টিনশেডের ছোট্ট একটি দোকানঘর। সেখানে কোনোভাবে ৬ জন খদ্দের বসতে পারে। ওই দোকানে মাত্র ২০ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে তিনি নেমে পড়েন ব্যবসায়। ব্যবসা বলতে চায়ের স্টল। সঙ্গে নিজ হাতে তৈরি রুটি আর ডাল। এই ছিল তার দোকনের খাবার মেনু। সেই ২০ বছরের যুবক এখন নওগাঁ জেলার শ্রেষ্ঠ হোটেল ব্যবসায়ী। তার সমান্তরাল এখনো কেউ হয়ে উঠতে পারেনি। শহরের আটা পট্টিতে সেই দোকান এখন পরিসর বাড়িয়ে নাম হয়েছে সাব্বির হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। মৃত ইদ্রিস আনসারী ও সায়রুন নেছা দম্পতির বড় ছেলে সাব্বির আনসারী। ভাই-বোনের মধ্যে তিনিই বড়। ১৯৭৪ সালে বাবার সঙ্গে সাব্বির রুটি-চায়ের দোকান শুরু করেন। দোকানে কর্মচারী বলতে ছিল সাইফুল নামের এক ছোট্ট বালক। সাব্বির নিজ হাতে বাবার সহযোগিতায় রুটি ও চা তৈরি করে পরিবেশন করতেন। এঁটো কাপ প্লেট গ্লাস নিজ হতে পরিষ্কার করতেন। এভাবে কেটে যায় ৬টি বছর। ১৯৮০ সালে এক ব্যবসায়ীর পরিবারের জন্য একদিন শখের বসে বাবার কাছে পরামর্শ নিয়ে পোলাও ও মুরগির মাংস রান্না করেন। সেদিন ২ কেজি আতব চাল ও ১০টি বাচ্চা মুরগি রান্না করেছিলেন। কোনো কারণে সেই ব্যবসায়ী পরিবার খাবারগুলো নিয়ে যায়নি। হঠাৎ সন্ধ্যার দিকে এলাকার মোস্তাক নামে এক যুবক স্টলে চা-রুটি খেতে আসেন। পোলাও দেখে তিনি খেতে দিতে বলেন। সাব্বির রান্না করা পোলাও-মুরগির মাংস তাকে খেতে দেন। মোস্তাক খেয়ে আবাক হয়ে যান। সেদিন তার জীবনের প্রথম খদ্দের মোস্তাকের কাছে হাফপ্লেট পোলাও ও হাফপ্লেট মুরগির মাংসের দাম নিয়েছিলেন মাত্র ১৩ টাকা। তখনো তিনি জানতেন না এই দামে তার পোশাবে কিনা। খাওয়া শেষে মোস্তাক দোকান থেকে চলে যান। এর কিছু সময় পর তিনি তার আরও কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ফিরে আসেন সাব্বিরের দোকানে। তাদের খেতে দেন সাব্বির। ওইদিন তাদের খাবার পর সব খাবার শেষ হয়ে যায়। সাব্বির বুঝতে পারেন হয়তো এটিই তার জন্য অপেক্ষা করছিল। পরদিন রুটির পাশাপাশি ৩ কেজি আতব চালের পোলাও ও ১২টি বাচ্চা মুরগি রান্না করেন। সেদিনও সব খাবার শেষ হয়ে যায়। অথচ তিনি জীবনে কোনোদিন পোলাও-মাংস রান্নাই করেননি। প্রথম দিনের রান্না তিনি বাবার কাছে শিখে নিয়েছিলেন। এরপর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের হাতেই চলত রান্না আর পরিবেশন। সঙ্গে ওই ছোট্ট বালক সাইফুল। দোকানের পরিধি বেড়ে দাঁড়ালো ১২ আসনে। নিজ হাতে রান্না আর পরিবেশন করায় খুব অল্প দিনেই সাব্বিরের নাম ছড়িয়ে পড়ে। দিন দিন খদ্দেরের সংখ্যা বাড়তে থাকে। স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক খদ্দের ছোট্ট দোকানটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন। এখন সাব্বিরের পাঁচতলা নিজস্ব ভবনে হোটেলের সব আয়োজন। দোতলায় হোটেল, তিন তলায় কমিউনিটি সেন্টার, ৪র্থ তলায় ভাড়ার ঘর, ৫ম তলায় রান্নার ব্যবস্থা। এখন তার হোটেলে একসঙ্গে ৫৬ জন বসে খেতে পারে। ২০১২ সালে যুক্ত হয়েছে হরেক রকম মিষ্টান্ন, সঙ্গে আছে দই। ইতিমধ্যে তার দই ও মিষ্টান্নের নামও ছড়িয়ে পড়েছে। এই দোকানের নাম দিয়েছেন সাব্বির সুইটমিট। তার রেস্টুরেন্টে বর্তমানে নারী-পুরুষ কর্মচারীর সংখ্যা ২০-২২ জন। প্রতিদিন বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার হোটেলের বিপুল পরিমাণ প্যাকেট খাবার সরবরাহ হয়ে থাকে। সরকারি ও বেসরকারি অফিসসহ কোনো অনুষ্ঠানে বিশেষ খাবার মানেই হলো সাব্বিরের পোলাও-মাংস। সাব্বির রমজান মাসে ইফতারের নানা পদের খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে থাকেন।
সাব্বির বলেন, এখনো আমি সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত হোটেলে শ্রম দিয়ে থাকি। প্রয়োজনে নিজেই কর্মচারীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে খাবার পরিবেশন করি। ২০১৮ সালে মানসম্মত খাবার ও পরিচ্ছন্নতার জন্য জেলার সেরা হোটেলের পুরস্কার পেয়েছি জেলা প্রশাসন থেকে। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সততা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রম আমাকে এতটা পথ এগিয়ে দিয়েছে। আমার তিন ভাই আমার ব্যবসায় সহযোগিতা করে। আমার লেখাপড়া করার সুযোগ তেমন হয়নি। কিন্তু আমি আমার ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করেছি। তারা আমার কথা রেখে পড়াশোনা করছে।