শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

দেশের প্রথম রেসিং চ্যাম্পিয়ন

আইমানের লক্ষ্য ফর্মুলা ওয়ান

মুহাম্মদ সেলিম, চট্টগ্রাম

দেশের প্রথম রেসিং চ্যাম্পিয়ন

আইমান সাদাত। সদ্যই কিশোরে পা দেওয়া আইমান সাদাতের আচরণ এখনো শিশুসুলভ। মাঝে মাঝে বাবা-মা’র কাছে আবদার করে বসেন অন্য সব শিশুর মতোই। আচার-ব্যবহারে এখনো শিশুসুলভ হলেও কর্মযজ্ঞে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন সব বয়সী ক্রীড়াবিদদের। বিদেশের মাটিতে রেসিং ট্র্যাকে ঝড় তুলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন চট্টগ্রামের সন্তান আইমান সাদাত। তিনি দেশের হয়ে প্রথম রেসার হিসেবে জিতেছেন প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃত টুর্নামেন্ট ভারতের ‘ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপ’। তার মাধ্যমে দেশ পেয়েছে প্রথম আন্তর্জাতিক রেসিং চ্যাম্পিয়ন। শুধু চ্যাম্পিয়ন নন, ভারতের চেন্নাইয়ে আইমান ঝড়ে ওলটপালট ‘ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপ’ জুনিয়র প্রতিযোগিতার কিছু ইতিহাস। সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে হয়েছেন জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন। সব প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে অর্জন করেন ৫২৬ রেটিং পয়েন্ট। যা ‘ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপ’র বিগত ১০ বছরের কোনো জুনিয়র প্রতিযোগীর অর্জন করা সর্বোচ্চ পয়েন্ট। বিদেশের মাটিতে লাল-সবুজের কেতন উড়ানো এ কিশোর আগামী বছর অংশগ্রহণ করছেন  ‘ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপ-২০২০’-এ। এবার টার্গেট ট্র্যাকে ঝড় তুলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া।

নিজের স্বপ্ন নিয়ে দেশের প্রথম আন্তর্জাতিক রেসিং চ্যাম্পিয়ন আইমান সাদাত বলেন, ‘আমি এখানে থেমে থাকতে চাই না। আমার পরবর্তী টার্গেট ‘ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপ-২০২০’র চ্যাম্পিয়ন হওয়া। জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে ‘ফর্মুলা ওয়ান’ চ্যাম্পিয়ন হওয়া।’

আইমানের বাবা মিখাইল ইসলাম বলেন, ‘যখন টিভিতে কার রেসিং দেখতাম, তখন মনে মনে ভাবতাম আমার ছেলেদের রেসার বানাব। দেশের রেসিংয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকলেও বিশ্বাস ছিল বিকল্প ব্যবস্থায় ছেলেরা আমার সেই স্বপ্ন পূরণ করবে। বড় ছেলে আফফান ‘ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপ-২০১৭’ তৃতীয় হয়ে সেই প্রত্যাশা অনেক পূরণ করেছে। ছোট ছেলে আইমান জুনিয়র চ্যাম্পিয়ন হয়ে সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে। আমার বিশ্বাস তারা সরকারি প্রয়োজনীয় সাপোর্ট পেলে একদিন ফর্মুলা ওয়ান চ্যাম্পিয়ন হবে।

চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী মিখাইল ইসলাম এক সময় ছিলেন গাড়ি আমদানিকারক। তাই তার দুই সন্তান আফফান সাদাত ও আইমান সাদাতের জন্য নিত্যনতুন মডেলের গাড়ি অনেকটা হাতের মোয়ার মতো। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবা মিখাইল ইসলাম নিজের কোলে বসিয়ে ছোট ছেলে আইমানের হাতে তুলে দেন গাড়ির স্ট্রিয়ারিং। সেই থেকেই কারের সঙ্গে আইমানের পথচলা শুরু। ২০১৫ আইমানের বড় ভাই আরেক রেসার আফফান সাদাত মোটর স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন অব ইউকে থেকে ‘গো কার্ডের’ লাইন্সের জন্য ইংল্যান্ডে যায়। এসময় বাবা ও বড় ভাইয়ের সঙ্গী হন ছোট্ট আইমান। রেসিং ও রেসিং ট্র্যাক দেখেই  ‘রেসিং ভূত’ চেপে বসে আইমানের মাথায়। এরপর বাসায় বড় ভাই আফফান যখন ‘রেসিং সিমুলেটরে’ অনুশীলন করত তখন ছোট্ট আইমান ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতেন কীভাবে বড় ভাই রেসিং করতেন। মাঝে-মধ্যে নিজেই বসে যেতেন রেসিং করতেন। ওই সময় রেসিং করার সময় কোনো ভুল করলে সঙ্গে সঙ্গে শুধরে দিতেন বড় ভাই আফফান। ২০১৭ সালে যখন বড় ভাই আফফান সাদাত ‘ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপে’ তৃতীয় হয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। তখন বাবার একান্ত ইচ্ছায় নিজেকে রেসার হতে প্রতিষ্ঠিত করতে মনোনিবেশ করেন আইমান। বড় ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে শুরু করেন পুরোদমে অনুশীলন। সকাল, দুপুর কিংবা রাত যখনই সময় পেতেন নেমে পড়তেন রেসিং অনুশীলনে। বাসার ‘রেসিং সিমুলেটরে’ চলতে থাকে তার অনুশীলন। ২০১৯ সালে ভারতে ‘এফএমটিআই’ থেকে লাইসেন্স পেয়ে আনুষ্ঠানিক রেসিং টুর্নামেন্টে নামার অনুমোদন পান আইমান। এ বছরের শুরুতে ‘ভক্সওয়াগন মোটর স্পোর্টস’র জুনিয়র রেসার বাছাই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন আইমান। বাছাই পর্বে ১১৯ প্রতিযোগীর মধ্যে দ্বিতীয় হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্বে এসে নিজের জাত চেনান আইমান। চূড়ান্ত পর্বে বাংলাদেশ, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিযোগীদের অনেকটা হেসেখেলেই উড়িয়ে দেন। চূড়ান্ত পর্বে চার সেশনে ১১টি রেস হয়। এ রেসের ৯টিতে প্রথম এবং বাকি দুটিতে দ্বিতীয় হয়ে ‘ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপ-২০১৯’ চ্যাম্পিয়ন হন আইমান।

আইমান সাদাত বলেন, ‘ভক্সওয়াগন অ্যামিও কাপ’ আমি যাদের সঙ্গে লড়েছি তারা সর্বোচ্চ অনুশীলন করেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। আমি প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আগে রেসিং ট্র্যাকে অনুশীলন করতেই পারিনি। কারণ আমাদের দেশে তো কোনো রেসিং ট্র্যাক নেই। তাই অনুশীলনের জন্য ভরসাই ছিল বাসার ‘রেসিং সিমুলেটর’। দেশে নেই কোচ। এমনকি স্পন্সর হিসেবেও কারও এগিয়ে আসার আগ্রহ নেই। এত ব্যয়বহুল খেলা আসলে স্পন্সর ছাড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’ তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমার বাবার জন্য খুবই কষ্ট হয়। ওনার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যয় করছি। দেশের ভাবমূর্তি বিদেশির মাটিতে উজ্জ্বল করছি। কিন্তু আমার কোনো স্পন্সর নেই।’ আইমানের চাচা মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘রেসিংয়ের জন্য দেশে তো কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। তারপর আইমান সবকিছু জয় করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আইমান আমাদের গর্ব।  আইমান দেশের গর্ব।

সর্বশেষ খবর