শনিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

ছত্রিশেই প্রধান কার্ডিয়াক সার্জন

ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম : কার্ডিয়াক সার্জন

তানভীর আহমেদ

ছত্রিশেই প্রধান কার্ডিয়াক সার্জন

২০০৫ সাল। বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন আশ্রাফুল হক সিয়াম। এরপর এমএস করার জন্য বেছে নেন কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থোরাসিক সার্জারি। ২০১৬ সালে এমএস শেষ করে কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে যখন তিনি চিকিৎসা ক্যারিয়ার শুরু করেন তখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ। ২৬তম ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব থোরাসিক অ্যান্ড কার্ডিওভাসকুলার সার্জনস অব এশিয়া’ কনফারেন্সে সবচেয়ে তরুণ কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে স্বীকৃতি স্বরূপ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সম্মাননা পান। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের আবাসিক সার্জন হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। সেখানেই তিনি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের ইউনিট-৯ এর চিফ বা প্রধান হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন শুরু করেন আগস্ট, ২০১৭ থেকে তখন তার বয়স ছত্রিশ। কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে ইউনিট চিফ বা প্রধান হওয়া অত্যন্ত সম্মানের। ডা. আশ্রাফুল হক সিয়াম বলেন, ‘কার্ডিয়াক সার্জারি অত্যন্ত জটিল একটি বিষয় যা একটি টিম ওয়ার্ক। বাইপাস সার্জারি, ভাল্ব সার্জারি, হৃৎপি-ের জন্মগত ত্রুটিসহ অনেক জটিল অপারেশন করার জন্য দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, ধৈর্য এবং মেধার প্রয়োজন। এ জন্য একজন কার্ডিয়াক সার্জন ইউনিট চিফ হতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বয়স ৪৫ বছর ছুঁয়ে ফেলেন।’ বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২০ জনের মতো চিফ কার্ডিয়াক সার্জন / ইউনিট চিফ রয়েছেন। তরুণ বয়সে আশ্রাফুল হক সিয়ামের এই এগিয়ে চলা বেশ আলোচিত। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি ইতিহাস বলা যায়। দেশে তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়াতেও এত তরুণ বয়সে কার্ডিয়াক সার্জন চিফ হওয়ার নজির বিরল।

শরীয়তপুরে বাড়ি আশ্রাফুল হক সিয়ামের। বাবা প্রকৌশলী মো. আবুল হাসেম মিয়া। মা বেগম আশ্রাফুন্নেসা রত্নগর্ভা স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ২০০৪ সালে। পরিবারে রয়েছে তিন ভাই ও এক বোন। বড় ভাই এ কে এম এনামুল হক শামীম, বাংলাদেশ সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মেঝো ভাই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমিন সেনাবাহিনীতে কর্মরত। একমাত্র বোন শামীম আরা হক কাকলী ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে একটি বেসরকারী ব্যাংকে কর্মরত। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন তার চোখে বসিয়েছেন তার মা। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন। মা বরাবরই প্রেরণা জোগাতেন ডাক্তার হওয়ার জন্য। মায়ের প্রেরণা আর স্বপ্নপূরণের চেষ্টায় পরিশ্রম করেছেন তিনি। ঢাকার খিলগাঁও সরকারি স্কুল থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এরপর এমবিবিএস পড়া অবস্থায় ২০০২-২০০৪ এর দিকে যখন দেখেন এদেশে মাত্র বাইপাস সার্জারি স্বল্প পরিসরে শুরু হয়েছে এবং দেশের বেশিরভাগ মানুষই এই রোগের চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন তখন থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেন একজন কার্ডিয়াক সার্জন হয়ে দেশের মানুষের সেবা করার। এমবিবিএস শেষ করার পর তিনি ল্যাবএইড হাসপাতালের প্রধান কার্ডিয়াক সার্জন ডা. লুতফর রহমানের তত্ত্বাবধানে তিন বছর কাজ করেন। এরপর ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক ও প্রধান কার্ডিয়াক সার্জন ডা. ফারুক আহমেদের সঙ্গেও কাজ করেন। ইতিমধ্যে কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে ক্যারিয়ার গড়তে এমএস ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড থোরাসিক সার্জারিতে এমএস শেষ করে কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে কাজ শুরু করেন। হৃদরোগের জটিল সার্জারিতে দারুণ সফল এই তরুণ চিকিৎসক। পুরো ক্যারিয়ারে ৫০০-এর বেশি কার্ডিয়াক সার্জারিতে অংশগ্রহণ করেছেন। ২০১৮ সালে ১১০টি সার্জারি করেছেন, যার মধ্যে মৃত্যুহার ছিল মাত্র ৩.৪ শতাংশ এবং যা পৃথিবীর আন্তর্জাতিক সেমিনারে উপস্থাপিত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মানদন্ডে তার সফল সার্জারি সবার কাছেই প্রশংসিত হয়েছে। তরুণ বয়সী এই সার্জন বলেন, ‘কার্ডিয়াক সার্জারি বেশ জটিল। ভুলের কোনো সুযোগ নেই। আমাদের দেশে কার্ডিয়াক সার্জারি করার উপযোগী হাসপাতালও বেশি নেই। এসব কারণে কার্ডিয়াক সার্জনরা এ ধরনের সার্জারি করার সুযোগ পান না। প্র্যাকটিসের অভাব থেকে কনফিডেন্সও কমে আসে সার্জনদের। আমাদের দেশে কার্ডিয়াক সার্জনের সংখ্যা ২০০-এর ওপরে কিন্তু চিফ সার্জন অনেক কম। আমি তরুণ বয়সেই চিফ কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে কাজ করছি, এটা সত্যি সম্মানের।’

