শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

জীবনযুদ্ধে সফল যোদ্ধা শেফালী রানী

এস এম রেজাউল করিম, ঝালকাঠি

জীবনযুদ্ধে সফল যোদ্ধা শেফালী রানী

বর্তমানে বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে নারীদের সমান অবদান। সব কাজে নারীদের অংশগ্রহণ সমানভাবে থাকলেও নরসুন্দরের (নাপিত) পেশায় সাধারণত নারীদের দেখা যায় না। ঝালকাঠি জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলার শৌলজালিয়া ইউনিয়নের বলতলা বাজারে দেখা গেল এক নারী নরসুন্দরের কাজ করছেন। প্রমাণ করেছেন কবির সেই উক্তিকে ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণ কর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’।

আজ থেকে ১২ বছর আগের কথা। স্বামী জগদীশ পক্ষাঘাতে পড়লে গোটা সংসারের ভার পড়ে শেফালীর কাঁধে। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। সংসারে ৪ মেয়ে ১ ছেলের ভরণপোষণ ও লেখা-পড়ার ব্যয়ভার তিনি কীভাবে বহন করবেন? এমন পরিস্থিতিতে আমাদের দেশের রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে পুরুষের চুল-দাড়ি কাটার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তবে গ্রামের কতিপয় লোক অভাব দেখে তাকে সহযোগিতার হাতও বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমনকি তারা নিজেরা টাকা তুলে একটি সেলুন পরিচালনার জন্য তাকে একটি চেয়ারও কিনে দিয়েছিলেন। তার স্বামীর পেশাও ছিল এটি। নরসুন্দর পেশাকে জীবনধারণের অবলম্বন হিসেবে বেছে নেন শেফালী রানী। অতঃপর কঠোর সংগ্রামে খেয়ে না খেয়ে জীবন থেকে কেটে যায় ১২টি বছর। বড় মেয়ে তপতী ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে দারিদ্রতার কষাঘাতে আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেনি। বছর ঘুরতেই তার পেশার এক ছেলের সঙ্গে বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। এরই মধ্যে ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়ছে। মেজো মেয়ে বিথিকা ডিগ্রিতে, সেজো মেয়ে তনুমালা ১০ম শ্রেণিতে, ছোট মেয়ে সাগরিকা নবম শ্রেণিতে ও একমাত্র ছেলে পলাশ এইচএসসিতে লেখাপড়া করছে। এর মধ্যে ৪-৫ বছর আগে জগদীশ হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এ অবস্থায় চলছিল শেফালীর সংসার-জীবন সংগ্রাম। সম্প্রতি শেফালীকে নিয়ে আন্তর্জাতিক অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘বিবিসি’ একটি প্রতিবেদন করে।

আর সেই সংবাদকে কেন্দ্র করে ঘুরে যায় এ নারীর জীবনের ভাগ্যের চাকা। তার সংগ্রামী জীবনের গল্প খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবেগাপ্লুত করে। ফলে প্রধানমন্ত্রীও উদ্যোগ রাখেন সংগ্রামী শেফালী রানীর জীবনকে এগিয়ে নিতে। 

মূলত তার নির্দেশনার আলোকেই সম্প্রতি দুর্যোগ ও ত্রাণমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান দ্রুত ছুটে যান ঝালকাঠির সেই অজপাড়াগাঁয় শেফালী রানীকে খুঁজতে। গত ৮ জুলাই মন্ত্রী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে নারীকে জমিসহ একটি বসতঘর তুলে দেওয়ার সব প্রস্তুতির কথা জানিয়েছেন এবং সে সময়েই শেফালী রানীর হাতে ৪ শতাংশ জমির কাগজপত্রও তুলে দেন।

জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, ইতিমধ্যে সেই জমিতে ঘর তৈরির কাজও শুরু করে দিয়েছে কাঁঠালিয়া উপজেলা প্রশাসন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রতিনিয়ত শেফালীর ঘরের কাজের তদারকি করছেন।

প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে জমিসহ ঘর পেয়ে খুশিতে আত্মহারা শেফালী রানী। কাঁঠালিয়ার পশ্চিম ছিটকী গ্রামের দরিদ্র যাদব শীলের চতুর্থ সন্তান শেফালী রানী। দারিদ্রতার কারণে ৫ম শ্রেণি পর্যন্তই লেখাপড়ার সুযোগ হয়েছে তার। নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দরিদ্র পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে আতর আলী গ্রামের বিশ্বনাথ শীলের সঙ্গে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। শুরু হয় দারিদ্রতার সঙ্গে মানিয়ে চলার জীবনযুদ্ধ। জীবনকে বুঝে ওঠার আগেই ৪ মেয়ে ও ১ ছেলের মা হন তিনি। স্বামীর অবহেলা ও বেপরোয়া উদাসী জীবনযাপনের কারণে তার জীবন বিষিয়ে ওঠে। এত কিছুর পরেও হাল ছাড়েননি শেফালী। প্রথমে তার পিতার বাড়িতে থাকা শুরু করেন। এক সময় পিতার বাড়ি থেকে বলতলা গ্রামের দোগনা বাজারে চলে আসেন। সেখানে আসার পরও স্বামী কাজ করতেন। তিনি জানান, চুল-দাড়ি কাটার কাজটি শিখেছিলেন তার স্বামীর কাছ থেকেই।

আলাপচারিতায় তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে নিজের পেশার নানা প্রতিবন্ধকতার বিষয় তুলে ধরেন। অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটালেও ছেলেমেয়েদের মানুষ করার চেষ্টা করছেন। তাদের কাউকে কোনো কাজ করতে দেননি। সংসার চালিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বাড়তি খরচ জোগাতে তিনি দিনে চুল-দাড়ি কেটে রাতে আবার ওই বাজারের দোকানে দোকানে পানি সরবারাহ করছেন। এমন পেশায় আসায় প্রথমে শেফালী রানীকে অনেকে আড়চোখে দেখলেও হার মানেননি তিনি। জীবন-জীবিকা নির্বাহে এ পেশায় অটল থাকেন তিনি। অবশ্য ধীরে ধীরে মানিয়ে নেন সবাই। পরবর্তীতে তাকে অনেকে সাহায্যও করেছেন। বরাদ্দ পাওয়া শেফালীর বসতঘরে যা আছে : তিনটি বেড রুম, একটি বাথরুম ও একটি রান্নাঘর। তবে শেফালীর প্রত্যাশা ছিল একটি আধুনিক সেলুন। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে যাতে ভালো সেবা দেওয়া যায়। সরকারের কাছে কোনো চাওয়া আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, তার মেজো মেয়ে বিথিকা কিছুদিন আগে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। তাকে যদি একটি চাকরির ব্যবস্থা করা হয় তবে আর্থিকভাবে নিশ্চয়তা পাবেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি তার মেয়ের জন্য একটি চাকরির ব্যবস্থা করে আবেদন রেখেছেন। 

এ ব্যাপারে কাঁঠালিয়া উপজেলার চেচরিরামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহমুদ হোসেন রিপন জানান, শেফালী রানীর স্বামী জগদীশ অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর একটি হুইল চেয়ার প্রদান করেন তিনি। পরে জগদীশ নিরুদ্দেশ হওয়ার পর স্বামী পরিত্যক্তা ভাতা ভিজিডির চাল দেওয়া হলেও পরিবারের সদস্য সংখা বেশি হওয়ায় তা দিয়ে তাদের জীবন চলছিল মন্থর গতিতে। তাকে জমি ও ঘর দেওয়ায় এলাকাবাসীর পক্ষ থেকেও ধন্যবাদ জানান তিনি। তিনি আরও বলেন, প্রথমে ২ লাখ ৫৮ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হলেও বড় পরিবারের কথা চিন্তা করে ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

রিপন চেয়ারম্যান আরও বলেন, তিনি তার নিজস্ব অর্থায়নে বাজারে একটি আধুনিক সেলুন করে দেবেন, যাতে তা থেকে অর্জিত অর্থে শেফালীর পরিবারের জীবন চালতে পারে। শেফালীর স্কুলপড়–য়া ২ মেয়েকে স্কুলে যাওয়ার জন্য দুটি বাইসাইকেল দেওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী জানান, শেফালীকে প্রধানমনন্ত্রীর দেওয়া ঘরের কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। তার কর্মসংস্থানের জন্য কী করা যায় আলোচনা করে দেখছি। আমাদের প্রশাসন তার সব ধরনের প্রয়োজনে পাশে রয়েছে।’

 

সর্বশেষ খবর