শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০১৯ ০০:০০ টা

লাশ বহন করাই মইন আলীর কাজ

১১০টি লাশ বহন করেছেন

বাবুল আখতার রানা, নওগাঁ

লাশ বহন করাই মইন আলীর কাজ

নওগাঁর রানীনগরের মইন আলীর (৩৫) পেশা লাশ বহন করা। অভাব-অনটনের সংসারে অনেক কষ্ট করেই কিনেছেন একটি ভটভটি। প্রায় ২/৩ বছর ধরে ভটভটি দিয়ে সড়কে যাত্রী বহনের কাজ করতেন তিনি। হঠাৎ একদিন তার গ্রামের একটি লোকের অর্ধগলিত লাশ তার গাড়িতে বাধ্য হয়ে বহন করতে হয়। লাশ বহনের পর মনের ভিতর জেগে যায় ধর্মীয় অনুভূতি, নামাজ পড়তে শুরু করলেন, মুখেও দাড়ি রাখলেন। তখন তার মাথায় চিন্তা আসে সবাই তো যাত্রী বহন করে, লাশ বহন করার লোক পাওয়া যায় না। লাশ নিয়ে পরিবারের লোকজনদের ও থানা পুলিশদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। পচন ধরা অর্ধগলিত লাশ গাড়িতে বহন করতে চায় না কেউ। ঠিক তখনই অর্থাৎ গত প্রায় ১৪ বছর আগে মইন আলী সিদ্ধান্ত নেন তিনি শুধুমাত্র লাশ বহন করবেন। তিনি থানা পুলিশকে বলেন, স্যার লাশ নিয়ে আপনাদের আর কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। আমাকে খবর দিবেন আমি লাশ বহনের জন্য চলে আসব। সেই থেকে রানীনগর উপজেলায় ব্যক্তি পর্যায় ও থানা পুলিশের পক্ষ থেকে লাশ বহনের কাজটি মইন আলীকে দিয়েই চলছে। এ পর্যন্ত তিনি ১১০টি লাশ বহন করেছেন। অজ্ঞাত পচন ধরা ভাসমান দুর্গন্ধ হওয়া লাশ, রেল ও সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত হওয়া, হত্যা-আত্মহত্যাসহ সব ধরনের লাশ কাপড় বা চাঁটাই দিয়ে মোড়ানো ও বহনের ক্ষেত্রে মইন আলীই যথেষ্ট। ঘটনাস্থল থেকে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে নেওয়া থেকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা পর্যন্ত লাশের দায়িত্বে থাকতে হয় মইন আলীকে। লাশ নিয়ে কাজ করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় অন্য কাজ করতেও মন চায় না মইনের। লাশ বহন করতে পাড়লেই যেন তার মনে তৃপ্তি আসে। লাশ বহন করে গাড়ি ভাড়া বেশ ভালো পাওয়ার কারণে তার সংসারও চলছে এখন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে। লাশ বহনের জন্য তিনি নিজেই  তৈরি করেছেন সাদা পোশাক। ঘটনাস্থল যত দূরে ভাড়াটাও তত বেশি পাওয়া যায়। পচনশীল লাশের ক্ষেত্রেও ভাড়া খুব ভালোই হয়। প্রায় দেড় থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত এক একটি লাশের ভাড়া হয়। এ ছাড়াও বিপদগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে লাশ বহনের মাধ্যমে এক রকম সহযোগিতাও করেন তিনি। এতে বিপদগ্রস্ত পরিবারের লোকজন তার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি আরও জানান, সব সময় লাশ বহনের কাজ হয় না। মাসে দু-একটি করে লাশের ভাড়া পাওয়া যায়। তাই অন্য সময় আমার গাড়ি দিয়ে যাত্রী বহন করতে গেলে ‘লাশের গাড়ি’ বলে গাড়িতে কেউ উঠতে চায় না। ফলে মাসের বেশির ভাগ দিন উপার্জন ছাড়াই বসে থাকতে হয়। শতাধিক লাশ বহন করাটায় তার জীবনের বড় সফলতা। রানীনগর উপজেলা সদরের সিম্বা গ্রামের মৃত. আশরাব আলী মণ্ডলের ছোট ছেলে মইন আলী। বাবার মৃত্যুর পর চার ভাই-বোনের সংসার ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যায়। অভাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে ওঠা মইন আলী কিছুদিন পর বিয়ে করে নতুন জীবন শুরু করেন। বছর কয়েক পর মইন আলীর অভাব-অনটনের সংসারে জন্ম নেয় এক মেয়ে ও পরে এক ছেলে। ভটভটি চালিয়ে মেয়েকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। ছেলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। অভাবের সংসারে বেশি দূর পর্যন্ত লেখাপড়ার খরচ ব্যয় করা অসম্ভব। তাই বড় মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক বছর পর মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু বিয়ের খরচ বাবদ কোনো টাকা-পয়সা তার কাছে নেই, তাই টাকার প্রয়োজনে  পৈতৃক সূত্রে পাওয়া দেড় শতক ভিটেমাটি বড় ভাইদের কাছে বিক্রি করে মেয়েকে বিয়ে দেন। কিছুদিনের মধ্যে বিক্রি করা বসত ঘর ছেড়ে দিতে হয়। কোথায় থাকবে? কী করবে? এমন দুঃসময়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলমের ছোট ভাই সিরাজুল ইসলাম চাঁদের শরণাপন্ন হলে তিনি এলাকার ঝিনা গ্রামের পার্শ্বে গড়ে ওঠা গুচ্ছগ্রামে তাকে বসবাস করার ব্যবস্থা করে দেন। সেই থেকে মইন আলী ওই গুচ্ছগ্রামেই বসবাস করছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর