মানুষের যান্ত্রিক জীবনে জায়গা দখল করেছে পলিথিন এবং প্লাস্টিক। পলিথিনের স্থায়িত্ব বেশি। সহজে পচন এবং পুড়িয়ে ফেলা সম্ভব হয় না। অল্প বাজার করলেই সহজেই পলিথিনে বহন করা সম্ভব। কাজ শেষে পলিথিনকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়। এরপর তার স্থান হয় ডাস্টবিনে এবং ময়লা আবর্জনা ফেলার স্থানে। তবে পরিত্যক্ত পলিথিনকে কাজে লাগিয়েছেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার ৫৫ বছর বয়সী ইদ্রিস আলী নামে এক ব্যক্তি। আর পলিথিনকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় কাজে লাগিয়ে তা থেকে তৈরি করেছেন জ্বালানি তেল পেট্রল, ডিজেল, গ্যাস এবং ফটোকপি মেশিনের কালি। ইদ্রিস আলীর বাড়ি উপজেলার ভারশোঁ ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে। ১৯৮৫ সালে ৮ম শ্রেণি পাস করেছেন তিনি। তবে দরিদ্রতার কারণে পড়া শোনার পাঠটি সেখানেই চুকিয়ে ফেলেছেন। এরপর জীবন সংগ্রামে নেমেছেন। নিজের জায়গা জমি বলতে কিছুই নাই। শ্বশুরের দেওয়া সামান্য জমিতে মাটির বাড়ি। সংসারে পাঁচ ছেলে-মেয়ে। তিন ছেলে ও দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা কৃষিসহ অন্যান্য কাজ করেন। আর স্ত্রী নূরজাহান বিবি একজন গৃহিণী। তিনি জীবিকা নির্বাহে কখনো ভ্যান চালিয়েছেন আবার কখনো কৃষিকাজ করেছেন। এ ছাড়া ইলেকট্রনিক মিস্ত্রি, সাইকেল মেরামতের মিস্ত্রির কাজও করেছেন। সর্বশেষ ভটভটি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। অল্প শিক্ষিত এ মানুষটি তার প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছেন জ্বালানি তেল এবং বিদ্যুৎ সংযোগ ছাড়াই ওয়েল্ডিং মেশিন বা ঝালাই মেশিন। তার এ প্রতিভাকে এক নজর দেখতে তার বাড়িতে ভিড় করছেন এলাকাবাসী। এলাকাজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তার এ প্রতিভাকে বিকশিত করা সম্ভব বলে মনে করছেন সচেতন এলাকাবাসী। পলিথিন থেকে জ্বালানি তেল তৈরি করা হলে বাহির থেকে যেমন তেলের আমদানি কমবে। অপরদিকে ক্রেতারা সাশ্রয়ী মূল্যে তেল পাবেন। সেই সঙ্গে চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। পলিথিন থেকে শুধু জ্বালানি তেলই নয়, বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ওয়েল্ডিং মেশিনও (ঝালাই মেশিন) তৈরি করছেন তিনি। ১২ ভোল্টের তিনটি ড্রাইসেল (শুষ্ক) ব্যাটারি দিয়ে তৈরি এ মেশিন দিয়ে প্রায় ৫০টি স্টিক ঝালাই করা সম্ভব। নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি এ মেশিনটির খরচ পড়েছে প্রায় ৪২ হাজার টাকা।

প্রতিভাবান ইদ্রিস আলী বলেন, পরিত্যক্ত ও নোংরা পলিথিন থেকে জ্বালানি তেল তৈরি করা হচ্ছে এমন একটি ভিডিও তিনি ইউটিউব চ্যানেলে দেখেছেন। আর এ বিষয়টি তাকে গত তিন মাস থেকে ভাবাচ্ছে। এরপর ভাবনার বিষয়টি তিনি বাস্তবে রূপদান করেন। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে বাজার থেকে একটি টিনের তেলের বড় ড্রাম (ব্যারেল), একটি মাঝারি প্লাস্টিকের ড্রাম, ছোট দুটি কন্টিনার, প্রায় ১৫ ফুট স্টিলের চিকন পাইপ, কয়েক হাত প্লাস্টিকের ফিতা কিনেন। এরপর গত ২১ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) থেকে জ্বালানি তেল তৈরি শুরু করেন। তিনি বলেন, নোংরা ও পরিত্যক্ত পলিথিন ১০ টাকা কেজি করে টোকাইদের কাছ থেকে কিনে নেন। এরপর বিশেষ প্রক্রিয়া পলিথিনগুলো টিনের ড্রামে ভরে প্রায় আধাঘণ্টা ড্রামের নিচে খড়ি দিয়ে জ্বাল দেন। এরপর ড্রাম থেকে নির্গত গ্যাস স্টিলের পাইপ দিয়ে এসে প্লাস্টিকের ড্রামের মধ্যে রাখা পানিতে ঠান্ডা হয়ে পেট্রল এবং ডিজেল ছোট কন্টিনারে এসে জমা হচ্ছে। সাত কেজি পলিথিন থেকে প্রায় ৫ লিটার পেট্রল জাতীয় পদার্থ, আধা লিটার ডিজেল বের করতে সক্ষম হয়েছি। তবে গ্যাস ধরে রাখার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় পুনরায় টিনের ড্রামের জ্বালানির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর এ পেট্রল দিয়ে ইতিমধ্যে মোটরসাইকেলে জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে সবকিছু খরচ বাদ দিয়ে ৬০ টাকা লিটার হিসেবে বাজারজাত করা সম্ভব। তবে দরিদ্রতার কারণে আধুনিক যন্ত্র কেনা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন। এ জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেছেন।

মান্দা উপজেলা নির্বাহী অফিসার খন্দকার মুশফিকুর রহমান বলেন, ইদ্রিস আলী নামে ওই ব্যক্তির উদ্ভাবনটির কথা শুনেছি। তবে এর কার্যকারিতা কতটুকু ও পরিবেশ সম্মত কি না তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্ণয়ের মাধ্যমে পরবর্তী ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যাবে। তার উদ্ভাবনী নমুনা আমরা কর্তৃপক্ষ বরাবর পাঠাব। তবে আমরা স্থানীয় প্রশাসন তাকে স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে তাকে পৃষ্ঠপোষকতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

নওগাঁ সরকারি কলেজ রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হেলালুর রহমান বলেন, পলিথিন এবং পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন তেল, মবিল ও গ্যাসের মধ্যে একই উপাদান হাইড্রো কার্বন বিদ্যমান। পলিথিন হচ্ছে ইথিলিনের পলিমার। ছোট ছোট অণুকে একত্রে করে বড় করা হয়েছে। কার্বনের সংখ্যা যত কম হবে সেটা তত হালকা হবে এবং কার্বন সংখ্যা বেশি হলে যৌগ তত ভারী হবে। তবে পলিথিন পুড়িয়ে যে জ্বালানি বের করা হচ্ছে তা উচ্চতর পরীক্ষার প্রয়োজন।