শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাংলাদেশি শেওলায় ন্যানোফিল্টার

নাসিমুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশি শেওলায় ন্যানোফিল্টার

গল্পের শুরুটা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে সুইডিশ এক অধ্যাপকের হাত ধরে। দূষিত পানি পরিশোধনের জন্য একটি যুতসই ফিল্টার বানানোর মিশনে ছিলেন তিনি। নানান রকমের বস্তু দিয়ে চেষ্টার পর একবার ভেবে বসলেন শেওলা দিয়ে বানাবেন ফিল্টার। এরই এক পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে পেয়ে গেলেন বাংলাদেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে। দুজন মিলে বানিয়ে ফেললেন এমনই ছাঁকনি, যা শুধু পানিকে পরিশোধনই করবে না, বরং এর সব ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়াও দূর করবে। 

এমনই এক ছাঁকনি যে মানুষটির খুঁজে পাওয়া শেওলার মাধ্যমে এসেছে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলমোজাদ্দেদী আলফেসানী। গল্পে গল্পে তার কাছেই জানা গেল পানি পরিশোধনের এই জাদুর ছাঁকনির কথা। শুরুর গল্পটা আজ থেকে ছয় বছর পূর্বের। সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিজ্ঞান বিভাগের ন্যানোপ্রযুক্তি ও ফাংশনাল ম্যাটেরিয়ালসের অধ্যাপক আলবার্ট মিহরানিয়ান দীর্ঘ ছয় বছর ধরে পানি বিশুদ্ধীকরণের জন্য কোনো ছাঁকনি আবিষ্কার করা যায় কিনা- এর ওপর গবেষণা  করেছিলেন। বিভিন্ন উপাদান দিয়ে চেষ্টার পর তিনি চিন্তা করেছিলেন, শেওলা দিয়ে এটা করা যায় কিনা। সর্বপ্রথম ক্ল্যাডোফোরা শেওলা সংগ্রহ করে তিনি প্রাথমিক পর্যায়ে ফিল্টার তৈরি করেন এবং লক্ষ্য করেন, এই ফিল্টারে সব ভাইরাস আটকে যাচ্ছে।

এই সফলতার পর আলবার্ট মিহরানিয়ান চিন্তা করলেন তৃতীয় বিশে^র দেশগুলোতে কীভাবে পানি বিশুদ্ধ করা যায়। এই চিন্তা থেকে বাংলাদেশের পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য শৈবালের ব্যবহার নিয়ে একটি প্রকল্প হাতে নিলেন। এই কাজের জন্য একজন শেওলা বিশেষজ্ঞ খুঁজছিলেন তিনি। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিকস ও টেকনোলজি বিভাগের অনারারি অধ্যাপক ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই রব্বানী উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কিছু যৌথ গবেষণা করেছিলেন। পূর্বের কাজ করার সুবাদে অধ্যাপক সিদ্দিকীর মাধ্যমে ড. আলমোজাদ্দেদী আলফেসানী এই প্রকল্পে যুক্ত হন। এরপরই আলবার্টের সঙ্গে স্কাইপি মিটিংয়ের পর ক্ল্যাডোফোরা শেওলা নিয়ে কাজ শুরু করেন। পুরো কাজে সমন্বয় করেছেন অধ্যাপক ড. খোন্দকার সিদ্দিক-ই রব্বানী। কাজ শুরুর পর দেখা গেল ক্ল্যাডোফোরা জাতীয় শেওলার উৎপাদন খুবই শ্লথগতির। জন্মানোর জন্য ইট-পাথরের প্রয়োজন হয়। আবার ইট-পাথরের গায়ে লেগে থাকা অবস্থায় এর মধ্যে অন্যান্য আরও শেওলা মিশে থাকে। ল্যাবরেটরি ও মাঠ পর্যায়েও পরীক্ষামূলক চাষাবাদ করা হলো।

কিন্তু এটির ব্যাপক উৎপাদনে যাওয়ার পথে বাদ সাধল উৎপাদন খরচের বাহুল্য।

ক্ল্যাডোফোরা শৈবালের এসব দিক চিন্তা করে অধ্যাপক আলমোজাদ্দেদী ভাবলেন, এটি যদি গণমানুষের হাতে পৌঁছে দিতে হয়, তাহলে তাকে এমন শৈবাল ব্যবহার করতে হবে, যার উৎপাদন খরচ কম, কিন্তু উৎপাদন বেশি। এই কথা আলবার্টকে জানানো হলো। সাধের ক্ল্যাডোফিয়ার বাংলাদেশি প্রজাতির ব্যর্থতায় ঘাবড়ে গেলেন তিনি। তবে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন ড. আলমোজাদ্দেদী আলফেসানী, যিনি এর আগে পৃথিবীতে নতুন ১৪টি শৈবাল উপহার দিয়েছেন। জাতীয় অধ্যাপক ড. এ কে এম নুরুল ইসলামের সঙ্গে সেগুলোর নামকরণও করেছিলেন। 

পরে দেশের বিভিন্ন জায়গা খুঁজে বেশকিছু শৈবালের মধ্যে থেকে পিথোফোরা নামে একটি শৈবাল নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দিলেন মিহরানিয়ানকে। কিন্তু তাতেও শঙ্কা কাটছে না তার। তবে অধ্যাপক ড. আলমোজাদ্দেদী শেষ পর্যন্ত তাকে আশ্বস্ত করতে সক্ষম হন।

পরে কার্জন হলে কয়েকটা পিট তৈরি করে পিথোফোরার মাঠ পর্যায়ে চাষ শুরু করা হয়। দেখা গেল এই প্রজাতির শেওলা ১০০ গ্রাম লাগালে ১৮ দিনেই তা সাড়ে তিন থেকে প্রায় চার কেজি হয়। পরে উৎপাদিত শেওলা প্রক্রিয়াজাত করে ফিল্টার বানানোর জন্য সুইডেনে পাঠানো হলো।

ড. আলমোজাদ্দেদী আলফেসানী জানান, আগের শৈবালের চেয়ে এটা সুবিধা ছিল নদ-নদী, বিল-ঝিল ইত্যাদি যে কোনো পরিবেশে এটি উৎপাদন করা যায়। ফলে উৎপাদন ব্যয় খুব কম। দ্রুতবর্ধনশীল এই শৈবালের উৎপাদনও অনেক বেশি। আগের শৈবালে একসঙ্গে বিভিন্ন প্রজাতির শৈবাল থাকলেও পিথোফোরায় অন্য কোনো শৈবাল থাকে না। এর জন্য কোনো কৃত্রিম পরিবেশেরও প্রয়োজন হয় না।

পিথোফোরা শৈবাল সুইডেনে পাঠানো হলে তারা আধুনিক প্রযুক্তিতে ন্যানোফিল্টার তৈরি করে। কাকতালীয়ভাবে এই ফিল্টার ক্ল্যাডোফোরা শৈবাল থেকে তৈরি ফিল্টারের থেকেও বেশি উৎকৃষ্ট। এর কোরের বা ফুটোর সাইজ হলো ১৭ ন্যানোমিটার। আর পানিবাহিত রোগজীবাণুর ন্যূনতম আকার হলো ৩০ ন্যানোমিটার। ফলে খুব সহজেই সব ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া এই ছাঁকনিতে আটকা পড়বে।

বাংলাদেশের পানি বিশুদ্ধতায় এটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের ল্যাবরেটরিতে। এই কাজে নেতৃত্ব দেন বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারা বেগম। তার সঙ্গে ছিলেন সেন্টার ফর অ্যাডভান্স রিসার্চ ইন সায়েন্সের গবেষণা বিজ্ঞানী শারমিন জামান।  

পরীক্ষার জন্য ঢাকার ধানমন্ডি লেক ও তুরাগ নদ থেকে পানি সংগ্রহ করে তা ছাঁকনিতে চালনা করা হলো। ছাঁকনিকৃত পানি পরীক্ষা করে দেখা গেল এটি সব ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ামুক্ত। বড় ব্যাপার হলো, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি ছাঁকনিটি একেবারেই জৈব অর্থাৎ এটি পচনশীল। আর এভাবেই সূচনা হলো পানি নিরাপত্তার এক অধ্যায়ের।

বাংলাদেশ ও সুইডেনের এই সফল যৌথ গবেষণা কর্মের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে। আমেরিকান  কেমিক্যাল সোসাইটির (এসিএস) সাসটেইনেবল কেমিস্ট্রি অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং জার্নালে এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র গত ৬ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের নামিদামি সংবাদপত্র ও বিজ্ঞান সাময়িকীতেও চাওড় হয়েছে বাংলাদেশের  শৈবাল থেকে তৈরি ছাঁকনির খবর। তবে, বাংলাদেশের জন্য অসীম গর্বের এই বস্তু সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে এখনো কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এই ফিল্টার দিয়ে পানি ছাঁকতে প্রচুর চাপের প্রয়োজন হয়। পরিশোধিত হতেও বেশ খানিকটা সময় লাগে। আর ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার জন্য আরও গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নতি দরকার। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়ও জড়িত।

তবে আশার কথা হলো, এর কোনোটিই অর্জন করা খুব একটা কঠিন নয়। অধ্যাপক আনোয়ারা জানালেন, এটা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের একটা কাজ। এই ফিল্টারটি যদি আমরা জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে চাই, তাহলে আরও আধুনিকায়ন করতে হবে। এর জন্য আমাদের ইন্ডাস্ট্রির সহযোগিতা লাগবে। অর্থায়নের একটা ব্যাপার আছে। এটি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিলে তারা ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে।

তিনি আরও জানালেন, আমাদের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আস্তে আস্তে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। ফলে কিছুদিন পর আমাদের ভূমির উপরের অংশের পানির ওপর নির্ভর করতে হবে। আর এই পানিতে আর্সেনিক থাকে না। ফলে ন্যানোফিল্টার ব্যবহার করে ভূ-উপরিস্থ পানি বিশুদ্ধ করা যাবে।

সর্বশেষ খবর