তার দক্ষতা ও সফলতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে বাংলাদেশের কার্ডিয়াক সার্জনদের একমাত্র নিবন্ধিত সংগঠন ‘কার্ডিয়াক সার্জন্স সোসাইটি অব বাংলাদেশ’-এর জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত করা হয়। এখন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে সহকারী অধ্যাপক ও আবাসিক সার্জন হিসেবে কাজ করছেন তিনি। ভাল্ব রিপেয়ার, মিনিমাল ইনভেসিভ সার্জারি ও হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে কাজ করার আগ্রহ রয়েছে তার। যদিও বাংলাদেশে এখনো সে সুযোগ তৈরি হয়নি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন আন্তর্জাতিক মানের কার্ডিয়াক সার্জারি হচ্ছে। এখানে সাফল্যের হার আন্তর্জাতিক মানদন্ডে প্রশংসনীয়। সরকারি হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা ব্যয় সহনীয় হলেও প্রাইভেট হাসপাতালে বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। এ ছাড়া হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতালেই কেবল কার্ডিয়াক সার্জারি করার প্রয়োজনীয় উপকরণ ও জনবল রয়েছে।’

আন্তর্জাতিক ও বিভিন্ন করপোরেট হাসপাতালে কাজ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আশ্রাফুল হক সিয়াম সরকারি হাসপাতালে কর্মরত থেকে  দেশের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত রোগীদের জন্য স্বল্প খরচে চিকিৎসাসেবার ব্রত নিয়েছেন। ছুটির দিনে তিনি গ্রামাঞ্চলে ছুটে যান, মেডিকেল ক্যাম্প করেন। মানুষের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে তিনি এ ধরনের সেমিনার ও মেডিকেল ক্যাম্প করেন। তিনি বলেন,  ‘হৃদরোগ জন্মগত কারণে যেমন হয় তেমন খাদ্যাভ্যাস, জীবনাচারের জন্যও হয়। সচেতন থাকলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য মানুষকে জানতে হবে হৃদরোগের কারণ ও লক্ষণগুলো। সেমিনার করে আমি মানুষকে সচেতন করার কাজটি করে যাচ্ছি। শহর-গ্রাম সর্বত্র ছুটে যাচ্ছি।’

তরুণ বয়সে দেশে-বিদেশে সবচেয়ে সফল চিফ কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে তিনি বেশ কয়েকটি সম্মাননা লাভ করেছেন। আন্তর্জাতিক চিকিৎসাবিষয়ক জার্নালেও তার লেখা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে। অংশগ্রহণ করেছেন কার্ডিয়াক সার্জনদের আন্তর্জাতিক সভা-সম্মেলনে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় আন্তর্জাতিক চিকিৎসক সম্মেলনে তার অংশগ্রহণ বাংলাদেশের সুনাম বয়ে এনেছে। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জন অধ্যাপক ডা. মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘আশ্রাফুল হক সিয়াম মাত্র ছত্রিশেই চিফ কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে দেশ-বিদেশে আলোচিত হয়েছেন। গত বছর তিনি ১১০টি কার্ডিয়াক সার্জারি করেছেন, যেখানে মৃত্যুহার ছিল মাত্র ৩.৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এটি সত্যিই প্রশংসনীয়। জটিল কার্ডিয়াক সার্জারিতে তার সাফল্য সবার জন্যই অনুপ্রেরণীয়। তরুণ বয়সেই চিফ কার্ডিয়াক সার্জন হিসেবে তার এ সফল পথচলা সবার জন্যই এক আদর্শ।’ বর্তমানে তার স্বপ্ন রয়েছে কার্ডিয়াক সার্জারির ব্যাপ্তি আরও প্রসারিত করে মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া; যার মধ্যে রয়েছে তরুণ চিকিৎসকদের আরও দক্ষ ও অভিজ্ঞ করে তোলার জন্য দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ পর্যায়ে কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের সঙ্গে কাজ করা। কার্ডিয়াক সার্জনদের জন্য নতুন পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অধিকসংখ্যক সার্জনকে সরকারি পর্যায়ে সেবাদানের সুযোগ করে দেওয়া। সহযোগী অধ্যাপক ডা. কাজী আবুল আজাদসহ অন্য সহকর্মী যারা তাকে সহযোগিতা করেছেন সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি।

সর্বশেষ খবর