শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

গাড়ির রাজ্য মাহিন্দ্রা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

গাড়ির রাজ্য মাহিন্দ্রা

বান্দ্রা, মুম্বাই। আরব সাগরের তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা হোটেল তাজ ল্যান্ডস অ্যান্ড থেকে সকাল সাড়ে ৬টার দিকে রওনা দিলাম পুনের উদ্দেশ্যে। শহুরে ইমারত আর সমুদ্রের গর্জনকে পেছনে ফেলে যতই এগোচ্ছি ততই স্পষ্ট হতে থাকে উঁচু উঁচু পর্বত। দুই পাশে পাথুরে পাহাড় আর আঁকাবাঁকা হাইওয়ে ধরে যেতে যেতে মনে হলো পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর সড়ক আর নেই। প্রায় চার ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে বেলা ১১টার দিকে পৌঁছালাম পুনের চাকানে। এখানেই ৭০০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে ভারতের বিখ্যাত অটোমোবাইল কোম্পানির কারখানা মাহিন্দ্রা ভেহিক্যাল ম্যানুফাকচারার্স লিমিটেড। গাড়ির জানালা দিয়ে কারখানার প্রবেশপথে চোখ রাখতেই স্বাগত জানাল নানা রঙের ফুল। প্রকৃতির এই ফুলেল অভ্যর্থনা পার হতেই আঙ্গিনাজুড়ে চোখে পড়ল শত শত গাড়ির সারি। জানা গেল, কারখানায় নির্মিত গাড়িগুলো ডেলিভারির জন্য দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে এখানে। কর্মকর্তারা জানালেন, এখানে প্রতিদিন প্রায় ৭০০ গাড়ি তৈরি হয়। অর্থাৎ প্রায় দুই মিনিটে একটি গাড়ি নির্মিত হচ্ছে কারখানাটিতে। জানা গেল, ২০০৭ সালে কারখানাটি গড়ে তোলার জন্য সরকারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে এটি পুরোপুরি উৎপাদনে যায়। বর্তমান সক্ষমতায় এই কারখানা থেকে বছরে ৩ লাখের বেশি যানবাহন তৈরি হয়, যার মধ্যে ট্রাক, জিপ, প্রাইভেটকার ও ট্রাক্টর উল্লেখযোগ্য। সর্বোচ্চ মানের ম্যানুফ্যাকচারিং প্রযুক্তি, প্রায়োগিক দক্ষতা, নির্মল পরিবেশ ধরে রাখা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। আরও জানা গেল, প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার দূরে পুনের এই কারখানাটির উৎপাদন পরিকল্পনায় বেশ ভালোভাবেই রয়ে গেছে বাংলাদেশের নাম! গত ২৫ বছর ধরে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মাহিন্দ্রা।  

