শিরোনাম
শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

জীবনজয়ী জমিলা বেগমের গল্প

কসাইয়ের কাজ করছেন ২০ বছর ধরে

রিয়াজুল ইসলাম, দিনাজপুর থেকে

জীবনজয়ী জমিলা বেগমের গল্প

সমাজ সংসারে নিজের পায়ে দাঁড়াতে কোনো কাজই ছোট নয়। কসাই  হোক কিংবা অন্য কিছু। তবে নারীদের এসব পার হওয়া সহজ নয়। এমনই এক সাহসী নারী, তিনি শুধু মাংস বিক্রিই নয়, হাটে গিয়ে গরু কেনা, গরু জবাই করা, মাংস কাটা, ওজন দেওয়া প্রায় সব কাজই করেন। প্রায় ২০ বছর ধরে কসাইয়ের কাজ করে মাংস বিক্রি করে চলেছেন ওই নারী।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই সাহসী জমিলা বেগম সমাজ সংসারে সব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। বাবার ভিটের পাশেই কিনেছেন জমি। নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি, ছেলেকে বিপদের মধ্যে পড়াশোনা শেখানো হয়নি। তবে তার মেয়েকে অনেক দূর লেখাপড়া করানোর ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন তিনি। জমিলা বেগমের মেয়ে এখন বীরগঞ্জের ঝাড়বাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সোহাগী বেগম।

জমিলা বেগমের (৪৭) দিনাজপুর বীরগঞ্জ উপজেলার শতগ্রাম ইউনিয়নের প্রাসাদ পাড়ায় বাড়ি। বাড়ির পাশেই ঝাড়বাড়ি হাটে মায়ের দোয়া মাংস ভান্ডার। দোকানের ভিতরে টাঙানো ব্যানারে লেখা, এখানে স্বাস্থ্যসম্মত দেশি এঁড়ে গরুর মাংস সঠিক ওজনে পাওয়া যায়। মালিক হিসেবে রয়েছেন জমিলা বেগম আর পরিচালনা করছেন জমিলার ছেলে জহুরুল ইসলাম (৩৩)।

গরু কেনায় তাকে সহযোগিতা করছেন তার ছেলে জহুরুল ইসলাম। দোকানে আছেন ছয়জন কর্মচারী। যাদের বেতন ৬ থেকে ১২ হাজার টাকা।

জানা যায়, প্রতি সপ্তাহের সোমবার বাদে ৬ দিনই মাংস বিক্রি হয়। তবে শুক্রবারে মাংস বিক্রি বেশি হয়। অন্যান্য দিনে মাংস বিক্রি হয় ৭ থেকে ১০ মণ। কিন্তু শুক্রবারে বিক্রি হয় ২০ থেকে ২৫ মণ মাংস। গড়ে প্রতিদিন ৪৫টি গরু জবাই করে মাংস বিক্রি হয়। বীরগঞ্জের, গোলাপগঞ্জ, গড়েয়া হাট, কাহারোল উপজেলার বসুনিয়া, লাহিড়ী, কালমেঘ, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ, খানসামা উপজেলা এমনকি ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী থেকেও ক্রেতা আসেন জমিলার দোকানে মাংস কিনতে। এই বাজারে মাংস ব্যবসায়ী রয়েছেন আরও চারজন। বাদশা বাজার এলাকা থেকে মাংস কিনতে আসা জামিয়ার (৪৫) বলেন, সঠিক ওজন এবং ভালো মানের গরুর মাংস পাওয়া যায়।

জমিলা বেগম জানান, কোনো দিন স্কুলের বারান্দায় যাওয়া হয়নি জমিলা বেগমের। ১৫ বছর বয়সে জমিলার বাবা পান ব্যবসায়ী জাকির হোসেন মেয়েকে বিয়ে দেন বগুড়ার গোকুল উত্তর পাড়ার সমিল বন্দর এলাকার রফিকুল ইসলাম ভান্ডারীর সঙ্গে। তিনি পেশায় একজন কসাই। ভালোই চলছিল দিনগুলো। এক সন্তান জন্মের কিছুদিন পর স্বামী রফিকুল ইসলাম ভান্ডারী মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। ব্যবসাটা হারিয়ে যাচ্ছিল। ২০০০ সালের শেষ দিকে স্বামীসন্তানসহ বাবার বাড়ি বীরগঞ্জের ঝাড়বাড়ি এলাকায় চলে আসেন জমিলা। বাবার সামান্য জমি বিক্রি করে বাজারে একটি দোকানে স্বামীসহ আবারও মাংসের দোকান শুরু করেন। ছেলে জহুরুল তখন নবম শ্রেণির ছাত্র। ব্যবসা ভালো চলছিল।

পরিবারেও শান্তি ফিরে আসে আবার। এরই মধ্যে স্বামী ব্যবসার আড়াই লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। জমিলা তখন তিন মাসের সন্তানসম্ভবা। এ সময় জমিলার বাবা তার পাশে দাঁড়ান। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে একমাত্র ছেলে জহুরুলও মায়ের পাশে দাঁড়ান। সেই থেকে এখন পর্যন্ত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জমিলা। শুধু ছেলে নয় গরু ব্যবসায়ীরাও সহযোগিতা করেন তাকে। এক ছেলে, ছেলের বউ আর মেয়ে সোহাগীকে (১৪) নিয়ে সুখের সংসার। বাবার ভিটের পাশেই কিনেছেন আরও ১০ শতাংশ জমি। জমিলা বেগম আরও বলেন, স্বামী চলে যাওয়ার পর যখন দোকানে বসা শুরু করি তখন অনেকেই বিরোধিতা করেছিল। এলাকার কিছু লোক থানায়, ইউনিয়ন পরিষদে আমার নামে অভিযোগ দিয়েছিল। কিন্তু এলাকার সবাই তো এক রকম নয়। কয়েকজন আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সে সময়। তবে বর্তমানে সবাই তাঁকে উৎসাহ জোগান, সাহস দেন বলেও জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর