শিরোনাম
শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

পাহাড় মেতেছে বৈসাবি উৎসবে

পাহাড় মেতেছে বৈসাবি উৎসবে

পাহাড়ে বৈসাবি মানে উৎসব, আনন্দ আর উল্লাস। তাই গানে সুর, নূপুরের ছন্দে, নাচের তালে তালে মেতেছে তরুণ-তরুণীরা। সেজেছে নিজেরা হরেক রকম পোশাকে। পাহাড়ি পল্লীগুলোতে এখন জমজমাট বৈসাবি উৎসবের আসর। একই সঙ্গে জমে উঠেছে বৈসাবি মেলাও। চৈত্র এলেই অর্ধমাসব্যাপী চলে বর্ষবরণের উৎসব। উৎসবমুখর হয়ে ওঠে পাহাড়ি এ অঞ্চল। সম্প্রীতির মিলনমেলায় মিশে যায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালিরা। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের খেলাধুলা ও বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মেলার মধ্য দিয়ে গত ২ এপ্রিল শুরু হয়েছে বৈসাবির নানা উৎসব। আর এ আনন্দ উৎসব চলবে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত। এ সময়টায় ভ্রমণপিপাসু পর্যটকের ভিড় বেশি জমে পার্বত্যাঞ্চলে। পাহাড়ে বৈসাবি উৎসবের কথা জানাচ্ছেন- ফাতেমা জান্নাত মুমু

 

বৈসাবি : চৈত্র মাসের শুরুতেই একটি পাখি এসে বিজু বলে ডাক দিয়ে যায়। চাকমা সম্প্রদায় এ পাখিকে বিজু  পেক্কো (বিজু পাখি) বলে। এই পাখির সুমধুর কলতান বিজু বা চৈত্রসংক্রান্তি উৎসবের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। এটা পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ধারণা। পার্বত্যাঞ্চলের ১০ ভাষাভাষী ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বৈসাবিকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে পালন করে থাকে। যেমন- চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাইং, ত্রিপুরারা বৈসুক, তঞ্চঙ্গ্যারা বিষু ও অহমিয়ারা বিহু নামে পালন করে থাকে। তবে সবকিছুর সংমিশ্রণের এ উৎসব পরিচিতি লাভ করেছে ‘বৈসাবি’ নামে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা রীতি অনুযায়ী ১২ এপ্রিল অর্থাৎ চৈত্র মাসের ২৯ তারিখ গঙ্গ্যা দেবীর উদ্দেশ্যে কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসিয়ে সূচনা করা হয় ‘ফুল বিজুর’ উৎসব। পরদিন (১৩ এপ্রিল) মূল বিজু মানেই পাজন খাওয়া উৎসব। আর (১৪ এপ্রিল) পয়লা বৈশাখ। চাকমা ভাষায় গজ্যাপজ্যা। সেদিনও চলে নানা আয়োজন।  এ ছাড়া (১৫-১৭ এপ্রিল) মারমা সম্প্রদায়ের জলোৎসবের নতুন বছরকে বরণ ও পুরনো বছরকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাহাড়ে বৈসাবির আনুষ্ঠানিকতা।

বিজু : পার্বত্যাঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা সম্প্রদায় বৈসাবিকে বিজু বলে। তারা এ উৎসব তিন ভাগে ভাগ করে পালন করে। যেমন- বছরের শেষ অর্থাৎ চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ‘ফুল বিজু’, ৩০ তারিখে ‘মূল বিজু’ বৈশাখ মাসের ১ তারিখ ‘গজ্যাপজ্যা বিজু’ নামে পালন করে।

ফুল বিজু : বিজুর প্রথমদিন থাকে ফুল বিজু। ফুল বিজু মানে ফুলে ফুলে সাজানো সব কিছু। আকাশে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে স্নান শেষে পাহাড়ি অরণ্যে ফুলের বিচরণ শুরু করে চাকমা তরুণ-তরুণীরা। এ ফুল দিয়ে করা হবে সব পূজা-অর্চনার কাজ। একই সঙ্গে এ ফুল শোভা পাবে পাহাড়ি মাচাং ঘরগুলোর আঙিনায়। এরপর কলাপাতায় ফুল হাতে নিয়ে দলবেঁধে নদীর উদ্দেশে পাহাড়ি পথচলা। কাপ্তাই হ্রদে গঙ্গা দেবীকে এ ফুল উৎসর্গ করে শুরু হবে প্রার্থনা। জগতের সব গ্লানি মুছে যাক, সুখ, শান্তিতে ভড়ে উঠুক পাহাড় এমন প্রার্থনার কথা শোনা যায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে। বাকি ফুল দিয়ে শুরু হয় একে অপরের শুভেচ্ছাবিনিময়। এ সময় উল্লাসে রং ছড়িয়ে পরে পাহাড়ে।

 

মূল বিজু : মূল বিজু হচ্ছে বিজুর প্রধান উৎসব। দিনে প্রথম আকর্ষণ নতুন জামা, সাজগোজ আর অতিথি আপ্যায়ন। চলে পাজন উৎসব। প্রায় ৩৫টি জুমে উৎপাদিত কাঁচা সবজি সংমিশ্রণে তৈরি করা হয় পাজন। একই সঙ্গে থাকে হরেক রকম পাহাড়ি পিঠা, পায়েস, বিন্নি ধানের খই, নাড়ুর আর লাড্ডুর আয়োজন। এসব তৈরি করে শুধু নারীরাই। সেদিন সারাদিন কেটে যায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙালি মিলে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়িয়ে। দিনশেষে সন্ধ্যা গো-শালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে বৌদ্ধের কাছে মঙ্গল কামনা করা হয়।

গজ্যাপজ্যা বিজু : চাকমা সম্প্রদায়ের জন্য বিজুর শেষ দিন গজ্যাপজ্যা। মানে গড়াগড়ি করা। দুই দিনের উৎসব শেষে গজ্যাপজ্যার দিন কাটায় বিশ্রাম নিয়ে। তরুণ-তরুণীরা বড়দের স্নান করিয়ে আশীর্বাদ নেয়। এ দিন পাহাড়ি গ্রামগুলোতে গেংগুলি গানের আসরও জমে। চলে নাচগানও। সন্ধ্যার আগে হাজির হয় বৌদ্ধ বিহারে। ভিক্ষুসংঘ কর্তৃক ধর্মদেশনা শুনে অনাগত দিন সুখে শান্তিতে কাটানোর জন্য বিশেষ প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে সবাই। অন্যদিকে পার্বত্যাঞ্চলের ত্রিপুরা সম্প্রদায় বৈসাবিকে বৈসু নামে পালন করে থাকে। তাদের আয়োজনে যোগ হয় ভিন্নমাত্রা। কারণ পাহাড়ে বসবাসরত বেশির ভাগ ত্রিপুরা সম্প্রদায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

বৈসু : পার্বত্যাঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মধ্যে ত্রিপুরা সম্প্রদায় বছরের শেষ দিনের অনুষ্ঠানকে বৈসু উৎসব হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীরাও বৈসাবিকে তিন ভাগে ভাগ করে উৎসব পালন করে থাকে। বৈসাবির প্রথমদিন তাদের জন্য হারি বিজু, পরেদিন বিষুমা ও শেষদিন বিসিকাতাল পালন করে থাকে। তিন দিনই থাকে নাচ, গানের আয়োজন। এ উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে গড়াই নৃত্য। ত্রিপুরা তরুণ-তরুণীদের গড়াই ও বতল নৃত্য খুবই জনপ্রিয়। নিজেদের পোশাকে সেজে তারা গড়াই নৃত্যে অংশগ্রহণ করে। এ ছাড়া পাহাড়ি গ্রামের বয়স্ক নারী-পুরুষদের স্নান করিয়ে কাঁচা ফুলের মালা দিয়ে বরণ করা হয় পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের।

 

সাংগ্রাই : সাংগ্রাই মানে জলোৎসব। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মধ্যে মারমা সম্প্রদায় বছরের শেষ দিনে সাংগ্রাই উৎসবের মধ্য দিয়ে পালন করে। মূলত নতুন বছরকে বরণ আর পুরো বছরকে বিদায় করতে তারা এ সাংগ্রাইয়ের আয়োজন করে থাকে। এ দিন জলোৎসবের দৃশ্য বেশ উপভোগ্য বলে প্রচুর মানুষের সমাগম ঘটে। মারমা ভাষায় জলোৎসবকে ‘রিলংপোয়ে’ বলে। মারমা ও রাখাইন তরুণ-তরুণীরা জলখেলার জন্য আগে থেকে প্যান্ডেল তৈরি করে রাখে। মারমা যুবক-যুবতীরা জল ছিটিয়ে একে অপরকে কাবু করার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। এ উৎসবে শুধু মারমা কিংবা রাখাইন সম্প্রদায় নয়, যোগ দেয় বিভিন্ন জাগিগোষ্ঠীর বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। জলোৎসবের পাশাপাশি চলে দড়ি টানাটানি, হাডুডু খেলার প্রতিযোগিতা।

 

বাঙালির বর্ষবরণ : বৈসাবির সর্বশেষ উৎসব হচ্ছে বর্ষবরণ। ১৪ এপ্রিল অর্থাৎ ১। সকাল থেকে শুরু হয় নানা উৎসব। রঙে-ঢঙে সেজে নারী-পুরুষেরা অংশ নেয় বর্ষবরণ উৎসবে। সেদিন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী আর বাঙালির মধ্যে থাকে না কোনো প্রকার ভেদাভেদ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলনমেলায় বসে আসর। এ উৎসবে মেতে ওঠে বাঙালি, হিন্দু ও বড়ুয়া সম্প্রদায়ের মানুষও। এদিন জাতিগত থাকে না কোনো দ্বন্দ্ব। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়। কেউ কারও প্রতি বিদ্বেষভাব পোষণ করে না। সংঘাতেও জড়িয়ে পড়ে না। বছরের শেষ দুই দিন এবং নতুন বছরের প্রথমদিন মোট তিন দিনই মূলত বর্ষবরণ উৎসব ‘বৈসাবি’ পালিত হয় বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়।

সর্বশেষ খবর