শনিবার, ১৫ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ফ্রিল্যান্সিংয়ে জেবার ভাগ্য বদল

শামীম আহমেদ

ফ্রিল্যান্সিংয়ে জেবার ভাগ্য বদল

ছোটবেলায় হারিয়েছেন মাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির এক বছরের মাথায় হারান বাবাকে। নিজের কাঁধে তুলে নেন সংসারের দায়িত্ব। পাশাপাশি শেষ করেছেন উচ্চশিক্ষা। স্বাধীনভাবে কিছু করা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, নিজের টাকায় বিভিন্ন স্বাদ-আহ্লাদ পূরণের ইচ্ছা জেবার মধ্যে কাজ করত স্কুলজীবন  থেকেই। সেই স্বপ্নে গতি সঞ্চার করে সংবাদপত্রে ‘অনলাইনে উপার্জন’ বিষয়ক একটি ফিচার প্রতিবেদন। বদলে যায় জেবার দিনের সব রুটিন। সহপাঠীরা যখন আড্ডায় ব্যস্ত, জেবা তখন ব্যস্ত ইন্টারনেটে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল আর আর্টিক্যাল ঘাঁটাঘাঁটিতে। ফল পেতে সময় লাগেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই জেবা হাতে পান ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয়ের প্রথম অর্থ। তখন ২০১১ সাল। ইন্টারনেট থেকে তিন দিনে আয় করেন ৩৫ ডলার। বর্তমান সময়ের হিসাবে প্রায় তিন হাজার টাকা। সেই শুরু। রোজগারের পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা। চট্টগ্রামের মেয়ে জেবা ইসলাম ২০১৭ সালে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করলেও ফ্রিল্যান্সিং ছেড়ে দেননি। উল্টো ফ্রিল্যান্সিংয়ের পাশাপাশি শুরু করেছেন ই-কমার্স। এখন জেবার মাসিক আয় বাংলাদেশের প্রথম সারির যে কোনো চাকুরের চেয়ে কম নয়। ঘরে বসেই কাজ করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য। অনলাইনে বিক্রি করেন বিভিন্ন পণ্য।

চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করা জেবা ইসলামের বাড়ি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকার হাজিপাড়ায়। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে জেবা দ্বিতীয়। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অনেক আগেই মাকে হারিয়েছি। বাবাও আমাদের রেখে পৃথিবী ছেড়ে যান ২০১২ সালে। তখন মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করেছি। বাবাকে হারিয়ে ঘোর অন্ধকারে পড়ি। সংসার খরচ, আমার লেখাপড়া...। এই শিক্ষাগত যোগ্যতায় চাকরিও মিলবে না। সবদিক বিবেচনা করে অনলাইন আয়ের দিকে মনোযোগ দিই। যদিও শুরুটা এক বছর আগেই করেছিলাম। এবার এটাকে আমার প্রয়োজন মেটানোর অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নিই। আত্মবিশ্বাস ছিল আমি পারব। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই পাওয়া ৩৫ ডলারের কাজটি আমার আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু, কোর্স করতে অনেক টাকা লাগে। তাই ইউটিউব আর গুগল থেকে শিখতে থাকি। এর মধ্যে এক্সপোনেন্ট (আইটি প্রতিষ্ঠান)-এর কাশেম ভাইয়ের সহযোগিতায় কিছু কোর্স করার সুযোগ পাই। এটা শুরুতে আমাকে দাঁড়াতে সহযোগিতা করেছে। শুরুতে কারও দিকনির্দেশনা এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য আর ‘আমি পারবই’ এমন চিন্তা। পরে নিজের আয়ের টাকা দিয়ে বিভিন্ন কোর্স করেছি। বলা যায়, ২০১৪ সাল থেকেই সংসার মোটামুটি আমার উপার্জনে চলছে।

ফ্রিল্যান্সিংয়ে আসা প্রসঙ্গে জেবা বলেন, ‘ছোটবেলা  থেকেই আমরা বাড়িতে পত্রিকা পড়ি। নিয়মিত খবরে দেখতাম শিক্ষাজীবন শেষে দেশের লাখো তরুণ-তরুণী বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে হতাশায় দিন পার করছেন। মাঝে মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনাও  দেখতাম। কোন বিষয়ে লেখাপড়া করলে বেকার থাকতে হবে না তা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতাম।  ছোটবেলায় মাকে হারানোয় নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তাগিদটা বোধহয় একটু আগেভাগেই আসে আমার মধ্যে। এরই মধ্যে সংবাদপত্রে ‘অনলাইনে উপার্জন’ নিয়ে একটি প্রতিবেদন আমাকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করে। একটা কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ আর কাজ জানা থাকলে ঘরে বসেই লাখ টাকা উপার্জন সম্ভব। এরপর ইন্টারনেটে এ নিয়ে বিভিন্ন আর্টিক্যাল পড়তে থাকি। ইউটিউবে নানা ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখি। তখন ২০১০ সাল। টিউটোরিয়াল দেখে কিছু কাজ শিখে অনলাইন মার্কেট প্লেসে বিড করতে শুরু করি। ২০১১ সালে এসে ওডেক্সে ৩৫ ডলারের একটি লিংক বিল্ডিংয়ের কাজ পাই। সেই শুরু। বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করে আইন বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। পড়াশোনা আর ফ্রিল্যান্সিং একসঙ্গে চালিয়েছি। এখন আমার  বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্লায়েন্ট আছে। যাদের লিড  জেনারেশন ও আউটরিচের কাজটা আমি দীর্ঘদিন ধরে করছি। ২০১২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি  কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছি। দৈনিক ৫-৬ ঘণ্টা কাজ করি। এ ছাড়া ফ্রিল্যান্সিংয়ের পাশাপাশি আমি  ছোট করে ফেসবুক পেজভিত্তিক ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করেছি। যদিও এটা নতুন। তবে এই ব্যবসাকে ঘিরে আমার স্বপ্ন অনেক বড়। সবমিলে অনলাইন প্লাটফরম থেকে আয় নিয়ে আমি সন্তুষ্ট। এখানে কাজে স্বাধীনতাও আছে। তবে এখানে কেউ এক বছরেই ভালো অবস্থানে চলে যান, কারও চার-পাঁচ বছরও লেগে যায়। তাই ধৈর্য থাকতে হবে। শুরুর দিকে আয় কম হলেও তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে।

জেবা বলেন, আগে বিদ্যুৎ আর ইন্টারনেট সমস্যার কারণে ফ্রিল্যান্সিং করা কঠিন ছিল। এখন সেই সমস্যা তেমন নেই। আপওয়ার্ক, ফাইবার, ফ্রিল্যান্সারডটকম, পিপল পার আওয়ার, ডিজাইনস, ডিজাইন ক্রাউড, স্টুডিও ইনভাতো, গুরুডটকম, উই ওয়ার্ক রিমোটলি, ক্রিউÑ এসব মার্কেট প্লেসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনেক কাজ থাকে। কেউ নিজেকে দক্ষ করতে পারলেই সে এখান থেকে কাজ করে আয় করতে পারে। তবে আমাদের এখানে ভালো মানের প্রশিক্ষণ সেন্টারের অভাব আছে। এছাড়া ইংরেজির দুর্বলতার কারণেও এই খাতে আমরা পিছিয়ে আছি। ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভালো করতে কাজে দক্ষতার পাশাপাশি ইংরেজি জানাটা খুব জরুরি। আপনি ভালো কাজ জানেন কিন্তু ইংরেজি জানেন না, তাহলে যোগাযোগ করে কাজ নিতে পারবেন না। আবার ইংরেজি জানেন কিন্তু ভালো কাজ জানেন না, তাহলে শুরুতে দুই-একটা কাজ জোগাড় করতে পারলেও ভবিষ্যতে এই পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। এটা বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব ফ্রিল্যান্সারের জন্য ক্ষতিকর। অনেকেই ভালো করে কাজ না শিখে এই সেক্টরটার ক্ষতি করছে। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন বাংলাদেশিদের কাজ দিতে চায় না। দিলেও মজুরি কম দেয়। অবশ্য এর মধ্যেও অনেকে ভালো রোজগার করছে। কেউ তো মাসে ১০ লাখ টাকার বেশিও উপার্জন করছে।’

তিনি বলেন, ফ্রিল্যান্সিংয়ে টিকে থাকতে প্রতিনিয়ত নিজেকে আপডেট করতে হয়। আমি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কাজ শিখছি। ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গুগল এডসেন্স, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল পেইড মার্কেটিং এবং এফিলিয়েট মার্কেটিং কোর্স করেছি। ঘরে বসে ৫০ হাজার টাকা রোজগার করতে কী করতে হবেÑ এমন প্রশ্নে জেবা বলেন, দক্ষ হলে এটা কোনো ব্যাপারই নয়। আবার অদক্ষদের জন্য ১০ হাজার টাকা আয় করাও কঠিন। বাংলাদেশের অনেকেই ঘণ্টায় ২৫ ডলারের বেশি রেটে কাজ করেন। সেক্ষেত্রে তার কাজ করতে হবে ২৮ ঘণ্টার মতো। তবে নতুনরা সাধারণত ঘণ্টায় ৩ থেকে ১০ ডলার রেটে কাজ করেন। কাজের ধরন ও কর্মীর দক্ষতার ওপর রেট নির্ভর করে। গ্রাফিক্স, মার্কেটিং, প্রোগ্রামিং, ওয়েব ডিজাইনের প্রচুর কাজ মার্কেটে।  রেটও মোটামুটি ভালো। এ খাতে আবার ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যাও বেশি। ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপস ডেভেলপন্টের চাহিদা এখন ভালো। আর্টিকেল লিখেও অনেকে ভালো আয় করছেন। ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্নের কথা জানাতে গিয়ে জেবা বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের জন্য আইন পেশায় থাকব। তবে আমার মূল লক্ষ্য অনলাইন পেশা। এখন ফ্রিল্যান্সিং করছি। সামনে নিজের ফ্যাশন,  কোথিং আর বিউটি প্রোডাক্ট নিয়ে ই-কমার্স ব্যবসা  তৈরি আমার বর্তমান স্বপ্ন। এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছি। এখন এটাকে বড় করে তোলাই কাজ।

সর্বশেষ খবর