শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বহু সংস্কৃতির বিশ্বনগরী লন্ডন

বহু সংস্কৃতির বিশ্বনগরী লন্ডন

যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডন হচ্ছে বহুমাত্রিক সংস্কৃতির এক শহর। এখানে যে যার ইচ্ছামতো চলছে, ফিরছে, পোশাক পরছে কেউ কারও দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।

নারী ও পুরুষের মধ্যে পার্থক্য নেই বললেই চলে! কেউ সবাই যেমন যে যার মতো নিজের ভাষা ব্যবহার করে, তেমনি পোশাক-আশাকেও কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই।

এখানকার নারীরা যে সম্পূর্ণ স্বাধীন তা পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচার-আচরণ দেখলেই বোঝা যায়। কেউ ঢিলেঢালা জামা পরছে, কেউ বা বোরখায় নিজেকে আবৃত করে রাখছে। আবার কেউ এমন পোশাক পরছে শরীরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সবই দেখা যাচ্ছে। একই আড্ডায় কেউ মুখে নেকাব পরা, কারও বা সর্বাঙ্গ খোলা।

লন্ডনের মেয়েদের চেয়েও যেন ছেলেরা বেশি শৌখিন! হেয়ার স্টাইলে কত যে রং ঢং! এ ছাড়া শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ট্যাটু, কারও কান ফোরানো, কারও বা ঠোঁটের কোনে চকচকে ছোট্ট বলের মতো রিং লাগানো। কী  ছেলে কী মেয়ে- এই গ্রীষ্মে সবাই শর্টস পরতে দারুণ পছন্দ করেন।

পূর্ব লন্ডন তো পুরোটাই বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা। ব্রিকলেন, হোয়াইট চ্যাপেলের দিকে রাস্তা দিয়ে হাঁটলে বোঝার উপায় নেই এটি বাংলাদেশের বাইরের কোনো জায়গা। অধিকাংশ দোকানের নাম বাংলায় লেখা। সন্ধ্যার পর রাস্তার পাশেই জড়ো হয়ে আড্ডা দেন বাঙালিরা। উচ্চস্বরে কথা বলেন বাংলায়। তবে বাঙালিরা বছরের পর বছর ব্রিটেনে থেকে এখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেননি।

নিজেদের কমিউনিটি নিয়ে আলাদা বসবাস করছেন। বাঙালি সংস্কৃতিই আঁকড়ে ধরে আছেন। পাশাপাশি এ সভ্য দেশের সুন্দর নগরীতেও তারা নিজেদের বদঅভ্যাসগুলো ছাড়তে পারেননি। যেমন- এই বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় খুব সহজেই ট্র্যাফিক আইন অবজ্ঞা করা হচ্ছে! ঢাকার মতো যখন যেখানে যেভাবে ইচ্ছা তারা রাস্তা পারাপার হচ্ছে।  অথচ লন্ডনের অন্য এলাকায় এমন নেই। 

ঢাকার মতো এখানেও অনেক জায়গায় রাস্তার ওপর সব কিছু পাওয়া যায়। সচরাচর কাউকে ইংলিশে কথা বলতে দেখা যায় না। তা ছাড়া সাদা চামড়ার মানুষই তো খুব একটা দেখা যায় না। পুরো এলাকাটা বাঙালিদের দখলে। আরেকটি মজার বিষয়, এখানে হাতেগোনা যে কয়েকটি ইংলিশ পরিবার থাকে তারা নিজেদের যেন সংখ্যালঘুই মনে করে। লন্ডনে বাঙালিদের মধ্যে ৯৯ ভাগেরও বেশি বৃহত্তর সিলেটের বাসিন্দা। সে কারণে এখানকার বাঙালিরা নিজেদের ‘বাঙালি’র চেয়ে যেন ‘সিলেটি’ হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি ভালোবাসেন। ইংলিশদের কাছে বাঙালির চেয়ে সিলেটি শব্দটি যেন বেশি পরিচিত। বাঙালিদের একটা বড়গুণ এখানেও চালু রেখেছেন, তা হচ্ছে অতিথি পরায়ণতা!

লন্ডন যে কতটা অত্যাধুনিক শহর তা সহজেই অনুমান করা যায় এখানকার যাতায়াত ব্যবস্থার কথা চিন্তা করলেই। পুরো লন্ডনেই মাটির নিচে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে টিউব রেল। এখানে বাস খুব একটা জনপ্রিয় নয়। রাস্তায় সাধারণত প্রাইভেট গাড়িই বেশি চলে। সে কারণে মাঝে মাঝে জ্যামও পড়ে যায়। তবে দ্রুত যাতায়াতের জন্য টিউবই ভালো। যদিও খরচ কিছুটা বেশি, তবে এখানকার যে জীবনযাত্রার মান তার তুলনায় কিছুই নয়।

লন্ডনের মানুষরা খাবারে খুবই শৌখিন। এখানে কত দেশের রেস্টুরেন্ট যে আছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবে বেশ জনপ্রিয় ভারতীয় রেস্টুরেন্টগুলো। যদিও নামে ভারতীয় হলেও এগুলোর প্রায় সবগুলোর মালিক বাংলাদেশি। তাই খাবারও বাংলা।

ইংলিশ খাবার অনেকটা স্বাদহীন। কারণ স্বাদের চেয়েও ইংলিশদের কাছে বেশি গুরুত্ব পায় খাবারের গুণগতমান। তবে এশিয়ান পর্যটকরা ইংলিশ খাবারের চেয়ে ভারতীয় রেস্টুরেন্টে খেতেই যেন বেশি পছন্দ করেন।  তবে টার্কিস রেস্টুরেন্ট বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া পাকিস্তানি, লেবাননি এবং বর্তমানে আফগান রেস্টুরেন্টও চালু হচ্ছে।

আরেকটি অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, লন্ডনের মতো শহরেও চোখে পড়ে অনেক ভিক্ষুক। যে দেশে সরকার বেকার ভাতা, বয়স্ক ভাতা দেয় সে দেশে ভিক্ষুক কেন! এমন প্রশ্ন মাথায় আসা স্বাভাবিক। তবে ভিক্ষুকদের অধিকাংশ মানসিক ভারসাম্যহীন। অনেকের ধারণা, অতিরিক্ত নেশা করার কারণেই নাকি তারা স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেক দূরে চলে গেছে।

তবে এখানকার অধিকাংশ ভিক্ষুকই কিন্তু আভিজাত্যপূর্ণ। অনেকের পোশাক দেখে মনেই হবে না যে সে ভিক্ষা করে।

লন্ডন হচ্ছে পর্যটকের নগরী। এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ ঘুরতে আছে। তবে একটুখানি মাথা খাটালে সহজেই ব্রিটিশ এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকদের আলাদা করা যাবে। যেমন ব্রিটিশরা অত্যন্ত বিনয়ী। কারও সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হলেই মিষ্টি হাসি দিয়ে হায় বলে চলে যাচ্ছে। আবার কারও সঙ্গে স্পর্শ লাগতে না লাগতেই স্যরি বারবার দুঃখিত বলেন। কিন্তু অন্যান্য দেশের নাগরিকদের মধ্যে এ বিষয়টি লক্ষ্য করা যায় না। তা ছাড়া ভাষাগত পার্থক্য তো আছেই।

তবে লন্ডনে হাজারো সুবিধার মধ্যে প্রধান অসুবিধা হচ্ছে, এখানে ৫টার মধ্যেই সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। তাই প্রয়োজনীয় কিছু কিনতে হবে ৯-৫টার মধ্যেই।

লন্ডনের জনসংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। যা যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার এক-দশমাংশেরও বেশি। ব্রিটেনের অন্য শহর কিংবা মার্কিন শহরগুলোর তুলনায় লন্ডনের লোকসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি।  প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৪৮০ জন। লন্ডনে ১৯ শতকে আইরীয়, চীনা ও ইহুদি এবং ২০ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় উপমহাদেশীয়, ক্যারিবীয় কৃষ্ণাঙ্গ ও পূর্ব আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ অভিবাসীদের আগমনের সুবাদে লন্ডন বর্তমানে একটি বহুজাতিক, বহুভাষিক ও বহুসংস্কৃতির বিশ্বনগরীতে পরিণত হয়েছে।

 

সর্বশেষ খবর