইসাইকেল কিনে দিতে পারছেন না।

সর্বশেষ খবর