কীভাবে? সেটি জানতে হলে একটু পেছন ফিরে আবারও মুম্বাইয়ে যেতে হবে। ২০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের মাহিন্দ্রা গ্রুপের অন্যতম অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মাহিন্দ্রা লিমিটেড, কোম্পানির হেড অফিস মোম্বাইয়ের এ্যাপোলো বান্দারে। সেখানে এক অনুষ্ঠানে এই কোম্পানির চিফ অব ইন্টারন্যাশনাল অপারেশন্স অরভিন্দ ম্যাথিউ বলেন, মাহিন্দ্রা নিজেদের গ্লোবাল ফুটপ্রিন্ট বিস্তৃত করার স্বপ্ন দেখছে। এই অগ্রগতি কৌশলে বাংলাদেশ প্রধান অংশগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। মাহিন্দ্রার অটোমাবাইল খাতে শীর্ষ তিনটি বৈদেশিক বাজারের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। তার মতে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের কৃষি খাতের উৎপাদনে মাহিন্দ্রা ট্রাক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। এ কারণে সেখানে এখন ব্র্যান্ড হিসেবে মাহিন্দ্রা ট্রাক্টর এক নম্বর স্থানে রয়েছে। শুধু তাই নয়, সময়ের সঙ্গে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা, উৎপাদন ও বিপণন পদ্ধতি, বীজ সংরক্ষণ এমনকি কীটনাশক ও সেচ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমন্বয় রেখে উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছে মাহিন্দ্রা ট্রাক্টর। বাংলাদেশে এখন ড্রাইভারবিহীন ট্রাক্টর বাজারজাতকরণের বিষয়টি মাথায় রেখে নতুন নতুন পণ্য তৈরি হচ্ছে পুনের সেই কারখানায়। পণ্য পরিবহনের বিষয়টি মাথায় রেখে ছোট আকারের পিকআপ, ডাবল ও মাল্ট্রি এক্সেল সমৃদ্ধ ট্রাক এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হচ্ছে নতুন ডিজাইনের জিপ। আর এভাবেই ভারতের প্রথম সারির সেই অটোমোবাইল কারখানাটির নির্মাণ পরিকল্পনায় বাংলাদেশ একটি অন্যতম নাম। ভারতের এই কোম্পানিটি ১৯৯৪ সাল থেকে বাংলাদেশে পূর্ণ পরিসরে পণ্য ও সেবা কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৮টি ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসা খাতে মাহিন্দ্রার উপস্থিতি রয়েছে; যার মধ্যে টু হুইলারস, বাণিজ্যিক বাহন, ব্যক্তিগত যানবাহন, ট্রাক্টর এবং কৃষি ব্যবসা, নির্মাণ উপকরণ, আইটি ও সোলারসহ পাওয়ার রোল জেনসেট উল্লেখযোগ্য। ১১টি বিভিন্ন সেক্টরজুড়ে ভারতের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ড হিসেবে বিশ্বব্যাপী ৫৫টি উৎপাদন সুবিধা সংবলিত ১০০টিরও বেশি দেশে এখন পণ্য ও সেবা কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে মাহিন্দ্রা। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী নিজেদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কেন বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে? জানতে চাওয়া হয়েছিল মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মাহিন্দ্রা লিমিটেডের ভাইস প্রেসিডেন্ট, হেড অব ইন্টারন্যাশনাল অপারেশন্স (দক্ষিণ এশিয়া) সঞ্জয় যাদবের কাছে। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্রুততম ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। গত অর্থবছরে দেশটি ৭ শতাংশের উপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। এবার তারা ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি আশা করছে যা বিশ্বের খুব কম দেশের পক্ষেই সম্ভব। অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর উত্থান মাহিন্দ্রার ‘রাইজ’ দর্শনেরই প্রতিবিম্ব। সম্প্রতি ‘রাইজিং অ্যাভোব’ স্পৃহাকে ধারণ করে ‘চলো রে’ স্লোগান নিয়ে বাংলাদেশে মাহিন্দ্রা ব্র্যান্ড ক্যামপেইন চালু করেছে। আর এই পথচলায় দেশের অন্যতম আইকন মাশরাফি বিন মর্তুজাকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে পাশে পেয়েছি আমরা। সঞ্জয় বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে মাহিন্দ্রা ৫০ হাজারেরও বেশি গ্রাহক ও স্টেক হোল্ডারের একটি পরিবার। আমাদের পণ্য ও সেবার মাধ্যমে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও কৃষি খাতে অসামান্য অগ্রগতির অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত। মাহিন্দ্রা ভারতের বৃহত্তম ইউভি প্রস্তুতকারক। ভলিউম অনুসারে এটি বিশ্বের বৃহত্তম ট্রাক্টর কোম্পানি। ভারত থেকে শীর্ষ ৫টি আইটি প্রতিষ্ঠানের একটি এবং সর্বপ্রথম চালকবিহীন ট্রাক্টর প্রযুক্তি প্রচলনকারী। এ ছাড়া সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ট্রাক, জিপ ও প্রাইভেটকারেও নতুন নতুন গেজেট সংযুক্ত করছে মাহিন্দ্রা। আর যন্ত্রের সঙ্গে প্রযুক্তিকে জুড়ে দেওয়ার লক্ষ্যে গবেষণা ও উদ্ভাবনী প্রক্রিয়াতেও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে কোম্পানিটি। চেন্নাইয়ের কাঞ্চিপুরামে পাহাড়ঘেরা সবুজ জমিতে ১২৫ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা হয়েছে মাহিন্দ্রা রিসার্স ভ্যালি। নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী আর প্রযুক্তির মিশেলে গড়ে তোলা এই ভ্যালিতে তিন হাজারেরও বেশি প্রকৌশলী, গবেষক ও কর্মী প্রতিনিয়ত কাজ করছেন ইঞ্জিনচালিত যানকে মানুষের কাছে আরও বেশি মানবিক, আরও বেশি কার্যকর আরও বেশি সুচারুরূপে তুলে দেওয়ার জন্য। নতুন প্রযুক্তির গাড়ি তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখছে এই রিসার্স ভ্যালি। যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটে মাহিন্দ্রা অটোমোবাইল নর্থ আমেরিকা এবং চেন্নাইয়ে মাহিন্দ্রা রিসার্চ ভ্যালির যৌথ গবেষণায় সম্প্রতি বাজারে এসেছে ‘মারাজ্জো’ নামের নতুন একটি ব্র্যান্ড গাড়ি। হাঙরের চেহারার আদলে তৈরিকৃত এই গাড়িটিতে একসঙ্গে আটজন বসা যায়। বিশ্বব্যাপী নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে স্থানীয়করণ প্রক্রিয়াও সুসংহত করছে ভারতের এই শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিটি। মাহিন্দ্রার ইচ্ছে খুব শিগগিরই বাংলাদেশ থেকেই স্থানীয়ভাবে তৈরি হবে তাদের অত্যাধুনিক ব্র্যান্ডের নতুন নতুন মডেলের সব গাড়ি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর