শনিবার, ১১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঠাকুরগাঁওয়ের সাইকেল কন্যাদের গল্প

আবদুল লতিফ লিটু, ঠাকুরগাঁও

ঠাকুরগাঁওয়ের সাইকেল কন্যাদের গল্প

কখনো রোদে পুড়ে, কখনো বৃষ্টিতে ভিজে, কখনোবা কুয়াশা ভেদ করে ছুটছে ঠাকুরগাঁওয়ে সাইকেল বালিকারা। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে প্রতিদিন পাড়ি দিচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের স্কুলের মেয়েরা।

বাইসাইকেলে করে বালিকারা স্কুলে যাওয়া-আসা করছে নিয়মিত। তাই এরা সবাই সাইকেল বালিকা নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তাদের সাইকেল বহর যখন শুরু হয়, পথচারীরা সেই দৃশ্য মনোযোগ দিয়েই অবলোকন করে। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার প্রায় প্রতিটি বিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু কিংবা শেষ হলে এমন মনোরম দৃশ্য চোখে পড়ে। বিশেষ করে গিলাবাড়ি, জামালপুর, ভাউলার হাট, সালন্দর, আঁকচা, খোঁচাবাড়ি, চিলারং, আউলিয়াপুর ইউনিয়ন থেকেও মেয়েরা আসে বাইসাইকেলে স্কুল-কলেজে।

তবে এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পেছনের কাহিনি সুখকর নয়। শুধু শিক্ষার আলো পেতে প্রতিদিন এত দূরের পথ পাড়ি দিচ্ছে তারা। ওরা কেউই ধনী ঘরের সন্তান নয়। তারা কেউ শ্রমিক, কেউ দিনমজুর বাবা কিংবা মায়ের সন্তান। এলাকার সঞ্চয় সমিতি থেকে কিস্তিতে টাকা নিয়ে মেয়েদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে বাইসাইকেল কিনে দিয়েছেন। তবুও শিক্ষার আলো পৌঁছুক তাদের ঘরে, এটাই প্রত্যাশা তাদের।

সদর উপজেলার গিলাবাড়ি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইকেল বালিকা আশরাফি ফাইমদা জানায়, পড়াশোনার অনেক খরচ। তবু তাদের পড়াশোনা করে অনেক বড় হতে হবে। তাদের এলাকা থেকে স্কুলে আসতে গাড়ি কিংবা রিকশা পাওয়া যায় না। পেলেও আসা-যাওয়ায় প্রতিদিন ৪০-৫০ টাকা লাগে। তাই বাইসাইকেল কিনে দিয়েছেন তার বাবা-মা। একই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া আক্তার বলেন, বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ায় প্রথম প্রথম বখাটে ছেলেদের উৎপাতসহ ছোটখাটো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটত। বিশেষ করে দীর্ঘ পথ কাঁচা রাস্তা থাকায় বর্ষা মৌসুমে পিচ্ছিল পথে দুর্ঘটনা ঘটছে। তবুও এখন সবই সহে গেছে। নবম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী উর্মী কুন্ডু বলেন, আগে বাইসাইকেল চালালে গ্রামের মানুষ বিভিন্ন কথা বলত। এখন আর কেউ কিছু বলে না। কম সময়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করতে পারায় বাকি সময়টা পড়ার টেবিলে দিতে পারি। এদিকে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের স্থানীয় বে-সরকারি সংস্থা ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ইএসডিও ঠাকুরগাঁওয়ের ৫ উপজেলায় দুই শতাধিক বাইসাইকেল দেন। এদের সবাই দরিদ্র পরিবারের সদস্য। তাদের পরিবার থেকে সাইকেল কিনে দেওয়ার মতো সমর্থ্য নেই। তাই পিছিয়ে পড়া এসব শিক্ষার্থীর লেখাপড়া যেন থেমে না যায় সেজন্য এই সহযোগিতা বলে জানায় ইএসডিও কর্তৃপক্ষ। ইএসডিওর নির্বাহী পরিচালক ড. মুহম্মদ মহীদ উজ জামান বলেন, বাইসাইকেল পেয়ে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারছে। এখন তাদের লেখাপাড়ায় মনোনিবেশও হয়েছে। উৎসাহ পাওয়ায় কেউ কেউ ভালো রেজাল্টও করছে বলে জানান তিনি। আগামীতে এ ধরনের উদ্যোগ আরও বড় পরিসরে করার কথা জানান তিনি।  সদর উপজেলার গিলাবাড়ি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহজাহানর-ই-হাবিব বলেন, গ্রামাঞ্চলের মেয়েরা আর পিছিয়ে নেই। তারাও এখন শিক্ষায় এগিয়ে গেছে। তারা এখন অনেক দিন থেকে সাইকেলে চড়ে বিদ্যালয়ে আসে। নানা রকম সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ করছে। স্কুল শেষে পরিবারের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করছে। অনেক দূর থেকে মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসতে প্রথমে রাস্তায় বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিত, মানুষ হাসাহাসি করত। এখন আর কোনো সমস্যা হয় না।  মেয়েরা যখন দলবদ্ধ হয়ে আসা-যাওয়া করে পথচারীরা সরে দাঁড়ায়। 

ঠাকুরগাঁও সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, শিক্ষা ক্ষেত্রে এখন বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলের মেয়েরা অনেক এগিয়ে। তারা বাইসাইকেল চালিয়ে স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসা করছে। এতে শিক্ষার্থীদের সময় নষ্ট হচ্ছে না। পাশাপাশি বখাটেদের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। তবে বাইসাইকেল চালক শিক্ষার্থীদের বেশি করে পুষ্টিযুক্ত খাদ্য দিতে হবে, যাতে পুষ্টির অভাব না হয়। ঠাকুরগাঁও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাদেক কুরাইশী বলেন, মেয়েরা এখন সামাজিক বাধা অতিক্রম করে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। পড়ালেখায় ছেলেদের চেয়ে জেলার মেয়েরা এগিয়ে আছে। তাদের সার্বিক সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি। ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক ড. কে এম কামরুজ্জামান সেলিম বলেন, এ জেলার মেয়েরা সাইকেলযোগে স্কুলে যাওয়া- আসা করে এটা প্রমাণ করেছে মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের যাত্রায় কোনো বাধা কিংবা বিপত্তি হলে আমরা দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আমরা সব সময় সজাগ আছি। জেলা প্রশাসক আরও বলেন, আগে বিদ্যালয়ে মেয়েদের উপস্থিতি কম হতো। এখন দিন দিন বাড়ছে বলে জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর