শনিবার, ১৫ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

পা হারা এভারেস্টজয়ী অরুণিমা সিনহা

সাইফ ইমন

পা হারা এভারেস্টজয়ী অরুণিমা সিনহা

এভারেস্ট হয়ে আফ্রিকার কিলামানজারো, ইউরোপের আলবারুসসহ অরুণিমা একে একে জয় করেছেন সব শৃঙ্গ। এই অরুণিমাই দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছিলেন ২০১১ সালে। এরপর থেকেই মনের জোরে তিনি পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছেন আবারো যে মানুষ চাইলে সবই পারে। কোনো কিছুই তাকে আটকে রাখতে পারে না। অরুণিমা নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন। হার্ড ওয়ার্ক আর ডিটারমিনেশন থাকলে সব সম্ভব বলে বিশ্বাস করেন তিনি। কখনো যদি কারও মনে হয় যে তাকে দিয়ে কিছু হবে না তবে শুধু অরুণিমা সিনহার দিকে তাকান। প্রথম পঙ্গু নারী হিসেবে মাউন্ট এভারেস্ট ও মাইন্ট ভিনশন জয় করেছেন তিনি।

পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেওয়া অরুণিমা পেয়েছেন পদ্মশ্রী অ্যাওয়ার্ড। ২০১৫ ও ২০১৬ দুই বছর পেয়েছেন তেনজিং নোরগে ন্যাশনাল অ্যাডভেঞ্চার অ্যাওয়ার্ড, গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ২০১৮ সালে। তা ছাড়া ২০১৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব স্ট্রেথক্লাইড, গ্লাসগো থেকে পেয়েছেন ফার্স্ট লেডি অ্যাওয়ার্ড। অথচ ১১ এপ্রিল ২০১১ সালে ২৩ বছর বয়সে দুই পা হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন অরুণিমা। ঠিক তার দুই বছরের মাথায় এভারেস্ট জয়ের পর তিনি বলেছিলেন, ‘এভারেস্টের চূড়ায় আমি অনেক জোরে চিৎকার করতে চেয়েছিলাম তাদের উদ্দেশে, যারা বলেছিল আমি পারব না, যারা আমাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে রাখতে  চেয়েছিল। যারা চেয়েছিল আমি স্টেট গভর্নমেন্টের অনুকম্পায়  বেঁচে থাকি।’ অথচ এই মেয়েটির পায়ের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল ট্রেন। তাও আবার একটি দুটি নয়। মোট ৪৯টি ট্রেন অরুণিমার পায়ের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছিল সেই দুর্ঘটনার রাতে। তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল ট্রেন থেকে।

ইন্ডিয়ার উত্তর প্রদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে অরুণিমা ন্যাশনাল ভলিবলে চ্যাম্পিয়ন। ‘সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স’ এর চাকরির পরীক্ষা দিতে সেদিন দিল্লি যাওয়ার ট্রেন ধরেছিল। সঙ্গে ছিল একটি সোনার চেইন। এক ছিনতাইকারীর নজর পড়েছিল সেই গলার চেইনে। চেইনটা ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করল সে। কিন্তু অরুণিমা এত সহজে হার মানবে না। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে অরুণিমাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দেয় ছিনতাইকারী। ঠিক সে সময়ই অপর পাশের লাইন দিয়ে আরেকটি ট্রেন আসছিল ধেয়ে।

অরুণিমা পড়ে যাওয়ার পর আর নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার সময় পাননি। এরই মধ্যে উল্টো পাশ দিয়ে আসা ট্রেনটা চলে যায় অরুণিমার পায়ের ওপর দিয়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণ জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান ফিরে এসেছে তখন পৃথিবীটাই বদলে গেছে অরুণিমার। শরীর প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছিল। কোনোভাবেই নিজের দেহটাকে উঠাতে পারছিলেন না। এক পা কাটা পড়েছে অন্য পায়ের হাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। অরুণিমার মনে হচ্ছিল তিনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন। সে রাতে ৪৯টা ট্রেন তার পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়। ভাইব্রেশন হলে বুঝতেন অরুণিমা যে ট্রেন যাচ্ছে এ ছাড়া তার আর কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না। প্রতিটা ট্রেন যাওয়ার সময় পায়ের হাড়গুলো বের হয়ে যেতে চাইত। অরুণিমা বেঁচে ছিলেন। কারণ তাকে যে পৃথিবীর ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে। এভাবেই এক সময় কঠিন সেই রাত শেষে সকাল হয়। অরুণিমাকে গ্রামবাসীরা খুঁজে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসে। অরুণিমা ন্যাশনাল লেভেল প্লেয়ার হওয়ায় ভালো চিকিৎসা সুবিধা পান। কিন্তু পত্রিকায় তাকে নিয়ে তখন ভুল খবর ছাপা হতে শুরু করল যে অরুণিমাকে কেউ ধাক্কা দেয়নি। সে নিজেই আত্মহত্যা করতে চেয়েছে। পুলিশ রিপোর্টে বলা হলো, ‘অরুণিমা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন বা রেল লাইন পার হতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছেন। তাকে ধাক্কা দেওয়া হয়নি’। এসব দেখে প্রচ- রাগ জমেছিল অরুণিমার ভিতরে। হাসপাতালের বিছায় থেকেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন অরুণিমা, ‘যেহেতু ভগবান আমাকে বাঁচিয়েই রেখেছেন, সুতরাং আমাকে নিয়ে তার কোনো একটা প্ল্যান তো আছেই। আমি এবার মাউন্টেরিয়ান হব। চড়ব এভারেস্টের চূড়ায়।’ তাই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমে সোজা তিনি চলে যান ১৯৮৪ সালে প্রথম ইন্ডিয়ান নারী হিসেবে এভারেস্ট জয় করা বেসেন্দ্রী পালের কাছে। এই বেসেন্দ্রী পালের অনুপ্রেরণায় একসময় এভারেস্ট জয় করেন অরুণিমা। স্পন্সর পেতে সমস্যা হচ্ছিল কিন্তু একসময় স্পন্সরই পেয়ে যান অরুণিমা। তারপর একে একে পৃথিবীর বৃহত্তম সব শৃঙ্ঘ জয় করেন তিনি। সর্বশেষ অ্যান্টার্কটিকার মাউন্ট ভিনশন জয় করে নিজের সামিট কমপ্লিট করেছেন। এভাবেই একে একে একটির পর একটি রেকর্ড নিজের করে নিয়েছেন অরুণিমা। যে পুলিশ আর পত্রিকা তাকে নিয়ে ভুল সংবাদ ছেপেছিল তাদের এক হাত নিয়েছিলেন অরুণিমা সিনহা। সেই ভুল রিপোর্টকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে আদালতে গিয়েছিলেন অরুণিমা। হাই কোর্টের রায়ে তাকে ধাক্কা দেওয়া হয়েছিল এটাই প্রমাণিত হয়েছিল।

সর্বশেষ খবর