শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

নাজমুনের বিশ্ব ভ্রমণ

তানিয়া তুষ্টি

নাজমুনের বিশ্ব ভ্রমণ

দেশের ১৬ কোটি মানুষের হৃদয়ে ইতিমধ্যে সাড়া জাগিয়েছেন লক্ষ্মীপুরের মেয়ে নাজমুন নাহার। ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া নাজমুন নাহার বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে জয় করেছেন বিশ্ব। ২০০০ সালে ভারতের ভুপালের পাঁচমারি সফরের মধ্যদিয়ে তার যাত্রা শুরু। পতাকার সম্মানকে তিনি সর্বোচ্চ উচ্চতায় তুলে ধরার জন্য হেঁটেছেন পৃথিবীর দুর্গম থেকে দুর্গমতর পথে! ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস সড়ক পথে ঘুরেছেন পশ্চিম আফ্রিকার ১৫টি দেশ। এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে পশ্চিম আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি ও গোল্ড কোস্ট লাইনের প্রতিটি দেশ! ১৮ নভেম্বর ২০১৯ সুইডেন থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপ গ্রান্ড ক্যানারিয়া হয়ে তিনি শুরু করেছিলেন যাত্রা। মৌরিতানিয়া, সেনেগাল, গাম্বিয়া, মালি, গিনি বিসাও, গিনি কোনাক্রি, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট,

বুরকিনা ফাসো, গানা, টগো, বেনিন, নাইজার ও নাইজেরিয়া ভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রের সবচেয়ে কঠিন পথের যাত্রা শেষ করেন। ১২৫ দেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের পতাকাকে নিয়েছেন সর্বোচ্চ উচ্চতায়! বলা চলে হার না মানা বাংলাদেশের এই সাহসী নারী! তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের লাল-সবুজের এ পতাকা আমার কাছে সবচেয়ে বড় শক্তি! এ পতাকা আমাকে ছায়া দিয়েছে! পতাকা হাতে যখনি আমি নতুন কোনো দেশের সীমান্তে পা দিয়েছি তখনই আমার সঙ্গে যেন জেগে উঠেছে ষোলো কোটি প্রাণ!

দেশে ফিরে বাংলাদেশ প্রতিদিন পরিবারের সঙ্গে আড্ডায় বসেন নাজমুন নাহার। এবার কথা হলো তার বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে। নাজমুন নাহার বলেন, কোনাক্রিতে পৌঁছার পর লোকাল ফ্যামিলির সঙ্গে থাকার সময় প্রচণ্ড তাপে মধ্য রাতে আমার হার্ট এটাক হওয়ার মতো অবস্থা। মনে হয়েছিল এখানেই বুঝি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু সুস্থ হওয়ার পর বুঝেছিলাম জীবন ফিরে পাওয়ার অকৃত্রিম স্বাদ। এরপর আসে আরেক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। বাংলাদেশের পতাকা ওড়াচ্ছিলাম আইভরি কোস্টের আবিদজান সমুদ্র সৈকতে! নিরাপদ দূরত্বে হাঁটছিলাম, হঠাৎ আছড়ে পড়ল একটা ভয়ঙ্কর ঢেউ! আমি ভেসে গেলাম পানির সঙ্গে, পাড়ের দিকে হাতড়ে কোনোভাবে সামলে উঠি! কিন্তু আমাকে ভয়ঙ্কর ঢেউয়ের তোড় কিছুটা মৃত্যুর সন্দিক্ষণে নিয়ে আবার বাঁচিয়ে দিল তৎক্ষণাৎ!

বিপদসংকুল জায়গাগুলোতে কখনো কখনো কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি ভোরের অন্ধকারে আমাকে সীমান্ত এলাকা পার করে দিয়েছে! বিভিন্ন শহরে প্রায় তেরোটি লোকাল ফ্যামিলির সঙ্গে থেকেছি। খুব কাছ থেকে তাদের সংস্কৃতিকে  জানতে পেরেছি! তারা যত গরিবই হোক না কেন যেখানেই গিয়েছি সবাই হাসিমুখে বলেছে- ‘ইউ আর ওয়েলকাম’! আমার মতো সব বিদেশি মুসাফিরের প্রতি তাদের ভালোবাসা-সম্মান আন্তরিকতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি! কিন্তু এই পশ্চিম আফ্রিকা ভ্রমণ না করলে আমার দেখা হতো না মানুষের বেঁচে থাকার কঠিন বাস্তবতা! অনেক দুর্গম জায়গায় দেখেছি শিশুর শরীর ধুলোমাখা, পরনে কাপড় নেই, খাবারের অভাব, কিশোরীর শরীরে এক টুকরো কাপড়- ওই দৃশ্য আমাকে কাঁদিয়েছে! আরও কাঁদিয়েছে তাদের ইতিহাস। ওদেরকে যখন একসময় জাহাজে করে ছোট ছোট বাক্সে ভরে কৃতদাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া হতো বিভিন্ন দেশে, মরে গেলে জাহাজ থেকে ফেলে দেওয়া হতো! সেই নির্মমতার স্বীকার হয়েছিল এ আফ্রিকানরা!

তাদের জীবনের গল্প অনেক! ওরা অনেক কঠিন পরিশ্রম করে! আমি বুরকিনা ফাসো, ঘানা, টোগো, বেনিনে দেখেছি, মেয়েরা পেছনে বাচ্চাকে বেঁধে বাইক চালাচ্ছে, মাথায় আবার বোঝা। আমি ভাবতে শিখছি বারবার- আমরা সবাই এক পৃথিবীর মানুষ! এখানে অনেক মানুষ আছে যাদের পরনের কাপড়ে পাঁচ-ছয়টা ফুটো থাকে। অনেক এলাকায় খবার পানি নেই, কী ভয়নাক জীবনযাপন। তবুও তারা হার মানেনি, একটু খাবারের জন্য কঠিন পরিশ্রম করে! আমিও অনুভব করেছি পৃথিবীর ভিন্ন পারে জীবন যাত্রা!

নাজমুন নাহার বলেন, যাহা দুর্গম তাহাই সুন্দর! এই বিশ্ব অভিযাত্রা আমাকে শিখিয়েছে অনেক, আমাকে শক্তিশালী করেছে! যে দিন গিনিতে হঠাৎ রাত ৩টায় গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে ম্যাংগ্রোভ জঙ্গলে অন্ধকারে আটকা পড়েছিলাম, সেদিন আকাশের তারার আলোয় পথ খুঁজে খুঁজে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আড়াই ঘণ্টা পর শেষ রাতে এক আদিবাসীর বাসার সামনে আশ্রয় নিয়েছিলাম!

সেদিন ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমার আশপাশে তাকিয়ে দেখি কোনো খাবার নেই, শুধু কাঁচা কমলা লেবু দেখা যাচ্ছিল গাছে। সেটাই খেয়ে বেঁচে থেকেছি দুই দিন! জীবনের এই জার্নি আমাকে কখনো শেষ করেনি। আমাকে শিখিয়েছে, আমার জীবনটাকে মূল্যবান করে তুলেছে! আমি যখন লাল-সবুজের পতাকা হাতে সাহারা মরুভূমিতে যাত্রা করেছি, কখনো ৫৬ ডিগ্রি কখনো ৪৬ ডিগ্রিতে শরীরের চামড়ার ওপর ক্ষত হয়েছিল

শরীর রক্তাক্ত হয়েছিল প্রচণ্ড দাবদাহ আর ধুলো ঝড়ের আঘাতে, সেদিনও থামিনি মরুর উঁচু ভ্যালিতে যেতে!

মায়ের পেট থেকে জন্ম নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই পৃথিবীর আলো-বাতাস যেমন একটি মানব সন্তানকে ওয়েলকাম করে তেমনি যখন আমি কোনো নতুন দেশে পা দেই সেখানকার মানুষ তখন হাসিমুখে আমাকে বলে, ‘ইউ আর ওয়েলকাম’। তখন আমি খুঁজে পাই আত্মার বন্ধন!

এ তো গেল ভ্রমণ কথা। এই ভ্রমণ পথে তার অর্জন অনেক। পেয়েছেন অনন্যা সম্মাননা ২০১৮, জনটা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ২০১৮, তিন বাংলা সম্মাননা ২০১৮। তার বিশ্ব অভিযাত্রার মাইলফলকের সম্মাননাস্বরূপ জাম্বিয়া সরকারের গভর্নর হ্যারিয়েট কায়েনার কাছ থেকে ১ জুন ২০১৮ পান ‘ফ্ল্যাগ গার্ল উপাধি’। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ২০০৯ সালে সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ‘এশিয়ান স্টাডিজ’ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৫ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে অর্জন করেন ‘হিউমান রাইটস অ্যান্ড এশিয়া’ বিষয়ে ডিগ্রি। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর