শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

হবিগঞ্জের মামুনের প্রশংসায় ইংল্যান্ডের রানী

তানিয়া তুষ্টি

হবিগঞ্জের মামুনের প্রশংসায় ইংল্যান্ডের রানী

একসময় যেখানে পোশাক ফেরি করে ফিরতেন মামুন, সেই লন্ডনের হাইস্ট্রিটে এখন নিজের মালিকানায় গড়েছেন লন্ডন ট্র্যাডিশনের একটি আউটলেট। লন্ডনের অভিজাত পাড়ায় বাঙালি মালিকানাধীন প্রথম শোরুম এটি।

 

ইংল্যান্ডের রানী  দ্বিতীয় এলিজাবেথ ২০১৬ সালে নিজের নব্বইতম জন্মদিনের স্মারকগ্রন্থে কারও প্রশংসা করছেন, ‘এ লেভেল অব কোয়ালিটি’। রানির মুখে এমন প্রশংসা শোনা যে কারও জন্য গর্বের। আর এ গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন হবিগঞ্জের মামুন চৌধুরী। ঐতিহ্যবাহী ডাফেল কোট নতুনরূপে বাজারে এনে ইংল্যান্ডে তো বটেই, বিশ্ব মাতিয়েছেন তিনি। এ কারণে ব্রিটেনের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মানজনক পদক ‘লন্ডন ট্র্যাডিশন কুইন্স অ্যাওয়ার্ড’ও জিতেছেন ২০১৪ সালে। ‘এ লেভেল অব কোয়ালিটি’ শিরোনামে মামুন চৌধুরীকে নিয়ে স্মারকগ্রন্থে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়।

 

১৯৮৫ সালের দিকে মামুন চৌধুরী ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সৌদিতে পাড়ি জমান। ১৯৮৭ সালে নিজে ফুড ডিস্ট্রিবিউশন বিজনেস শুরু করেন। কিন্তু ইরাক যুদ্ধ শুরু হলে সব হঠাৎই বদলে যায়। বন্ধুর পরামর্শে ব্রিটেনে পাড়ি জমান। এরপর জীবিকার তাগিদে বেছে নিলেন পোশাক বিক্রির কাজ। ১৯৯৩ সালে তরুণ মামুন চৌধুরী লন্ডনের মার্কেটগুলোয় ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বিক্রি করতেন। একদিন একটি ব্যাগে কিছু শার্ট পুরে গেলেন মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের (বিশ্বখ্যাত চেইনশপ) অফিসে। সিকিউরিটি গার্ডকে বললেন, ‘কিছু ভালো শার্ট নিয়ে এসেছি, ভিতরে যাওয়া যাবে?’ গার্ডের উত্তর, ‘এভাবে হবে না। আপনি এই ফোন নম্বর নিয়ে কথা বলে আসুন।’

বাসায় ফিরে মামুন সেই নম্বরে ফোন দিলেন। অপর প্রান্ত  থেকে আশ্বাস এলো পরে যোগাযোগ করা হবে। কিছুদিন পর মামুনের ঠিকানায় কিছু বই ও কাগজপত্র এলো। একটিতে ছিল মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের প্রতিষ্ঠাতা মাইকেল মার্কসের জীবনী। সেটি পড়ে মামুনের মনে হয়েছিল, পূর্ব ইউরোপ থেকে খালি হাতে এসেছিলেন শরণার্থী মার্কস। তিনি যদি এত বড় ব্যবসা গড়ে তুলতে পারেন, তবে আমি কেন নই?

পরের বছরই মামুন নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুললেন। নাম ‘লন্ডন ক্লথিং লিমিটেড’। দেশ থেকে গার্মেন্টসামগ্রী নিয়ে গিয়ে ইংল্যান্ড ও ইউরোপের মার্কেটগুলোতে সাপ্লাই দিতেন। সেই সঙ্গে একটি ম্যানুফ্যাকচারিং (প্রস্তুতকারক) ইউনিটও স্থাপন করলেন। যেখানে জ্যাকেট কিংবা কোটের মতো পোশাক তৈরি হতো। শুরুতে তিনি স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য পোশাক বানাতেন। পরে উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরি করতে থাকেন। ডাফেল কোট কিনতে হলে আপনাকে খসাতে হবে ২৫০ পাউন্ডের বেশি। ১২৫০ পাউন্ড দামেরও কোট আছে লন্ডন ট্র্যাডিশনের। গুণগতমানে অবশ্য তারা আপস করে না। দুই বছরের মধ্যে ব্যবসা বাড়ানোর প্রয়োজন দেখা দিল। নিজের প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য সুযোগ দিলেন শিক্ষার্থীদের। তারা নতুন নতুন নকশার সংযোজন ঘটাতে থাকলেন। তবে বর্তমান অবস্থানে আসার পুরো ব্যাপারটি সহজ ছিল না। মামুনের সহজ স্বীকারোক্তি, ‘যতবার সফল হয়েছি, তার চেয়ে বেশিবার ব্যর্থ হয়েছি। তবে কোনোবারই হতাশ হইনি; বরং ব্যর্থতাকে গুরু মেনেছি। শিখেছি সেখান থেকে।’

ফ্যাশন জগতে এখন পরিচিত নাম লন্ডন ট্র্যাডিশন। ২০০২ সালে লন্ডন ট্র্যাডিশনের যাত্রা শুরু। মামুন

নতুন কিছু বাজারে আনার কথা ভাবছিলেন। তরুণরা ছিল টার্গেট। ডাফেল কোটের চল তখনো ছিল। তবে নকশায় বৈচিত্র্য আনতে চেয়েছিলেন মামুন। উল্লেখ্য, ১৮৯০ সাল থেকে এটি ছিল ব্রিটিশ নৌবাহিনীর পোশাক। তবে ১৮৫০ সাল নাগাদ কোটটি পুরো ইউরোপেই জনপ্রিয় ছিল। মামুন এ পোশাকটিই  নতুন নকশায় বাজারে আনলেন। ২০০৪ সালে নতুন নকশার কিছু ডাফেল কোট জাপানেও পাঠান। কারণ জাপানের লোক ডাফেল কোটকেও ব্রিটেনের স্মারক ভাবে। জাপান থেকে তিনি আশাব্যঞ্জক সাড়া পেলেন। মামুন বিশ্বাস করতেন লন্ডন ট্র্যাডিশন একদিন একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ড হবে। আজ তা-ই হয়েছে। 

তারা এখন ওভারকোট, রেইনকোটসহ আরও কিছু গার্মেন্টসামগ্রীতে স্পেশালিস্ট। তারা পোশাকের কাটিং-ফিনিশিং পুরোটায় হাতে করেন। প্রায় একশ কর্মী কাজ করেন মামুনের কারখানায়। সপ্তাহে গড়ে এক হাজার ডাফেল কোট তৈরি হয় কারখানা থেকে। বছরে তাদের রপ্তানির পরিমাণ ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোট।

 

একসময় যেখানে পোশাক ফেরি করে ফিরতেন মামুন, সেই লন্ডনের হাইস্ট্রিটে এখন নিজের মালিকানায় গড়েছেন লন্ড, ট্র্যাডিশনের একটি আউটলেট। লন্ডনের অভিজাত পাড়ায় বাঙালি মালিকানাধীন প্রথম শোরুম এটি। হবিগঞ্জের ছেলে মামুন চৌধুরীরা চার ভাই, চার বোন। পিতা মরহুম হাবিবুর রহমান চৌধুরী ছিলেন ব্যবসায়ী। ব্যক্তিগত জীবনে মামুন তিন সন্তানের জনক।

সর্বশেষ খবর