শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

ফিরে আসছে নীল চাষ

রেজাউল করিম মানিক ও মর্তুজা নুর, রংপুর

ফিরে আসছে নীল চাষ

যে নীল চাষে বাধ্য করার প্রতিবাদে রংপুর অঞ্চলে ‘নীল বিদ্রোহ’ হয়েছিল। কালক্রমে সেই প্রাকৃতিক নীল চাষ করে স্বনির্ভর হয়েছে রংপুরের হাজারো পরিবার। নীল চাষের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে ডায়িং কারখানা। আর এই নীলে নীল পণ্য যাচ্ছে বিদেশে। আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।

প্রায় সোয়া দুইশ বছর আগে রংপুর ও নীলফামারী অঞ্চলে চাষিদের নীল চাষে বাধ্য করা হতো। সে সময় জমিদারদের সঙ্গে নীল চাষিদের বিবাদকে ঘিরে নীল বিদ্রোহ হয়েছিল। একপর্যায়ে ১৮৫৯-১৮৬০ সালের দিকে নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়। এত বছর পর সেই নীল চাষ আবার শুরু হচ্ছে রংপুরে। কিন্তু তা চাষিদের কপাল পোড়াতে নয়, ভাগ্য ফেরাতে।

স্থানীয় কৃষকরা বলেন, জৈবসার ও জ্বালানির প্রয়োজনে ১৩ বছর আগে বাড়ির পাশে উঁচু ভিটা, পতিত জায়গায় আবার শুরু হয় নীল চাষ। ক্রমেই কৃষকদের অর্থনৈতিক ফসল হিসেবে এর চাষ বাড়ছে। আলু ও তামাক উঠার পর আমন চাষের আগে যে জমি অব্যবহৃত থাকে তাতে নীল চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। পানির অভাব বা রসের অভাবে জমি এখন আর পড়ে থাকছে না। নীল চাষ করায় জমির উর্বরতা বাড়ছে। নীলের উপরি অংশের পাতা দুই-তিন বার কেটে নীল উৎপাদনের জন্য বিক্রি করায় তাদের আয় হচ্ছে বেশ। নিচের অংশ খড়ি বা লাকড়ি হিসেবে জ্বালানির কাজে লাগছে। পাতা পচানো অংশ কম্পোস্ট বা জৈবসার হিসেবে জমির উর্বরতা বাড়াচ্ছে। এতে তাদের বেশ লাভ হচ্ছে। তাই রংপুরের বিভিন্ন উপজেলায় বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের অনেক গ্রামে নীল চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কৃষকরা জানান, ২০০৮ সালে রংপুর সদরের রাজেন্দ্রপুরে ‘নিজেরা কটেজ অ্যান্ড ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রিজ’ (এনসিভিআই) নামে একটি সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এলাকার কয়েকজন। পাঁচ বছরে এনসিভিআইয়ের সদস্য ও পরিধি বেড়ে যায়। গড়ে উঠে প্রাকৃতিক নীল ডায়িং কারখানা। তারা নীল গাছের পাতা সংগ্রহ ও তা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করছেন নীল। সেই নীলে ডায়িং করা ব্যাগ, ফতুয়া, চাদর, নকশিকাঁথা ও বাহারি পণ্য তৈরি করে দেশ-বিদেশে বিক্রি করছেন তারা। তবে দেড়শ বছর পর এসে সেই বাংলাদেশে আবার বাণিজ্যিকভাবে নীল চাষ হচ্ছে। উৎপাদিত নীল রপ্তানি হচ্ছে আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। সৃজনশীল উদ্যোক্তারা প্রাকৃতিক রঙের পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে আসছেন বাজারে। আর শৌখিন গ্রাহক, পরিবেশপ্রেমীরা তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। বাজারে প্রাকৃতিক রঙের চাহিদা বাড়ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা নীলের। এ চাহিদাকে পুঁজি করে আন্তর্জাতিক সংস্থা কেয়ার বাংলাদেশ ‘লিভিং ব্লু’ নামের একটি কর্মসূচির মাধ্যমে নীল চাষের উদ্যোগ নিয়েছে। ওই কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় রংপুর জেলার রাজেন্দ্রপুর ও পাগলাপীর এলাকায় প্রায় দুই হাজার কৃষক তিন হাজার একর জমিতে নীল চাষ করছেন। এতে কৃষকরা যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি দেশ পাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।

এ বিষয়ে রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. মো. সরওয়ারুল হক বলেন, রংপুরের বিভিন্ন এলাকায় সামান্য পরিমাণে নীল চাষ হচ্ছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্থানীয় চাষিদের কাছ থেকে নীল পাতা কিনে নিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে থাকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের গবেষকরাও নীল চাষ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। কীভাবে এ চাষ আরও লাভজনক করা যায় তা নিয়ে নীতি-নির্ধারকরা ভাবছেন। তিনি বলেন, নীল চাষ বেশ সহজ। এ জন্য উর্বর জমি লাগে না। আবার সার বা কীটনাশকের প্রয়োজনও হয় না। আগাছা দমনের কাজও তেমন নেই। ফলে চাষিরা সহজে এ চাষ করে লাভবান হতে পারেন।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শুরুর দিকে বাজার থেকে বীজ কিনে চাষ করতেন রংপুরের চাষিরা। এখন নিজেরাই বীজ উৎপাদন করছেন। এক কেজি নীল পেতে ২৫০ কেজি পাতা লাগে। প্রতি কেজি পাতার জন্য চাষিরা পান তিন টাকা। একটি গাছ থেকে এক মৌসুমে দুইবার পাতা কাটতে পারেন কৃষকরা। পাতা কাটার পর শুকনো নীল পেতে চার দিন সময় লাগে। তবে ভালো রোদ থাকতে হয়। রংপুরে লিভিং ব্লুর নীল প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা রয়েছে। সাধারণত যেসব জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে, সেই জমিতে যখন তামাক থাকে না, তখন চাষিরা নীলের চাষ করছেন। নীল পরিবেশ বা অন্যান্য চাষের জন্য ক্ষতিকর নয়। নীলের পাতা ছাড়া গাছের কা- জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

লিভিং ব্লু জানিয়েছে, গত বছর আমেরিকার স্টোনি ক্রিক কালারস বাংলাদেশ থেকে এক টন নীল নিয়েছে। ফ্রান্সের লোয়ে কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে নীল কিনছে। এছাড়া কানাডা, জাপান ও ভারতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান লিভিং ব্লু থেকে নীল সংগ্রহ করছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর