শনিবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা
ভ্রমণ

ধাঁধার চরের রূপ অবগাহনে সারাবেলা

মনির হোসেন

ধাঁধার চরের রূপ অবগাহনে সারাবেলা

পৃথিবীর মানচিত্রে নদীমাতৃক দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ। নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এখানকার মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী বাজার, গ্রাম, গঞ্জ ও শহর। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রায় সহস্রাধিক ছোট-বড় নদ-নদী-উপনদী-শাখানদী। এগুলোর একটি হলো শীতলক্ষ্যা নদী। কথিত আছে, বাংলাদেশকে প্রায় আড়াই প্যাঁচে আবৃত করে আছে ব্রহ্মপুত্র নদ। বাংলাদেশের দীর্ঘতম এই ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখা নদী হলো শীতলক্ষ্যা। গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার সাত-আট কিলোমিটার পূর্ব দিয়ে দক্ষিণমুখী হয়ে কাপাসিয়া উপজেলা শহরের মধ্য দিয়ে কালীগঞ্জ, রূপগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদরে ধলেশ্বরী নদীতে মিলিত হয়েছে ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ শীতলক্ষ্যা। এ নদীর খ্যাতি পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানির জন্য। আর এ নদীর বুকেই জেগে উঠেছে নৌকা আকৃতির এক বিশাল চর। নাম তার ধাঁধার চর। আনুমানিক ২০০ বছর আগে জেগে ওঠা চরকে অনেকে বলেন মাঝের চর। কারণ চরটি লাখপুর, তারাগঞ্জ, রানীগঞ্জ ও চরসিন্দুরের মাঝখানে অবস্থিত।

ধাঁধার চরের ধাঁধা লাগানো রূপ অবগাহনে ভ্রমণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় নদী পরিব্রাজক দল। ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া হয় ‘ফিরে চলো নদীর টানে’, গন্তব্য এবার ধাঁধার চরে । বিস্ময়কর ব্যাপার হলো নদী পরিব্রাজক দলের সদস্য ও শুভাকাক্সক্ষী ১১৫ জন নাম নিবন্ধন করে এই ভ্রমণের জন্য। পরে বুঝতে পারলাম দিনটি ছুটির দিন ও ভ্রমণ স্থানটি ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় এত হাতছানি। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। কাক ডাকা ভোরে যাত্রা শুরু করলাম ধাঁধার চরের উদ্দেশ্যে। দুপুরের আগেই আমরা পৌঁছে গেলাম ধাঁধার চরে। কথা বললাম চরের চাষি আর বেড়াতে আসা মানুষের সঙ্গে। জানলাম শীতলক্ষ্যা নদী আর ধাঁধার চরের সমৃদ্ধ ইতিহাসের কথা। দুই নয়ন ভরে দেখলাম ধাঁধার চরের মনলোভা সব দৃশ্য। আর শীতলক্ষ্যা নদীর বুকে জেগে উঠা এ চরটির আয়তন প্রায় আড়াইশ একর। দূর থেকে দেখলে এ চরটিকে অনেকটা সেন্ট মার্টিনসের মতো মনে হয়। আবার পুরো ভিউটা একসঙ্গে দেখলে মনে হয় টাইটানিক জাহাজ। ধাঁধার চরের অবস্থানটাও বেশ ধাঁধা লাগানো। চরের উত্তর-দক্ষিণে শীতলক্ষ্যা নদী, আর পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদ। দুইদিকে দুই থানা কাপাসিয়া ও শিবপুর। আর আছে দুই পাশে দুই জেলা গাজীপুর ও নরসিংদী। বর্ষা মৌসুমে দুইটি নদীই থাকে গর্ভবতী, জলে টইটম্বুর। আর শীতকালে এটি হয়ে ওঠে আরও মনোরম, আরও মনোলোভা। স্থানীয় তারাগঞ্জ, লাখপুর, রানীগঞ্জ ও চরসিন্দুরের মাঝখানে এ চরকে দেখলে মনে হয় ভাসমান টাইটানিক গ্রাম। এটি ব্রহ্মপুত্র নদ ও শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। এক সময় এই চরের নাম-নিশানা ছিল না। ছিল বহমান নদী। তারপর আস্তে আস্তে বিন্দু বিন্দু বালুকণা জমতে জমতে বেলে মাটিতে পূর্ণ হয়ে এক সময় যখন চর জেগে ওঠে, তখন স্থানীয় লোকজন এটি দেখে ধাঁধায় পড়ে যান। সেই থেকে এর নাম ধাঁধার চর।

এই চরের ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয়। জেগে ওঠা চরের মালিকানা নিয়ে ভাওয়ালের রাজা এবং বার ভূঁইয়াদের এক ভূঁইয়া মহেষ উদ্দীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। শেষে মালিকানা পেয়ে যান ভাওয়ালের রাজা। তারপর স্থানীয় হিন্দু কৃষকরা ভাওয়ালের রাজাকে খাজনা দিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। চরের মাটি খুবই উর্বর। এখানে রোপণ করলে হয় না, এমন কোনো ফল-ফসল বাংলাদেশে নেই। এক সময় চরে প্রচুর আখ হতো। এখন সবচেয়ে বেশি আলুর চাষাবাদ হয়। চরের মাটির তলে বা মাটির ওপরে যা রোপণ করা হোক না কেন তা অতিফলনশীল এবং তা সারবিহীন ও সুস্বাদু। ১৯৬০, ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালের বন্যায় চর তলিয়ে গিয়েছিল। ১৯৬০ সালের বন্যার পর চরে কোমর পর্যন্ত পানি জমে ওঠে। ফলে মাটির উর্বরাশক্তি আরও বাড়তে থাকে। এসব না জানা তথ্য জানালেন স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ এলাকাবাসী।

দুপুরের আগেই চরের ডান পাশের নদীতে ও তীরে দেখা মেলে নাম জানা না জানা প্রায় ১০ প্রজাতি অতিথি পাখির। এর মধ্যে শামুকখোলও ছিল। আর চরের ভিতরে গাছ-গাছালিতে বিভিন্ন ধরনের দেশি পাখি তো ছিলই। তবে ঘুঘু পাখির প্রাচুর্য চোখে পড়ার মতো। তাছাড়া চরে দেখা যায় গোসাপ ও কাঠবিড়ালী।

বিকালের চরটি বড়ই মনোরম। ঝিরঝিরে বাতাস। উড়ন্ত পাখির কলকাকলি। মাঝির আকুল করা গান। চরের বুক দিয়ে হাঁটলে কল্পনা করা যাবে না এটি একটি চর- যার দুইপাশে রাক্ষুসে দুই নদী। মনে হবে মাসি-পিসির ঘুম পাড়ানো শান্ত-স্নিগ্ধ একটি গ্রাম। ধাঁধার চর দেখতে আসেন ভ্রমণপিপাসুরা দূর-দূরান্ত থেকে। এই চরকে যদি পর্যটন করপোরেশনের আওতায় আনা হয়, তাহলে পর্যটকরা এটি দেখে মুগ্ধ হবেন। আর সরকারের তহবিলে জমা পড়বে বিপুল অংকের রাজস্ব। সত্যিকার অর্থেই এটি দেখার মতো একটা জায়গা। এখানকার নৌকা দিয়ে চরের চারপাশ ভ্রমণ, চরে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে পেয়ারা বাগান, কলা বাগান, সারি সারি তাল গাছ, জাম গাছ, কুল বাগান ও নানা প্রজাতির অসংখ্য ঔষধি গাছ দেখতে পাবেন। পাশেই নদীতে থৈ থৈ জলরাশি। ওপরে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা আকাশ। মাছরাঙা পাখির হুটহাট জলচুম্বন, পানকৌড়ির লুকোচুরি। ভাগ্য ভালো থাকলে দেখতে পাবেন ঘোমটা দেওয়া শুশুক বা গাঙ্গেয় ডলফিন। জলের সাদা ফেনা থেকে আছাড় খাচ্ছে প্রায় আড়াইশ একর জমি নিয়ে গভীর জলের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ধাঁধার চরের বুক। চরটির পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বটতলায় আছে ঐতিহাসিক ঘিঘাট। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন অষ্টমী তিথিতে এ ঘাটে পুণ্যস্নান করেন। এটি চলে আসছে সেই ভাওয়াল রাজার আমল থেকে এবং তা এখনো চলছে। এ চরটিকে শুটিং স্পট হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে বহুবার। শাবনাজ-নাঈম অভিনীতি বিষের বাঁশি চলচ্চিত্রটির অধিকাংশ দৃশ্য এখানেই ধারণ করা হয়। এ চরটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করেছে। আশা করি আপনাকেও মুগ্ধ করবে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। তাই তো চরের লম্বা গাছগুলো পাতা নেড়ে সন্ধ্যাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। টকটকে লাল সূর্য শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্রের গভীরে রাতের জন্য ঘুমাতে যাচ্ছে। আর মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাদেরও বাড়ি ফেরার সময় হয়েছে। মুসাফির মুছরে আঁখি ফিরে চল বাড়ির টানে।

ভ্রমণ টিপস :  চরে অনেক শাক-সবজি ও ফলের বাগান রয়েছে। প্রচুর গাছপালা ও পাখির মিলন মেলা। এদের অনিষ্ট হয় এমন কিছু করা যাবে না। এ চরে দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

 

কীভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে কাপাসিয়া। সময় লাগবে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা। এখান থেকে বাস বা সিএনজিতে সোজা রানীগঞ্জ চলে এলেই দেখা যাবে দুই নদীর বুকে ভাসছে অদ্ভুত ধাঁধা লাগানো চর ধাঁধার চর। তাছাড়া রেলপথে জয়দেবপুর স্টেশনে নেমে, জয়দেবপুর থেকে সিএনজি করে রানীগঞ্জ যাওয়া যায়। এমনকি কাঞ্চন ব্রিজ থেকে বোট রিজার্ভ করে চলে যেতে পারেন ওই চরে। ভাড়া আনুমানিক ৭০০০ টাকা আসা-যাওয়া।

 

কোথায় থাকবেন

ঢাকার খুব কাছে; তাই দিনে দিনেই ভ্রমণ শেষ করতে পারবেন। তার পরও যারা থাকতে চান তাদের জন্য গাজীপুর জেলা শহর ও কাপাসিয়া উপজেলা সদরে কম খরচে হোটেলে থাকার সুব্যবস্থা আছে। এ ছাড়াও আধুনিক সুবিধার অনেক কটেজ রয়েছে যা ৭,০০০-১৬,০০০ টাকা।

সর্বশেষ খবর